নিজস্ব প্রতিবেদক:
ইসরায়েলের পার্লামেন্ট নেসেটে ভাষণ দেওয়ার সময় ফিলিস্তিন সমর্থক দুই এমপির বাধার মুখে থামতে হয়েছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে। গতকাল সোমবার ট্রাম্প ভাষণ শুরুর পরপরই নজিরবিহীন এ ঘটনা ঘটে। আইমান ওদেহ নামের এক আরব-ইসরায়েলি এমপি ফিলিস্তিনের স্বীকৃতি দাবিতে প্ল্যাকার্ড দেখান। এ সময় ট্রাম্প থামতে বাধ্য হন। নিরাপত্তারক্ষীরা আইমানকে নেসেটের বাইরে নিয়ে যান। পরে একইভাবে প্রতিবাদ জানালে আরেকজনকেও বাইরে বের করে দেওয়া হয়।
এদিন যুদ্ধবিরতি শর্তের অংশ হিসেবে গাজা থেকে আটক এক হাজার ৭০০ জন এবং আরও ২৫০ জন ফিলিস্তিনি বন্দিকে মুক্ত করার কথা ইসরায়েলের। অপরদিকে জীবিত ২০ জিম্মিকে মুক্তি দেয় ফিলিস্তিনের সশস্ত্র সংগঠন হামাস। ইসরায়েলের বন্দিদের মানবাধিকার সংস্থা রেড ক্রসের কর্মীদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। অপরদিকে বাসে কয়েকশ ফিলিস্তিনি বন্দিকে পশ্চিমতীরে ও গাজার দক্ষিণাঞ্চলে পৌঁছে দেওয়া হয়। দুই বন্দি ও জিম্মি মুক্তিকে কেন্দ্র করে উভয়পক্ষে লোকজনকে উল্লসিত দেখা গেছে। তবে ‘ফিলিস্তিনের ম্যান্ডেলা’খ্যাত মারওয়ান বাগৌতি মুক্তি পেয়েছেন কিনা জানা যায়নি। ফাতাহ পার্টির এ নেতার মুক্তি ছিল যুদ্ধবিরতির অন্যতম শর্ত।
যুদ্ধবিরতিকে কেন্দ্র করে যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। এ অবস্থায় নিরাপত্তা রক্ষায় কয়েক হাজার হামাস যোদ্ধা সড়কে বের হয়ে আসেন। এরই মধ্যে উপত্যকায় ইসরায়েলের সহযোগিতায় ভিন্ন একটি সশস্ত্র গ্রুপের অবির্ভাব হয়েছে। গতকাল তাদের সঙ্গে ব্যাপক সংঘর্ষে জড়ান হামাস সদস্যরা। গাজার ওই সশস্ত্র গ্রুপের হাতে নিহত হয়েছেন খ্যাতিমান ফিলিস্তিনি মানবাধিকারকর্মী সালেহ আল জাফরাওয়ি।
এ অবস্থায় দীর্ঘমেয়াদি শান্তিচুক্তিতে পৌঁছাতে মিসরের সমুদ্র তীরবর্তী অবকাশযাপন কেন্দ্র শার্ম আল শেখে ঐতিহাসিক সম্মেলনে বসতে যাচ্ছেন বিশ্বনেতারা। সেখানে যেমন কাতারের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ বিন আবদুল রহমান বিন জসিম আল থানি থাকবেন, তেমনি অংশ নেবেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও। ঐতিহাসিক ওই সম্মেলনের দিকে নজর রাখছে পুরো পৃথিবী।
নেসেটে দেওয়া ভাষণে ট্রাম্প যুদ্ধ বন্ধের জন্য ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। সেই সঙ্গে তিনি যুদ্ধবিরতিকে ‘ঐতিহাসিক ঘটনা’ বলেও বর্ণনা করেন। গত ৭ অক্টোবর গাজায় ইসরায়েলের আগ্রাসনের দুই বছর পূর্ণ হয়। এ সময়ে হামলায় গাজার ৬৭ হাজারের বেশি মানুষ নিহত ও এক লাখ ৬৯ হাজার জন আহত হন। এর মধ্যে ২০ হাজারের বেশি শিশু রয়েছে।
ফিলিস্তিনের স্বীকৃতি চেয়ে প্রতিবাদ
ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, নেসেটে ট্রাম্পের ভাষণ চলাকালে প্রথমে আইমান ওদেহ প্রতিবাদ জানান। তাঁর হাতে ইংরেজিতে ‘ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিন’ লেখা প্ল্যাকার্ড ছিল। এ সময় হট্টগোল সৃষ্টি হয়। নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা তাঁকে ধরে বাইরে নিয়ে যান। একইভাবে নেসেটের আরেক সদস্য ওফার কাসিফও প্রতিবাদ জানান। তাঁকেও নেসেট কক্ষ থেকে বের করে দেওয়া হয়। তাদের হাত থেকে প্ল্যাকার্ড ছিনিয়ে নেওয়া হয়।
