জাপানিদের বর্ণমালায় বিরাট এক ঝামেলা আছে। দশটার মত ব্যঞ্জনবর্ণ কে ৫ টি স্বরবর্ণ দিয়ে ৫০ রকমের উচ্চারণ করে। উচ্চারণ আসলে ঐ ১০ টিই। কতবড় সীমাবদ্ধতা। ইংরেজি ভাষায় রোমান হরফের ২৬ বর্ণের মধ্যে ৫ টি ভাওয়েল। কত রকম উচ্চারণ সম্ভব। আর বাংলায় আছে ৩৯ টা ব্যঞ্জন বর্ণ, ১১ টা স্বরবর্ণ।
(১) আমি তো জাপানিদের বলতাম, আরে বাবা একটা মানুষ যা যা উচ্চারণ করতে পারে বাংলায় আমরা সবই লিখতে পারি। শুধু মানুষ কেন, পাখির ডাক পর্যন্ত আমি লিখে দিতে পারি।
এখন যৌবন যার
চাপা মেরে বড়াই করা তার শ্রেষ্ঠ সময়
দেশকে নিয়ে কত ধরনের চাপা মেরেছি। অপ্রয়োজনীয় জায়গায় বড়াই করেছি। জাপানিরা তেমন এক্সপ্রেশন দিতো না। তাই চাপা গুলো চাপাই থেকে যেত। আমার ভাষা জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা টুকু টের পেয়েছি অনেক পরে।
(২) কথায় কথায় জাপানিদের ইংরেজি নিয়ে হাসাহাসি করেছি। আমাদের যে ইংরেজি শিক্ষক ছিলেন, ক্লাসে ওনাকে একটু বিরক্তের মতই করেছি। কথায় কথায় প্রশ্ন করতাম। সেই প্রশ্ন জানার জন্য নয়, বাহাদুরি করার জন্য। এই অভ্যাসটি পেয়েছি আমার স্কুল কলেজ থেকে। জাপানি ছেলেরা মুখ বন্ধ করে সব সহ্য করে গেছে।
(৩) একদিন পুরনো কায়দায় ছাত্রাবাসে ফোন দিলাম। ছাত্র নয়, ধরলেন একজন শিক্ষক। আমি ইংরেজিতে আশিরু সানকে চাইলাম। স্যার আমার কণ্ঠ শুনে আমাকে চিনে ফেললেন। আমি ফোন রেখে দিলাম।
আরেকজন ইংরেজি শিক্ষকের কথা বলছি। ওনার নাম কাতাওকা। ওনার সাথে যাচিয়ে ইংরেজি বলতাম। ওনার ইংরেজি উচ্চারণ অনেক পরিষ্কার। কথায় কথায় বলতাম, স্যার আপনার উচ্চারণ তো অনেক ভাল, অন্যান্য জাপানিদের এই অবস্থা ক্যান? জাপান এতো কিছুতে এগিয়ে গেছে, ইংরেজিতে আর একটু মনোযোগ দিলে হতো না?
একদিন আমাকে ডাকলেন। ওনার অফিসে। আমাকে এক পৃষ্ঠা ইংরেজি ধরিয়ে দিলেন। বললেন, রিডিং পড়ো।
আমি পড়ছি। উনি নোট নিচ্ছেন।
আমি পড়েই যাচ্ছি, অনেকটা News at Ten এর সংবাদ পাঠকের মত করে।
পড়া শেষ হবার পর ভদ্র ভাবে বললেন, ইংরেজির উচ্চারণ একেক দেশে একেক রকম হতেই পারে। তবে একটা স্ট্যান্ডার্ড আছে।
-জ্বি।
আমি ৪ বছর আমেরিকা তে পড়াশুনা করেছি। ইংরেজি ভাষাতত্ত্ব নিয়ে।
-জানি, স্যার।
সেই দৃষ্টিকোণ থেকে বলছি তোমার উচ্চারণ স্ট্যান্ডার্ড ইংরেজির উচ্চারণ থেকে কত দুরে। তোমার উচ্চারণে আমি যে ভুলগুলো পেয়েছি, সেগুলোর কথা বলি।
Ear আর Year উচ্চারণ গুলিয়ে ফেলেছো।
Heart আর hurt এর উচ্চারণ এক নয় রে বাবা।
Won এর উচ্চারণ Own এর মত নয়, One এর মত।
The এর উচ্চারণ কখন “দি” আর কখন “দ্যা” হয় সেই রুল মেনে চলো নি।
শুধু তোমার নয়, আমেরিকা তে বাংলাদেশের আরো চারজন ছাত্রকে আমি চিনতাম। একজন ছাড়া বাকি তিন জনেরই একই অবস্থা। তোমাদেরকে ইংরেজি উচ্চারণ কারা শেখায়?
