ফিচার ডেস্ক:
ফ্রিদা কাহলোর ১৯৪০ সালে আঁকা চিত্রকর্ম 'দ্য ড্রিম (দ্য বেড)'। সম্প্রতি এক নিলামে ছবিটি ৫৪ দশমিক ৬৬ মিলিয়ন ডলারে বিক্রি হয়েছে। কোনো নারী শিল্পীর আঁকা ছবির ক্ষেত্রে এটিই এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ দামে বিক্রির বিশ্বরেকর্ড।
নিলামকারী প্রতিষ্ঠান সথবি'স বলছে, ছবিটিতে ফ্রিদার আজীবনের মৃত্যুচিন্তা, শারীরিক কষ্ট এবং নিজের সত্তার আবেগী জটিলতা ফুটে উঠেছে। তবে এই আকাশছোঁয়া দাম আর শৈল্পিক ব্যাখ্যার আড়ালে লুকিয়ে আছে এক প্রেম ও বিচ্ছেদের গল্প; যে অভিমান থেকে চিত্রকর্মটি মেক্সিকো থেকে সরানো হয়েছিল।
মেক্সিকান ও লাতিন আমেরিকান শিল্পকলা বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক লুইস-মার্টিন লোজানো জানান, এই ছবিটি মেক্সিকো থেকে সরানো হয়েছিল ১৯৪০ থেকে ১৯৫০ সালের মাঝামাঝি সময়ে। ১৯৮৪ সালে মেক্সিকো সরকার ফ্রিদা কাহলোর সব কাজকে 'জাতীয় সম্পদ' ঘোষণা করে রপ্তানি নিষিদ্ধ করার আগেই এটি দেশের বাইরে চলে যায়।
কিন্তু কেন ফ্রিদা এই ছবিটি হাতছাড়া করেছিলেন? লোজানো জানান, ছবিটি ফ্রিদা এঁকেছিলেন তার প্রেমিক ও আমেরিকান আলোকচিত্রী নিকোলাস মুরের জন্য। মুরের সঙ্গে ফ্রিদার সম্পর্ক ছিল ১০ বছরের। কিন্তু ১৯৩৯ সালে মুরে যখন ফ্রিদাকে জানান যে তিনি অন্য কাউকে বিয়ে করতে যাচ্ছেন, তখন অভিমানে ফ্রিদা উপহারটি নিজের কাছে না রেখে সরিয়ে ফেলতে চেয়েছিলেন।
ওই সময়টা ফ্রিদার জন্য মোটেও সহজ ছিল না। ১৯৩৯ সালে প্যারিস থেকে ফিরেই তিনি বড় ধাক্কা খান। স্বামী বিখ্যাত চিত্রশিল্পী দিিয়েগো রিভেরা তার কাছে বিচ্ছেদ চাইলেন। ফ্রিদা ভেঙে পড়েছিলেন, কারণ তিনি বুঝতেই পারছিলেন না কেন এমন হলো। তাদের সম্পর্কটা ছিল 'ওপেন রিলেশনশিপ'—রিভেরার জীবনে বহু নারী ছিল, রিভেরাও জানতেন ফ্রিদার প্রেমিক আছে। কিন্তু রিভেরার বিচ্ছেদের সিদ্ধান্তে ফ্রিদা দিশেহারা হয়ে পড়েন।
তবে ব্যক্তিগত জীবনের এই ঝড়ের মধ্যেও ফ্রিদা নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিলেন। ওই সময়েই নিউইয়র্কে তার একক প্রদর্শনী সফল হয়, সেখানে বেশ কিছু ছবি বিক্রি হয়। এমনকি ল্যুভর মিউজিয়াম তার একটি ছবি কিনে নেয়। সেই কঠিন সময়ে তার মানসিক অবলম্বন ছিলেন নিকোলাস মুরে।
মুরে তাকে ভালোবাসতেন, বিনিময়ে কখনও কিছুই চাননি। লোজানোর মতে, 'আসলে মুরে হয়তো ফ্রিদাকেই বিয়ে করতেন, যদি ফ্রিদার রিভেরাকে ছেড়ে আসার মতো মনের জোর থাকত।'
