নিজস্ব প্রতিবেদক:
ফের রাজধানীতে বর্জ্যবাহী গাড়ির ধাক্কায় মৃত্যু হয়েছে। এবার রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে ময়লার গাড়িতে পিষ্ট হয়ে প্রাণ গেছে ইকবাল হোসেন (৩৫) নামে এক যুবকের। তিনি পেশায় লন্ড্রি দোকানের কর্মী ছিলেন। গত বৃহস্পতিবার রাতে যাত্রাবাড়ীর কলাপট্টি এলাকায় ঘটনাটি ঘটে। গাড়িটি চালাচ্ছিলেন চালকের সহকারী মো. রুবেল। স্থানীয়রা তাকে গণপিটুনি দিয়ে পুলিশে দেয়। রাত ১০টা থেকে ভোর পর্যন্ত রাজধানীতে দক্ষিণ ও উত্তর সিটি করপোরেশনের বর্জ্যবাহী গাড়ি মাঝেমধ্যেই ‘যমদূত’ হয়ে আসে বলে অভিযোগ।
প্রাথমিকভাবে দেখা যায়, এসব দুর্ঘটনায় চালকের সহকারী বা পরিচ্ছন্নতাকর্মীরাই গাড়ি চালাতেন। কখনো কখনো মাদকাসক্ত অবস্থায় চালকের অবহেলায় প্রাণহানিও ঘটেছে। গত তিন বছরে ঢাকায় ময়লার গাড়ির ধাক্কায় অন্তত ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে; কিন্তু কোনো ভুক্তভোগী পরিবার বিচার পায়নি।
বৃহস্পতিবার রাতের ঘটনাতেও জনতার সামনে সিটি করপোরেশনের গাড়ির চাকায় পিষ্ট হয়ে ইকবালের মৃত্যু হলেও যাত্রাবাড়ী থানা পুলিশ নিয়েছে অপমৃত্যুর মামলা। জনতা হাতেনাতে চালকের সহকারীকে ধরলেও পুলিশ তাকে ৫৪ ধারায় আটক দেখিয়ে কারাগারে পাঠিয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, রাত আনুমানিক ১০টায় ইকবাল রাস্তা পার হচ্ছিলেন। ওই সময় দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়িটি ধাক্কা দিলে তিনি ছিটকে পড়েন। পরে চাকায় পিষ্ট করে চালক পালানোর চেষ্টা করলে জনতা ধরে ফেলে মারধর করে। একপর্যায়ে সে জানায়, সে চালক নয়, চালকের পরিবর্তে গাড়িটি চালাচ্ছিল। এরপর পুলিশ এসে তাকে নিয়ে যায়।
যাত্রাবাড়ী থানার উপপরিদর্শক (এসআই) সাদ্দাম হোসেন বলেন, ‘ময়লার গাড়ির ধাক্কায় ইকবাল ঘটনাস্থলেই মারা যান। তার মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে পাঠানো হয়েছে। ঘটনাটি অপমৃত্যুর মামলা হিসেবে নথিভুক্ত করা হয়েছে।’
তবে কেন সড়ক নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়নি—এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এ ধরনের ঘটনায় অপমৃত্যুর মামলাই হয়ে থাকে।’ যাত্রাবাড়ী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) কাজী রমজানুল হক বলেন, ‘কেউ অভিযোগ করেনি, তাই ৫৪ ধারায় আটক দেখিয়ে আদালতে পাঠানো হয়েছে।’ তিনি জানান, গণপিটুনিতে চালকের সহকারী আহত হওয়ায় জিজ্ঞাসাবাদ করা সম্ভব হয়নি। ময়লার গাড়িটি জব্দ করা হয়েছে।
শুক্রবার সকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গের সামনে নিহত ইকবালের বড় ভাই তরিকুল ইসলাম ফারুক বলেন, ‘ইকবাল যাত্রাবাড়ীতে লন্ড্রির দোকানে কাজ করতেন। রাত ১০টায় কাজ শেষে বাসায় ফিরছিলেন। কলাপট্টি এলাকায় রাস্তা পার হতে গিয়ে ময়লার গাড়ি তাকে ধাক্কা দেয়। আমার ভাইকে গাড়িচাপা দিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে।’ তিনি জানান, লাশ দাফনের পর মামলা করবেন।
স্বজনরা জানান, ইকবালের বাড়ি বরিশালের বানারীপাড়ার পশ্চিম চোখরায় গ্রামে। তিনি স্ত্রী ও এক শিশুসন্তান নিয়ে যাত্রাবাড়ীর ধলপুর এলাকায় থাকতেন।
এদিকে, দুর্ঘটনা ঘটানো গাড়ির মালিকানা নিয়ে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন দপ্তরের মধ্যে দায় ঠেলাঠেলি শুরু হয়েছে। ৪৮ নম্বর ওয়ার্ডের পরিচ্ছন্নতা পরিদর্শক সেলিম মৃধা দাবি করেছেন, ঘটনাটি তার এলাকায় নয়, ৫০ নম্বর ওয়ার্ডে। কিন্তু ৫০ নম্বর ওয়ার্ডের পরিদর্শক খলিলুর রহমান বলেছেন, ঘটনাস্থল ৪৮ নম্বর ওয়ার্ডেই।
অঞ্চল ৫-এর আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা আবু আসলাম বলেন, ‘ভয়ে হয়তো স্থানীয় কর্মকর্তারা তথ্য স্বীকার করেননি, তবে দুর্ঘটনাটি ঘটেছে। এটি বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের নয়, পরিবহন বিভাগের দায়িত্ব।’
পরিবহন বিভাগের মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ নাছিম আহমেদ বলেন, ‘গাড়িটি পরিবহন বিভাগের হলেও এর রক্ষণাবেক্ষণ যান্ত্রিক বিভাগ দেখে। চালক ও সহকারীর নিয়ন্ত্রণও তাদের হাতে। তাই কে গাড়ি চালাচ্ছিল, এখনো জানি না।’ তিনি আরও বলেন, ‘দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের গাড়ি হওয়ায় প্রচলিত আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
এর আগে গত বছরের ২৫ এপ্রিল রাজধানীর মুগদায় দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ির ধাক্কায় সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী মাহিন আহমেদ মারা যায়। ২০২১ সালের ২৪ নভেম্বর গুলিস্তানে ময়লার গাড়িতে নটর ডেম কলেজের ছাত্র নাঈম হাসান নিহত হন। পরদিন পান্থপথে সংবাদকর্মী আহসান কবির খান মারা যান। নাঈমের মৃত্যুর পর নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাজপথে নামেন শিক্ষার্থীরা।
২০২৩ সালের ৬ মার্চ উত্তর সিটি করপোরেশনের গাড়ির ধাক্কায় মারা যান কাপড় ব্যবসায়ী আবু তৈয়ব (২৬)। ২০২২ সালে ময়লার গাড়ির দুর্ঘটনায় কমপক্ষে চারজনের মৃত্যু হয়—এর মধ্যে ২ এপ্রিল খিলগাঁওয়ে নাসরিন খানম, ২৩ জানুয়ারি মহাখালী উড়াল সড়কের নিচে শিখা রানী ঘরামি, জুলাইয়ে মিরপুরে সাব্বির আহমেদ এবং মুগদার টিটিপাড়ায় নাজমা বেগম। এ ছাড়া ২০২১ সালে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের বর্জ্যবাহী গাড়ির ধাক্কায় অন্তত সাতজন প্রাণ হারান।
একে