vegetable এর উচ্চারণ ভেজটেবল। veg(e)table, মাঝখানের (e) এর উচ্চারণ করতে নেই।
comfortable এর উচ্চারণ কম্ফটেবল। comf(or)table মাঝখানের (or) এর উচ্চারণ করতে নেই।
Bear এর উচ্চারণ বিয়ার নয়, বেয়ার।
almond, salmon এর উচ্চারণে (l) নেই। এটা সঠিক হয়েছে।
আমি চুপ হয়ে গেলাম। উনি এসব কী বলছেন? জাপানিরা আমার ইংরেজির উচ্চারণ ভুল ধরছে?
নিজের ভুল কীভাবে স্বীকার করতে হয় দেশে সেই অভ্যাসটুকু গড়ে ওঠেনি।
বাংলাদেশে আমরা গ্রামার শিখেছি। রচনা মুখস্ত করেছি। চিঠি লিখতে শিখেছি। ইংরেজিতে কথা বলতে শিখিনি। উচ্চারণ শিখিনি। সিলেবল কখনো পরীক্ষায় আসেনি।
সাত দিন পরের কথা। বললেন, ইংরেজি তোমার জন্য যেমন বিদেশি ভাষা আমার জন্য ও তাই। আমাদের ভাষা তে সমস্যা থাকতেই পারে, তাই না? আমার উচ্চারণ ও খুব একটা ভাল নয়। চলো আমরা একসঙ্গে ইংরেজি শিখি। এটা উনার বিনয়ের ভাষা। মনের কথাটি হলো,
"এদিকে আয় বান্দর, দুই পৃষ্ঠা ইংরেজি জেনে জাপানিদের ইংরেজির ভুল ধরস, তোর নিজের ইংরেজির কী অবস্থা আগে দ্যাখ রে গুল বাহাদুর। "
সেই দিন থেকে প্রতি বুধবার লাঞ্চ আওয়ারে আমরা দুজন ইংরেজির উচ্চারণ শেখা শুরু করলাম। মাঝখানে আরো ৪ জন জাপানি ছেলে মেয়ে যুক্ত হলো। একটা ক্লাব তৈরি হলো। ক্লাবের নাম ইংলিশ স্পিকিং ক্লাব। টিভিতে প্রতিরাতেই ইংরেজি শেখায় সেটা দেখি, রেডিও তে শেখায়, সেগুলো শুনি।
একসময় আবিষ্কার করলাম ৩৯ ব্যঞ্জনবর্ণ আর ১১টি স্বরবর্ন দিয়ে ঠিকমত Thank you র Th উচ্চারণটিই লিখতে পারিনা। V এর উচ্চারণ ভ দিয়ে করতাম। সামান্য Bird, Her এর উচ্চারণ বাংলায় লিখতে পারিনা। চাইনিজ ভাষার একই বর্ণের চার উচ্চারণ দুরের কথা।
গ্রাজুয়েশন শেষে আমি স্যারের সাথে দেখা করতে গেলাম। আমি একটা ডায়েরিতে সবার কাছ থেকে Wish নিচ্ছিলাম। উনি লিখলেন,
You are one of the best students I have ever taught. ….
সাথে কিছু বাণী দিলেন। বাংলায় তার মানে হবে এমন-
বাছা, আমরা যা জানি তা পরিমাপ করা সম্ভব। তা একটা বাউন্ডারির মধ্যে সীমাবদ্ধ। কিন্তু আমরা যা জানিনা তা সীমাহীন। লিমিটলেস। এর কোন বাউন্ডারি নাই। সুতরাং যতটুকু জানি তা নিয়ে বাহাদুরি না করে যাহা জানিনা তা জানার জন্য আগ্রহ তৈরি করো ।
জাপানিদের ইংরেজি নিয়ে কখনো আমার আমেরিকান, বৃটিশ বন্ধুদের ঠাট্টা মশকরা করতে দেখিনি।
মাঝে মাঝে আইফোনে নিজের ইংরেজি রেকর্ড করে শুনি। নিজেকে নিজেই নম্বর দেই। আমার সেই এখলাসপুরি টান গুলো দেখি রয়েই গেছে।
লেখক :
সহযোগী অধ্যাপক, ক্যিউসু ইউনিভার্সিটি, জাপান।