ডাঃ নুসরাত সুলতানা :
বিশ্বজুড়ে কোভিড-১৯ বিরোধী ভ্যাক্সিনের প্রয়োগ বৃদ্ধি পাওয়ায় সাধারণ মানুষের মনে কিছু যৌক্তিক প্রশ্ন আসে। এই প্যান্ডেমিকের শেষ কোথায়? আমরা কি হার্ড ইমিউনিটি শিঘ্রই অর্জন করে ফেলবো?
প্যান্ডেমিকের প্রথম বছর ধারনা করা হয়েছিল যে ৬০-৭০% মানুষ টিকা গ্রহন বা কোভিডে আক্রান্ত হলে হার্ড ইমিউনিটি অর্জন করা সম্ভব। দ্বিতীয় বছরেই এই ধারনা পরিবর্তিত হয়। ভ্যাক্সিন গ্রহণে দ্বিধা, নতুন নতুন ভ্যারিয়েন্টের আবির্ভাব এবং শিশুদের টিকা প্রয়োগে বিলম্বের কারণে হার্ড ইমিউনিটি অর্জন করা কঠিন হয়ে পড়েছে। বিশেষজ্ঞরা হার্ড ইমিউনিটির প্রত্যাশার চেয়েও নিউ নরমাল জীবনে অভ্যস্ত হওয়াকে অধিকতর প্রাধান্য দিচ্ছেন।
হার্ড ইমিউনিটি অর্জন করা কঠিন কেনঃ
• কোন একটি নির্দিষ্ট স্থানে যদি ৮০% মানুষ একটি নির্দিষ্ট সংক্রামক রোগের বিরুদ্ধে টিকা প্রদান বা উক্ত রোগে আক্রান্ত হওয়ার মাধ্যমে ইমিউনিটি বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন করে, তাহলে বাকী ২০% মানুষ (যাদের কখনো উক্ত সংক্রামক রোগটি হয়নি) ও উক্ত সংক্রামক রোগের জীবানুর মাঝে এই ৮০% মানুষ বাধা হিসেবে কাজ করে রোগটির ট্রান্সমিশন চেইন ভেঙ্গে দেয়। একেই হার্ড ইমিউনিটি বলে। কোভিড-১৯ বিরোধী প্রতিটি টিকার ক্ষেত্রেই টিকা গ্রহনের পরও মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে, একে বলা হয় Breakthrough infection. ফলে কোভিড-১৯ এর ট্রান্সমিশন চেইন ভাঙ্গা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। তবে আশার কথা, টিকা গ্রহন করার পর আক্রান্তের হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ও মারাত্মক কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা কমে যায়।
• বিশ্বের বিভিন্ন দেশে, এমনকি একই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে টিকা বন্টন সমভাবে হচ্ছেনা।বিষয়টি ব্যাখ্যা করা যায় এভাবেঃ ধরা যাক, ঢাকা শহরে ৮০% মানুষকে কোভিড-১৯ বিরোধী টিকা প্রয়োগ করা হয়েছে। কিন্তু চট্টগ্রামে টিকার কভারেজ মাত্র ১০%। এক্ষেত্রে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় Population mixing এর কারনে ঢাকা শহরে হার্ড ইমিউনিটি অর্জন করা সম্ভব হবেনা। হার্ড ইমিউনিটি অর্জনের জন্য দ্রুতগতিতে সমভাবে টিকা বন্টন অন্যতম শর্ত। এছাড়াও শিশুদেরকে টিকা কার্যক্রমের বাইরে রাখা হলে হার্ড ইমিউনিটি অর্জন করার নিশ্চয়তা থাকছেনা।
• ভ্যাক্সিনেশন প্রক্রিয়া শ্লথ হলে এবং অসমভাবে বন্টিত হলে সিলেকশন প্রেশারের কারণে নতুন নতুন স্ট্রেইনের আবির্ভাব ঘটবে যা পুরাতন ভ্যারিয়েন্টের চেয়েও অধিক সংক্রামক হতে পারে। ফলে হার্ড ইমিউনিটি অর্জন করা সম্ভব হবেনা।
• অনেক সময় ভ্যাক্সিন গ্রহনকারীদের মাঝে মাস্ক পরা, সামাজিক দূরত্ব মেনে চলায় ঢিলেমি দেখা দেয়। তারা হয়তোবা মারাত্মক কোভিডে আক্রন্ত হবেননা, কিন্তু বাহক হিসেবে অন্যদের আক্রান্ত করতে পারেন। এক্ষেত্রে কোভিড-১৯ এর ট্রান্সমিশন চেইন ভাঙ্গা কঠিন হয়ে পড়ে।
মোদ্দাকথা, টিকা গ্রহনের মাধ্যমে পুনঃসংক্রমন ঠেকানো সম্ভব না হলেও মানুষ মারাত্মক কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হওয়ার আশংকা এবং হস্পিটালাইজেশন দুটোই কমে যাবে। ফলে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে ব্যপক সংখ্যক জনগনকে টিকাদান কার্যক্রমের আওতায় নিয়ে আসতে হবে।
হার্ড ইমিউনিটির আশা করার পরিবর্তে মানুষকে নিউ নরমাল জীবনে অভ্যস্ত হতে সচেষ্ট হতে হবে। অর্থাৎ মানুষকে মাস্ক পরিধান, সাবান দিয়ে হাত ধোয়া ও অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণকে জীবনের অংশ হিসেবে মেনে নিতে হবে।
এভাবেই কোভিড-১৯ একদিন মানুষের সম্মিলিত ও সমন্বিত প্রচেষ্টার কাছে পরাভূত হবে।
লেখক :
ডাঃ নুসরাত সুলতানা
সহকারী অধ্যাপক
ভাইরোলজী বিভাগ
ঢাকা মেডিকেল কলেজ