ডা. মোহাম্মদ মাসুমুল হক :
কোভিড ১৯ সংক্রমণ প্রতিরোধে এখন পর্যন্ত অন্যতম কার্যকরী ব্যবস্থা হচ্ছে টিকা বা ভ্যাক্সিন। ইতিমধ্যে আমাদের দেশে সরকার গণটিকা প্রদান কার্যক্রম শুরু করেছেন, যা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। টিকা প্রদান কার্যক্রমে অংশগ্রহণে বর্তমানে বাংলাদেশের জনগণের মাঝে ব্যপক আগ্রহ তৈরি হয়েছে, যা অবশ্যই একটি ইতিবাচক দিক। কিন্তু এরপরো অনেকেই এখনো রয়েছেন নানা সংশয়ে। আর এদের মাঝে সবচেয়ে বেশি দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছেন ক্যান্সার আক্রান্ত রোগী ও তাঁদের পরিবার।
আমেরিকান ক্যান্সার সোসাইটি, ন্যাশনাল কম্প্রিহেনসিভ ক্যান্সার নেটওয়ার্ক (এনসিসিএন), ইউরোপিয়ান সোসাইটি অব মেডিকেল অনকোলজি (ইএসএমও), সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল (সিডিসি) এর মতো আন্তর্জাতিক সংস্থা ক্যান্সার রোগীদের কোভিড ১৯ টিকা গ্রহণে নির্দেশিকা তৈরি করেছে এবং টিকা গ্রহণের উপর বিশেষভাবে জোর দিয়েছে।
আসুন, কোভিড ১৯ এর টিকা সংক্রান্ত ক্যান্সার রোগীদের সাধারণ কিছু প্রশ্নের উত্তর জেনে নেওয়া যাক—
★ ক্যান্সার রোগীরা কোভিড ১৯ এর টিকা নিতে পারবে কি?
উত্তরঃ অবশ্যই নিতে পারবে,এবং বিশেষ বিবেচনায় প্রাপ্যতার ভিত্তিতে দ্রুত টিকা নেয়া উচিত।
★ ক্যান্সার চিকিৎসা চলাকালীন সময়ে টিকা নেয়া যাবে কিনা?
উত্তরঃ সব ধরনের ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগী চিকিৎসার যেকোনো সময়েই টিকা নিতে পারবেন। তবে এক্ষেত্রে যারা কেমোথেরাপি পাচ্ছেন তাদের টিকা গ্রহণ ও কেমোথেরাপির মাঝে অন্তত ০৭ দিনের একটি বিরতি রাখা নিরাপদ।
যেসব ক্যান্সার রোগীর অস্ত্রোপচার দরকার হচ্ছে, তাঁরা অস্ত্রোপচারের পর কিছুদিন অপেক্ষা করেই টিকা নিতে পারবেন।
আর যারা রেডিও থেরাপি নিচ্ছেন তারা চিকিৎসার যেকোন সময়েই টিকা নিতে পারবেন।
(তবে রোগীর স্বাস্থ্যগত অবস্থা, কোন পর্যায়ের ক্যান্সার, চিকিৎসা ও তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার মাত্রার উপর ভিত্তি করে ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ টিকা নেয়ার সময় পরিবর্তন করতে পারেন। তাই টিকা নেয়ার পূর্বে সংশ্লিষ্ট ক্যান্সার চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে নিবেন।)
★ ব্লাড ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীর টিকা নেয়ার ক্ষেত্রে কি করণীয়?
উত্তরঃ ব্লাড ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীদের মাঝে যাদের কেমোথেরাপি চলছে, তাদের রক্তে শ্বেতকণিকার পরিমাণ ঠিক থাকলে টিকা নিতে পারবেন। তবে যাদের বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট (অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন) হয়েছে বা সেলুলার থেরাপি চলছে, তারা ট্রান্সপ্লান্টের বা সেলুলার থেরাপির তিন মাস (এনসিসিএনের মতে) বা ছয় মাস (ইএসএমওর মতে) পরে টিকা নিতে পারবেন।
★ টিকা নিলে ক্যান্সার রোগীর ক্ষতির আশংকা কতোটুকু?