দ্য টাইমস অব ইসরায়েল জানায়, আইমান ‘হাদাশ-তাল’ পার্টির চেয়ারম্যান। এটি মূলত আরব-ইসরায়েলিদের একটি দল। আর কাসিফ দলটির একমাত্র ইহুদি এমপি। মিডল ইস্ট আই জানায়, পার্লামেন্ট থেকে বের করে দেওয়ার পর সামাজিক মাধ্যম এক্স-এ এক পোস্টে ওদেহ লেখেন, ‘তাদের কাছে আমার একটি মাত্রা অপরাধ। আমি এমন একটি সহজ দাবি তুলেছি, যা পুরো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মেনে নিয়েছে। তা হলো– ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া। এ সহজ সত্য স্বীকার করতে বলায় আমাকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।’
কাসিফও পার্লামেন্টে একই কাগজ উঁচিয়ে ধরেন। পরে তিনি এক্স-পোস্টে লেখেন, ‘আমরা কোনো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্য আসিনি; ন্যায়ের দাবি নিয়ে এসেছিলাম। অবরোধ ও বর্ণবাদী শাসনের অবসান ও ইসরায়েলের পাশে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই কেবল প্রকৃত শান্তি সম্ভব। দখলদারি অস্বীকার কর! রক্তপাতে আগ্রহী সরকার ঠেকাও।’
আলজাজিরা জানায়, আইমান আরও লেখেন, ‘মন্ত্রিসভায় যে পরিমাণ ভণ্ডামি হচ্ছে, তা অসহনীয়। কোনো সুপরিকল্পিত গোষ্ঠী তোষামোদের মাধ্যমে নেতানিয়াহুকে মুকুট পরাচ্ছে, যা আগে কখনও দেখা যায়নি। এতে গাজায় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধ থেকে তিনি ও তাঁর সরকার অব্যাহতি পেয়ে যাবেন না। লাখ লাখ ফিলিস্তিনি ও হাজার হাজার ইসরায়েলি নিহতের ঘটনায় রক্তপাতের দায় থেকেও তিনি মুক্তি পাবেন না।’ তিনি লেখেন, ‘কেবল দখলদারিত্বের অবসান ও ইসরায়েলের পাশাপাশি ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতিই সবার জন্য ন্যায়বিচার, যা শান্তি ও নিরাপত্তা বয়ে আনবে।’
ভাষণে যা বললেন ট্রাম্প
নেসেটে দীর্ঘ ভাষণ দিয়েছেন ট্রাম্প। এ সময় ‘দাঁড়িয়ে সম্মাননা’ দেওয়া হয়। ভাষণে তিনি যুদ্ধ বন্ধের জন্য ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর প্রশংসা করেন। সেই সঙ্গে তিনি আরব নেতাদের প্রশংসা করেছেন। আরব দেশ ও মুসলিম নেতাদের যারা হামাসকে চাপ দেওয়ার জন্য একত্রিত হয়েছিলেন এবং জিম্মিদের মুক্ত করেছিলেন, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান তিনি। ট্রাম্প বলেন, আমরা অনেক সহায়তা পেয়েছি– এমন অনেক লোক ছিল যাদের সন্দেহ করা যায় না। আমি তাদের অনেক ধন্যবাদ জানাতে চাই।
যুদ্ধের ইতি ঘোষণা
হামাসের সঙ্গে যুদ্ধবিরতির চুক্তির মাধ্যমে যুদ্ধের সমাপ্তি হয়েছে বলে ভাষণে উল্লেখ করেন ট্রাম্প। তিনি বলেন, এটি কেবল একটি যুদ্ধের সমাপ্তি নয়। এটি সন্ত্রাস ও মৃত্যুর যুগের সমাপ্তি এবং বিশ্বাস, আশা ও ঈশ্বরের যুগের সূচনা। তিনি বলেন, এটা ইসরায়েল ও মহৎ জাতিগুলোর মহান ঐক্য ও স্থায়ী সম্প্রীতির সূচনা। এটা নতুন মধ্যপ্রাচ্যের ঐতিহাসিক ভোর।
দুর্নীতির মামলা থেকে নেতানিয়াহুর অব্যাহতি চান ট্রাম্প
নেসেটে দেওয়া ভাষণে দুর্নীতির মামলা থেকে নেতানিয়াহুর অব্যাহতি চেয়েছেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি বলেন, নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে তিনটি পৃথক দুর্নীতির মামলা বিচারাধীন রয়েছে, এগুলো থেকে তাঁকে ক্ষমা করে দেওয়া উচিত। ফ্রান্ট টোয়েন্টিফোর জানায়, নেতানিয়াহু ও তাঁর স্ত্রী সারার বিরুদ্ধে ধনকুবেরদের কাছ থেকে দুই লাখ ৬০ হাজার ডলার মূল্যের সিগার, জুয়েলারির মতো বিলাসী পণ্য ও প্রচারণায় অর্থ নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। ভাষণে ট্রাম্প মজা করে বলেন, ‘সিগার ও প্রচারণার অর্থ– এগুলো আসলে কে গুরুত্ব দেয়!’ তিনি নেতানিয়াহুকে ইসরায়েলের ‘শ্রেষ্ঠ যুদ্ধকালীন নেতা’ বলে বর্ণনা করে বলেন, ‘কেন তাঁকে আপনারা মুক্তি দিচ্ছেন না?’