মুরের বিয়ের খবরে স্তম্ভিত হয়ে যান ফ্রিদা। কারণ তখন তিনি 'দ্য ড্রিম (দ্য বেড)' ছবিটি শেষ করার খুব কাছাকাছি। বছরের পর বছর মুরে তাকে যে মানসিক ও আর্থিক সহায়তা দিয়েছেন, তার কৃতজ্ঞতা হিসেবেই ছবিটি তাকে উপহার দিতে চেয়েছিলেন ফ্রিদা।
ছবিটি মুরের কাছে না পাঠানোর জন্য মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছিলেন ফ্রিদা। লোজানোর মতে, ১৯৩৯ সালে ফ্রিদা মুরেকে জানিয়েছিলেন যে টাকার খুব প্রয়োজনে তিনি ছবিটি মেক্সিকো সিটির একটি গ্যালারিতে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়েছেন। লোজানো এই মিথ্যার প্রমাণও দিয়েছেন। তিনি বলেন, ফ্রিদা মুরেকে চিঠিটি লিখেছিলেন ১৯৩৯ সালে, অথচ ক্যানভাসে ছবির তারিখ দেওয়া ১৯৪০। অর্থাৎ, যখন তিনি মুরেকে ছবিটি বিক্রি করে দেওয়ার কথা লিখেছিলেন, তখন আসলে ছবিটির কাজই শেষ হয়নি।
লোজানো মনে করেন, ফ্রিদা চাননি ছবিটি মুরের হাতে পৌঁছাক। কারণ যে কৃতজ্ঞতা আর ভালোবাসা মিশিয়ে তিনি ছবিটি আঁকছিলেন, মুরে আর তার দাবিদার রইলেন না। গবেষণায় দেখা গেছে, মুরেকে মিথ্যা বলে ফিরিয়ে দেওয়ার পরও ফ্রিদা তার আমেরিকান সংগ্রাহক বন্ধুদের কাছে মাত্র ৪০০ ডলারে ছবিটি বিক্রি করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন।
শেষ পর্যন্ত ছবিটি মিসরাচি গ্যালারিতেই উঠেছিল। সেখান থেকে লুইস ডি হোয়োস নামের এক ব্যক্তি এটি কিনে নেন। এই ব্যক্তি সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানা যায় নি।
এই লুইসের হাত ধরেই ছবিটি মেক্সিকোর সীমানা পার হয়। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে তার মৃত্যুর পর ছবিটি নিলামের জন্য সথবি'সের কাছে হস্তান্তর করা হয়। বাকিটা ইতিহাস। ১৯৮০ সালের ৯ মে ছবিটি এক ব্যক্তিগত ক্রেতা কিনে নেন। এরপর দীর্ঘ ৪৫ বছর লোকচক্ষুর আড়ালে ছিল ছবিটি। গত ২০ নভেম্বর এটি আবারও প্রকাশ্যে আসে। আর ফিরে এসেই বিশ্বরেকর্ড গড়ে প্রমাণ করল, মেক্সিকান এই শিল্পীর জাদুকরী আবেশ আজও বিশ্বজুড়ে অটুট।
নারীদের আঁকা ছবির এমন আকাশছোঁয়া দামে বিস্মিত নন সথবি'সের লাতিন আমেরিকান আর্ট বিভাগের পরিচালক আনা ডি স্ট্যাসি। তিনি বলেন, 'গত এক দশক ধরেই আমরা দেখছি শিল্পকলার বাজারে নারীদের, বিশেষ করে লাতিন আমেরিকান নারীদের অবস্থান শক্ত হচ্ছে। ১৫ বছর আগে যে দাম চিন্তাও করা যেত না, এখন সেটি বাস্তব।'
এমআই