উত্তরঃ কোভিড-১৯–এর টিকা নিরাপদ। যেহেতু ক্যান্সার রোগীদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, তাই সুস্থ মানুষের তুলনায় ক্যান্সার রোগীদের মাঝে টিকার কার্যকারিতা কিছুটা কম হতে পারে, তবে ক্ষতির কোন সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
★ ক্যান্সার রোগীর ক্ষেত্রে তো এই টিকার ট্রায়াল নেই, সেক্ষেত্রে এটি নিরাপদ তা কিভাবে নিশ্চিত হতে পারি?
উত্তরঃ এই তথ্যটি পুরানো ও আংশিক সত্য। শুরুতে ট্রায়ালে ক্যান্সার রোগীদের যুক্ত না করা হলেও বর্তমানে অনেক জায়গাতেই টিকা গ্রহণ করা ক্যান্সার রোগীদের উপর চালানো জরিপে দেখা গেছে টিকা গ্রহণের ফলে তাদের মাঝে পর্যাপ্ত এন্টিবডি তৈরি হয়েছে।
★ ক্যান্সার রোগীর ক্ষেত্রে টিকার বিশেষ কোন পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া রয়েছে কি?
উত্তরঃ কোভিড ১৯ টিকা গ্রহণে সবার ক্ষেত্রেই কম বেশী সাধারণ কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছে, যা স্বাভাবিক বলেই ধরা হয়। যেমনঃ টিকা প্রয়োগের জায়গায় ফুলে যাওয়া, সামান্য জ্বর হওয়া, বমি বমি ভাব, মাথাব্যথা ও শরীরের ব্যথা সহ ক্লান্তি ইত্যাদি, যা দুই এক দিনের মাঝেই ভালো হয়ে যায়। এর বাইরে ক্যান্সার রোগীদের জন্য আলাদা কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কথা এখন পর্যন্ত সেভাবে জানা যায় নাই।
★ দেশে বর্তমানে কোভিডের কয়েক ধরণের টিকা রয়েছে, ক্যান্সার রোগীর জন্য কোন টিকাটি ভালো হবে?
উত্তরঃ প্রতিটি টিকাই মানসম্মত এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদিত, তাই আপনার নির্ধারিত টিকাদান কেন্দ্রে যে টিকা দেয়া যাচ্ছে তাই গ্রহণ করুন।
★ রোগীর সেবা দানকারী ক্ষেত্রে কি টিকা নেয়া জরুরি?
উত্তরঃ জরুরি, কারণ তিনিই বেশীরভাগ সময় রোগী খুব কাছাকাছি থাকেন।
★ ক্যান্সার সার্ভাইভারদের ক্ষেত্রে টিকা নেয়ার কি নির্দেশনা রয়েছে?
উত্তরঃ ক্যান্সার সার্ভাইভার অন্যান্য সুস্থ্য মানুষের মতোই টিকা নিবেন। এক্ষেত্রে আলাদা কোন নিয়মের কথা সেভাবে উল্লেখ নেই। তবে আপনার কোন প্রশ্ন থাকলে আপনার ক্যান্সার চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করে নিবেন।
★ ক্যান্সার রোগীদের জন্য টিকা কি শুধু মাত্র জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালেই দেয়া হয়?
উত্তরঃ একদমই তা নয়। আপনার নিকটস্থ যেকোন টিকা দান কেন্দ্র থেকেই আপনি এই টিকা গ্রহণ করতে পারেন।
ক্যান্সার রোগীর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অন্যদের চেয়ে কম হয়ে থাকে। তাই তারা সহজেই করোনা ভাইরাস সহ নানা ধরনের সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। এবং এক্ষেত্রে কোভিড ১৯ এ আক্রান্ত হলে তাদের মধ্যে মৃত্যু ঝুঁকি বেশী। তাই ক্যান্সার রোগীদের দ্রুত অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কোভিড-১৯ টিকা নেওয়া উচিত।
লেখক : ডা. মোহাম্মদ মাসুমুল হক
(এমবিবিএস, এমপিএইচ ইন এনসিডি)
ক্যান্সার প্রতিরোধ চিকিৎসক
প্রতিষ্ঠাতা ও মহাসচিব
ক্যান্সার এওয়ারনেস ফাউন্ডেশন অফ বাংলাদেশ