ইরানের সঙ্গে শান্তিচুক্তির আশা ট্রাম্পের
আলজাজিরা জানায়, ইসরায়েলের পার্লামেন্টে দেওয়া ভাষণে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেন, ইরানের সঙ্গে যদি কোনো শান্তি চুক্তি সম্ভব হয়, তবে তা দারুণ হবে। ‘ইরানের জনগণ বাঁচতে চায়’ বলেও মন্তব্য করেন তিনি। ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে ইরানের দীর্ঘদিন ধরে মতবিরোধ চলছে। পশ্চিমাদের দাবি, ইরান পারমাণবিক বোমা বানানোর দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে। কিন্তু ইরান বারবার এ দাবি অস্বীকার করে বলেছে, পারমাণবিক বোমা তৈরির কোনো উদ্দেশ্য তাদের নেই।
মিসরের সম্মেলনে বিশ্বনেতারা
গাজায় শান্তি সম্মেলনে যোগ দিতে মিসরের রিসোর্ট শহর শার্ম আল শেখে জড়ো হয়েছেন বিশ্বনেতারা। মিডল ইস্ট আই জানায়, গতকাল সোমবার দিন শেষে সেখানে এ সম্মেলন হওয়ার কথা রয়েছে। এতে যোগ দিতে স্থানীয় সময় সন্ধ্যায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প মিসরে পৌঁছান। থাকছেন ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসও। এ ছাড়া ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার, ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান, ইরাকের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ শিয়া আল-সুদানিমতো নেতারাও থাকছেন।
আলজাজিরা জানায়, এরই মধ্যে বিশ্বনেতাদের অনেকেই শার্ম আল শেখে পৌঁছেছেন। ওই রিসোর্ট এলাকায় বড় বড় বিলবোর্ডে বিশ্বনেতাদের ছবি দেখা গেছে। সম্মেলনে অংশ নেবেন জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসও। তবে শান্তি সম্মেলনে থাকছেন না ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। নেতানিয়াহুর কার্যালয় এক বিবৃতিতে এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।
জীবিত সব জিম্মিকে মুক্তি দিয়েছে হামাস
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের গাজা শান্তি পরিকল্পনার শর্ত মেনে ইসরায়েলের জীবিত ২০ জিম্মিকে মুক্তি দিয়েছে ফিলিস্তিনের সশস্ত্র সংগঠন হামাস। বিবিসি জানায়, গতকাল সোমবার স্থানীয় সময় সকাল ৮টার পর থেকে দুই ধাপে তাদের মুক্তি দেওয়া হয়। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী (আইডিএফ) দুই ধাপে জিম্মি মুক্তির বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। ইসরায়েলের হিসাব অনুযায়ী, গাজায় সবশেষ ৪৮ ইসরায়েলি জিম্মি অবস্থায় ছিলেন। তাদের মধ্যে ২০ জন বেঁচে ছিলেন। মুক্ত জিম্মিদের সবাই গাজা থেকে ইসরায়েলের গেছেন।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, হামাস গাজায় যে ‘নতুন করে অস্ত্র সজ্জিত’ হচ্ছে সেটা যুক্তরাষ্ট্র জানে। তিনি দাবি করেন, গোষ্ঠীটিকে ‘সাময়িক সময়ের জন্য’ সশস্ত্র থাকার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। আলজাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়, ইসরায়েলে পৌঁছানোর আগে এয়ারফোর্স ওয়ানে এক সাংবাদিক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে প্রশ্ন করেন– হামাস ‘নতুন করে অস্ত্র সজ্জিত’ হচ্ছে এবং নিজেদের ফিলিস্তিনি পুলিশ বাহিনী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করছে। জবাবে ট্রাম্প বলেন, কয়েক মাসের যুদ্ধের পর গোষ্ঠীটি শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘তারা (হামাস) এ বিষয়ে খোলামেলা কথা বলেছে এবং আমরা তাদের কিছু সময়ের জন্য সশস্ত্র থাকার অনুমোদন দিয়েছি।’ তিনি যুক্তি দেখিয়ে বলেন, আপনাকে বুঝতে হবে, তারা সম্ভবত ৬০ হাজার মানুষ হারিয়েছে। এটি এক বিশাল ক্ষতি। ট্রাম্প বলেন, যুক্তরাষ্ট্র চায় নিজ নিজ বাড়িঘরে ফিরে আসা গাজায় বাসিন্দারা যেন নিরাপদে পুনর্গঠন কাজ করতে পারেন। গাজাকে আক্ষরিক অর্থেই ধ্বংসস্তূপ বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, মানুষ নিজেদের বাড়িঘরে ফিরে আসার সময় অনেক খারাপ ঘটনা ঘটতে পারে।
গাজায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৬৭,৮৬৯
ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গতকাল সোমবার এক দিনে গাজায় ৬৩টি মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এদের মধ্যে ৬০টি মৃতদের আগে ইসরায়েলে হামলা চালানোর সময়ের। অনেকে এখনও ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকা পড়েন আছেন।
একে