এক যুগেরও বেশি সময় ধরে আইন পেশায় নিয়োজিত আছেন শারমিন সুলতানা। পাশাপাশি দায়িত্ব পালন করছেন ব্লাস্ট এবং শ্রমিক আইন সহায়তা সেল এর প্যানেল আইনজীবী হিসেবে। বর্তমানে লেবার কোর্ট বার এসোসিয়েশনের সহ সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ৮ মার্চ আর্ন্তজাতিক নারী দিবস। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে এসে আইন পেশায় নারীর প্রতিবন্ধকতা, সক্ষমতা ও সফলতা নিয়ে আইনজীবী শারমিন সুলতানার সাথে কথা বলেছেন ইমাম মেহেদী।
* কেমন আছেন?
** আমি ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?
* আল্লাহর রহমতে ভালো আছি। আপনি আইন পেশায় আসলেন কিভাবে?
** আমার বাবা আইন বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন। মূলত বাবার ইচ্ছাতেই এই বিষয়ে পড়াশোনা এবং পেশায় আসা। ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন ছিলো একজন আইনজীবী হব, সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। বাবা বলতেন আইন দিয়ে মানুষের সেবা করতে হবে, সুরক্ষা দিতে হবে, মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে। বাবার অনুপ্রেরণার সাথে পরিবারের সহযোগিতা আমাকে দারুণভাবে উৎসাহিত করেছে।
* আপনি তো প্রাকটিস করছেন এক যুগেরও বেশি সময়, আইন বিষয়ে আপনার পড়াশোনা কোন কোন প্রতিষ্ঠান থেকে?
** আমি আইন পেশায় যুক্ত আছি এক যুগেরও বেশি সময়। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে অনার্স ও মাস্টার্স শেষ করে আইন পেশায় যুক্ত হয়েছি। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমফিল করছি আইন বিষয়ের উপরই।
* রাষ্ট্র ও নাগরিকের গুরুত্বপূর্ণ একটি জায়গা আইন-আদালত। এই পেশায় নারীর অংশগ্রহণ ও প্রতিবন্ধকতা বিষয়ে আপনার মতামত কি?
** বর্তমানে অন্যান্য পেশার ন্যায় আইন পেশাতে নারীর অবস্থান অনেক শক্তিশালি। কিন্তু কিছু প্রতিবন্ধকতাও আছে। এই পেশা একটি চ্যালেঞ্জিং পেশা। এখানে অনেক সময় এবং ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হয়। সকাল থেকে রাত পযর্ন্ত কাজ করতে হয়। এখনও এই পেশাতে নারীরা সর্বোচ্চ পদে যেতে পারেনি। যেমন স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরেও প্রধান বিচারপতি পদে কোন নারী আসেনি।
এই পেশায় সময়ের কোন বাধ্যবাধকতা নেই। জেলা শহর কিংবা রাজধানীর সর্বোচ্চ জায়গাতেও নারী আইনজীবীর জন্য পর্যাপ্ত সুরক্ষা নিশ্চিত হয়ে ওঠেনি। নারী আইনজীবীদের জন্য আলাদা কমন রুম, ওয়াশ রুম ও ডে কেয়ার সেন্টারের মত সুযোগ তৈরি হয়নি। একজন পুরুষ যেভাবে পারে নারীরা কিন্তু সেইভাবে এই সুযোগ গ্রহণ করতে পারে না। আপিল বিভাগে নারীর অংশগ্রহণ আছে কিন্তু অন্যান্য ক্ষেত্রে এখনও পর্যাপ্ত নয়। একইভাবে বিচার প্রার্থী নারীদের জন্যও আলাদা কোন ব্যবস্থা নেই। বিশেষ করে শিশুদের মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানোর জন্য ব্রেস্ট ফিডিং কর্ণার নেই।
আবার বারের আইনজীবীদের শীর্ষ পদে কিন্তু নারী নেই। সুপ্রিম কোর্টের বার এসোসিয়েনের প্রেসিডেন্ট পদেও কিন্তু এখনও কোন নারী আসেনি। তবে বিশ্ববিদ্যালয়, আদালত, বিচারিক কাজে নারীরা অনেক এগিয়ে গেছে। বেগম রোকেয়া ও সুফিয়া কামাল যে পথ দেখিয়ে গেছেন আমরা সেই পথে চলছি। আমরা তাদের উত্তরসূরি।
* আমাদের দেশে বা বর্হিবিশে^ও অনেক পেশায় নারীরা তাদের কর্মক্ষেত্র ও পেশাগত দায়িত্ব পালনে যৌন হয়রানী এবং বৈষম্যর শিকার হন আপনাদের ক্ষেত্রে তার প্রতিফলন কতোটুকু?
