মোঃ সাব্বির হোসেন: রাজবাড়ী জেলার নামকরণ যে কোন রাজার বাড়ির নামানুসারে করা হয়েছে এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। তবে কখন ও কোন রাজার সময়কাল থেকে রাজবাড়ী নামটি এসেছে তার সুনির্দিষ্ট ঐতিহাসিক তথ্য পাওয়া দুষ্কর। বাংলার রেল ভ্রমণ পুস্তকের (এল.এন.মিশ্র প্রকাশিত ইস্ট বেঙ্গল রেলওয়ে ক্যালকাটা ১৯৩৫) একশ নয় পৃষ্ঠায় রাজবাড়ী সম্বন্ধে যে তথ্য পাওয়া যায় তাতে দেখা যায়, ১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দে নবাব শায়েস্তা খান ঢাকায় সুবেদার নিযুক্ত হয়ে পর্তুগীজ জলদস্যুদের দমনের জন্যে তিনি সংগ্রাম শাহকে এই অঞ্চলের নাওয়ারা প্রধান করে পাঠান। তিনি বানিবহতে স্থায়ীভাবে বসবাস করতেন এবং লালগোলা নামক স্থানে দুর্গ নির্মাণ করেন। এই লালগোলা দুর্গই রাজবাড়ীর কয়েক কিলোমিটার উত্তরে বর্তমান লালগোলা গ্রাম।
সংগ্রাম শাহের রাজ কারবার বা রাজকাচারী ও প্রধান নিয়ন্ত্রনকারী অফিস বর্তমান রাজবাড়ী এলাকাকে কাগজে কলমে রাজবাড়ী লিখতেন। সেখান থেকে রেলওয়ে স্টেশন হিসেবে রাজবাড়ী নামটি লিখিত পাওয়া যায়। নাওয়ারা চৌধুরীগণের বাড়ি স্বদেশীগণের নিকট রাজবাড়ী নামে অভিহিত ছিল। মতান্তরে রাজা সূর্য কুমারের নামানুসারে রাজবাড়ীর নামকরণ হয়। রাজা সূর্য কুমারের পিতামহ প্রভুরাম নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার রাজকর্মচারী থাকাকালীন কোন কারণে ইংরেজদের বিরাগভাজন হলে পলাশীর যুদ্ধের পর লক্ষীকোল এসে আত্মগোপন করেন। পরবর্তী বংশধর রাজা সুর্য কুমার ১৮৮৫ সালে জনহিতকর কাজের জন্য রাজা উপাধি প্রাপ্ত হন। রাজা সূর্য কুমার ও তার পূর্ব পুরুষগণের লক্ষীকোলের বাড়িটি লোকমুখে রাজার বাড়ি বলে সমাধিক পরিচিত ছিল। এভাবেই আরো জানা অজানা অনেক ইতিহাস নিয়ে আজকের রাজবাড়ী।
অবিভক্ত ভারতে ভৌগলিক ও প্রশাসনিক কারণে থানা ও মহকুমার আন্তঃসমন্বয় ঘটেছে বারবার। ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টার কর্তৃক ১৮৭৭ সালে প্রকাশিত 'অ্যা স্ট্যাটিস্টিক্যাল একাউন্ট অফ বেঙ্গল (ভলিউম-৫)' পর্যালোচনায় দেখা যায়, ফরিদপুর সদর ও গোয়ালন্দ মহকুমা দুটির সমন্বয়ে ছিল ফরিদপুর জেলা এবং গোয়ালন্দ, বেলগাছি ও পাংশা এই তিনটি থানার সমন্বয়ে ছিল গোয়ালন্দ মহকুমা (সাব-ডিভিশন)।
১৯২৩ সালে প্রকাশিত বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার (ফরিদপুর) অনুসন্ধানে দেখা যায়, ফরিদপুর সদর, গোয়ালন্দ, গোপালগঞ্জ ও মাদারীপুর—এই চারটি মহকুমার (সাব-ডিভিশন) সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে ফরিদপুর জেলা। আর গোয়ালন্দ ঘাট, পাংশা, বালিয়াকান্দি ও গোয়ালন্দ—এই চারটি থানার (উপজেলা) সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে গোয়ালন্দ মহকুমা (সাব-ডিভিশন)। গোয়ালন্দ মহকুমার সর্বমোট আয়তন ছিল তখন ৪৪৩ বর্গ মাইল এবং জনসংখ্যা ৩,২৮,২১৯ জন। আর গোয়ালন্দ ঘাটের আয়তন তখন ৫০ বর্গমাইল এবং জনসংখ্যা ৪৩,২৮৬ জন। মহকুমা সদর দপ্তর ছিল গোয়ালন্দ থানা।
দ্বিতীয় বিপ্লবের অংশ হিসেবে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশের মাধ্যমে ১৯৭৫ সালের ২১শে জুন প্রশাসনিক সংস্কারের মাধ্যমে বাংলাদেশে সর্বপ্রথম তৎকালীন ১৯টি মহাকুমাকে ভেঙে ৬১টি জেলা ঘোষণা করেন এবং ১৬ই জুলাই প্রত্যেক জেলায় একজন করে জেলা গভর্ণর নিয়োগ দেন। তারই অংশ হিসেবে গোয়ালন্দ মহাকুমাকে রাজবাড়ী জেলা ঘোষণা করা হয়, যার গভর্ণর নিয়োগ দেন মরহুম আব্দুল ওয়াজেদ চৌধুরীকে। গোয়ালন্দ-রাজবাড়ী সংসদীয় এলাকায় সেই সময় এমপি ছিলেন ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে নির্বাচিত ডাক্তার এস এ মালেক। বঙ্গবন্ধুর আমলে এবং তার সাহসী পদক্ষেপে সেটাই ছিল প্রথম প্রশাসনিক সংস্কারের প্রচেষ্টা। পরবর্তীতে ১৫ই আগষ্টের দু:খজনক ও মর্মান্তিক ঘটনার পর পরবর্তী সরকার সেই জেলাগুলোকে পুনরায় মহাকুমায় রূপান্তরিত করেন।
এরপর ১৯৮৪ সালের ১লা মার্চ তৎকালীন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ তাঁর করা প্রশাসনিক সংস্কারের মাধ্যমে দেশের সবগুলো মহাকুমাকে ভেঙে ৬৪টি জেলা ঘোষণার অংশ হিসেবে গোয়ালন্দ মহাকুমাকে রাজবাড়ী জেলা হিসেবে ঘোষণা করেন। তখন দেশে কোন পার্লামেন্ট ছিল না বিধায় রাজবাড়ী-গোয়ালন্দ সংসদীয় এলাকায় কোন এমপি ছিলেন না। ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে নির্বাচিত সাবেক সাংসদ ছিলেন মরহুম এ্যাডভোকেট এবিএম গোলাম মোস্তফা।
সময় জার্নাল/এমআই