** আমাদের এখানে বা কর্মক্ষেত্রে এই বিষয় যে একদম নেই সেটা বলা যাবে না। অনেকেই প্রতিবাদ করেন আবার মুখ বুঝে সহ্য করা মানুষের সংখ্যাও আছে। হাইকোর্টের নিদের্শনা থাকলেও এখনও যৌন হয়রানীর শিকার হলে প্রতিকারের জন্য প্রতিরোধ সেল বা অভিযোগ কমিটি নেই। ফলে এ ধরণের সমস্যা হলে তাকে নিজে নিজেই সাধারণত মোকাবেলা করতে হয়। যাওয়ার কোন জায়গা তৈরি হয়নি। নানান প্রতিকূলতা মোকাবেলা করেই নারীদের এগিয়ে যেতে হয়। সন্ধ্যার পর চেম্বার করে রাতে বাসায় ফিরতে হয়। এটি সহজভাবে দেখার সুযোগ নেই। সবসময় পুরুষ আইনজীবীদের কাছ থেকে যে আমরা বন্ধুসুলভ ব্যবহার ও সহযোগিতা পেয়ে থাকি বিষয়টা কিন্তু তা না।
* ধর্ষণ, নারী ও শিশু নির্যাতন এই ধরণের মামলা পরিচালনায় অংশগ্রহণ, সুরক্ষা ও সেবা নিশ্চিতকরণে নারী আইনজীবীদের ভূমিকার বিষয়ে কি বলবেন?
** হ্যাঁ এইটা খুবই ভালো প্রশ্ন। এই ক্ষেত্রে আমাদের নারী আইনজীবী এবং বিচারকরা একটা দৃষ্টান্ত বলতে পারেন। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবুনালে কিন্তু নারী আইনজীবী পছন্দ করেন ভূক্তভোগীরা। কারণ আমাদের কাছে খুব সহজেই বিষয়গুলো বলতে পারেন, জানাতে পারেন। পুরুষদের কাছে কিন্তু সেটা সহজভাবে সম্ভব হয়ে ওঠেনা। তবে এই ক্ষেত্রেও যে নারীর অংশগ্রহণ পর্যাপ্ত সেটি বলা যাবে না। আশার কথা হচ্ছে দিন দিন উল্লেখযোগ্য হারে আইন পেশায় নারীর অবস্থানের জায়গা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অন্যদিকে মানব পাচার দমন ট্রাইবুনালের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এখানেও কিন্তু ভূক্তভোগী নারীর সংখ্যা কম নয়। এই ক্ষেত্রে নারী আইনজীবীদের বড় একটা ভূমিকা এবং অংশগ্রঞনের সুযোগ রয়েছে।
* আপনিতো ব্লাস্ট এবং শ্রমিক আইন সহায়তা সেল এর প্যানেল আইনজীবী হিসেবেও কাজ করছেন?
** হ্যাঁ আমি এই দুইটি জায়গাতেও কাজ করি। প্রকৃতপক্ষে আইনজীবী এবং ডাক্তারি পেশাকে কিন্তু শুধু পেশা হিসেবে বিবেচনা করলে হবে না। এটি একটি সেবার পেশা, দায়িত্ববোধের জায়গা। আমরা সেবা দিয়ে, সুরক্ষা দিয়ে মানুষের অধিকার নিশ্চিতকরণে কাজ করি। এর বাইরেও আমি ‘আইএলও’ এর রিসোর্স পারসন হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছি।
* একজন নারী আইনজীবী হিসেবে পরিবারের সহযোগিতাকে কিভাবে দেখবেন?
** পরিবারের সহযোগিতাটা আসলে অনেক বড় একটি বিষয়। বিশেষ করে পরিবার থেকে যদি সহযোগিতা না আসে তাহলে আইন বিষয়ে পড়াশোনা এবং পেশা হিসেবে নেওয়াটা খুবই কঠিন। এক্ষেত্রে আমি আমার বাবা-মা ও হাজব্যান্টের কাছ থেকে খুবই সহযোগিতা পাই। যার ফলে আমি নিশ্চিন্তে কাজ করতে পারি। তবে সবার ক্ষেত্রে এমনটি নাও হতে পরে।
* আমাদের সংবিধান নারী-পুরুষ সবার সমান অধিকার দিয়েছে। আপনার পেশা ও মামলা পরিচালনা এবং ভূক্তভোগী নারীদের ক্ষেত্রে তার কতোটুকু প্রতিফলন দেখতে পান?
** রাষ্ট্র আমাদের নারী পুরুষের সমান অধিকার দিয়েছে। এটি খুবই বড় একটা বিষয়। আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী, জাতীয় সংসদের স্পিকার নারী। তবে পুলিশ প্রশাসন, সেনাবাহিনী, বিমান বাহিনী, নৌ বাহিনীর মতই কিন্তু আমাদের সর্বোচ্চ পদে নারীরা এখনও অলঙ্কিত হতে পারেননি। এই জায়গা গুলো আমাদের তৈরি করতে হবে। তাহলে নারীরা তাদের শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রের জায়গায় আরো এগিয়ে যেতে পারবে। ঠিক একইভাবে আমাদের পেশাগত ক্ষেত্রে নারীর সমান অধিকার নিশ্চিত হলেও সমান অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়নি। পুরুষ আইনজীবীদের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করেই কিন্তু আমাদের উপরে উঠতে হয়। আমাদের জন্য আলাদা কোন সুযোগ নেই। অন্যদিকে ভূক্তভোগীর ক্ষেত্রে একই রকম চিত্র প্রতিফলিত হয়। তবে আইন পেশায় নারীর অংশগ্রহণ ও সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত হতে পারলে কিন্তু ভূক্তভোগী নারীদের দ্রুত সুষ্ঠ বিচার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা সহজ হবে বলে আমি মনে করি।
* ধন্যবাদ আপনাকে অনেক সময় দিলেন।
** আপনাকেও ধন্যবাদ।
সময় জার্নাল/