জেসমিন আরা বেগম :
আমাদের ছোটকালে দাঁত নড়ে গেলে বড়রা বলতেন, "হাত দিয়ে নাড়তে থাক"। প্রতিদিন সকাল বিকাল নাড়তে নাড়তে এক সময় দাঁতের গোড়ার শিকড় নরম হয়ে দাঁত আলগা হয়ে পড়ে যেত। মাঝেমাঝে দাঁত নাড়াতে ভয় এবং ব্যথা দুটোই লাগত। মা জোর করে ধরে টান দিলে দাঁত উঠে আসতো। আমরা সেই দাঁত নিয়ে ইঁদুরের গর্তে ফেলে দিতাম আর বলতাম, "ইঁদুর, আমার চ্যাপ্টা দাঁত নিয়ে তোর চিকন দাঁত দে"। এখন ভাবি ভাগ্যিস ইঁদুর সেই বদলাবদলির মহান প্রস্তাবে রাজি হয়নি! ইঁদুরের মত চিকন দাঁত দৃষ্টিনন্দন কিছু হতো বলে মনে হয় না।
আমার নিচের মাড়ির সামনের একটা দাঁত নড়ার পরে নিজে বেশি নাড়াইনি। মা ধরতে আসলে ভয়ে চিৎকার করে ধরতেও দেইনি। ফলে কয়েকদিন নড়েচড়ে দাঁতটা শক্ত হয়ে গেল, আর তার পিছন দিকে আর একটা দাঁত ওঠা শুরু করলো। আব্বা আমাকে পটুয়াখালী একজন দাঁতের ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেন। ডাক্তার দাঁতের গোড়ায় একটা ইঞ্জেকশন দিয়ে একটা কিছু দিয়ে গুতো দিলেন আর দাঁতটা পড়ে গেলো। আমার মনে আছে ডাক্তারকে আব্বা দুই টাকা দিয়েছিলেন। অনেক সময় অনেক প্রয়োজনীয় কথা বা তথ্য মনে থাকে না কিন্তু অনেক বাজে কথা মনে থাকে।
আশির দশকে ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময়ে আমার বান্ধবী গল্প করেছিল আমেরিকাতে না কি দাঁতের চিকিৎসা খুব ব্যয়বহুল। এটা এত বেশী যে ওর ভাই আমেরিকা থেকে দেশে এসে চিকিৎসা করালেও সস্তা পড়ে। আমি কথাটা বিশ্বাস অবিশ্বাস কিছুই করিনি, কি জানি সত্য হলেও হতে পারে।
বেশ কিছুদিন আগের কথা। একদিন আমার মাড়ির একটা দাঁতে শুরু হলো ব্যথা। কথায় বলে, "ভাত জ্বালা সয় দাঁত জ্বালা সয় না"। আমাদের বাসার কাছেই একজন বাংলাদেশি ডাক্তার আছেন, কিন্তু উনি আমার যে ইন্সুয়েরেন্স আছে ওটা নেন না। আমার ডেন্টাল ইনসিওরেন্স আছে, কিন্তু প্রায় কিছুই কভার করে না। আমি অনেক খুঁজে আমার ইন্সুয়েরেন্স নেয় এমন একজন ডক্তারের কাছে গেলাম। অনেকক্ষণ (ঘন্টাখানেক হবে) বসিয়ে রেখে এক্সরে করল টেকনিশিয়ান। আবারো কিছক্ষণ বসে থাকার পরে একজন লেডি ডাক্তার এলো। এক্সরে প্লেটগুলো দেখে সে বলে, "আমি সব রিসেপশানে বলে দিচ্ছি, কথা বলে সবকিছু বুঝে নাও"। বলে ডাক্তার চলে গেলো। আমি যে ব্যথায় কাতর হয়ে তার কাছে গেলাম, সেই ব্যথা নিয়ে সে কিছুই বলল না। আমার কোথায় ব্যথা বা কি সমাচার কিছু জানতে চাইল না, একটু দেখতেও চাইল না। কোন ঔষধও দিলো না। বাংলাদেশের ডাক্তাররা কিছু না হলেও তো পেইনকিলার দিত অন্তত।
রিসিপশনে আসার পরে একজন মেয়ে আমাকে বলল যে আমার যে দাঁতে ব্যথা, সেটাতে পোরসেলিন ফিলিং করাতে হবে। আর ৩/৪ টা দাঁতে রুট ক্যানাল করা লাগবে। আমার নিচের মাড়ির সামনের দুটো দাঁত আলগা (সে লুজ বলেছে), যে কোন সময় পরে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। আমার মন খুব খারাপ হয়ে গেলো, মানুষের বয়স ৭০ বছর বা তার বেশি হলে দাঁত পড়ে আর আমার এত কম বয়সে দাঁত পড়ে যাবে!
এবার সে আমাকে দাঁতের চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন ডাক্তারের কাছে যাওয়ার তারিখ আর টাকার হিসাব দিতে লাগল। যে দাঁতে ব্যথা, তাতে পোরসেলিন ফিলিং করতে লাগবে ১০০০ ডলার । এটার জন্য ডেট দিচ্ছে প্রায়ে ১৫ দিন পরে। তারো ১৫ দিন পরে ডেট দিচ্ছে মাড়ি বিশেষজ্ঞের, যে কিনা পরীক্ষা করে দেখবে আমার ব্যথাওয়ালা দাঁতটা রাখা যাবে না উপড়ে ফেলতে হবে। সেই সঙ্গে আমার নিচের মাড়ির সামনের দুটো দাঁতের ব্যাপারেও ফয়সালা হবে। আমি অবাক হয়ে গেলাম। যদি দাঁত রাখাই না যায়, তাহলে ১০০০ ডলার খরচ করে ফিলিং করব কেন? আমি বললাম, "মাড়ি বিশেষজ্ঞের সাথে সাক্ষাতের তারিখটা আগে দেয়া যায় না? পোরসেলিন ফিলিং করার পরে দাঁত ফেলে দেয়ার তো কোন মানে নেই"।
ওই মেয়ে কি বুঝল কে জানে বলল, "ডাক্তারের অ্যাপোয়েন্টমেন্ট ডেট এভাবে পাওয়া গেছে, তাই এভাবে দিচ্ছি"। মাঝে মাঝে আমার মনে হয় আমেরিকায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক লোক নির্বোধ। সবসহ সে মোট ৫০০০ ডলার খরচের হিসাবের এক তালিকা আমার হাতে ধরিয়ে দিলো। আমার মন খারাপ দেখে মেয়েটা বলল যে আমি চাইলে সহজ শর্তে লোন নিতে পারি, দাঁতের চিকিৎসা করাতে।
পরের দিন আমার বাসার কাছের বাংলাদেশী ডেন্টিস্টের কাছে গেলাম নিজের টাকায় দেখাব বলে। উনি আবারো এক্সরে করে বললেন, "আপনার যে দাঁতে ব্যথা ওটাতে তো ফিলিং আছে, পোরসেলিন ফিলিং করতে বলল কেন বুঝলাম না। ওটাতে ইনফেকশন হয়েছে। আমি ঔষধ দিয়ে দিচ্ছি"।
উনি আমাকে অ্যান্টিবাওটিক দিলেন। আমি খেয়ে ভালো হয়ে গেলাম।
আগে থেকেই আমার বাংলাদেশে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল, আমি ১১০০ ডলার দিয়ে রিটার্ন টিকিট কেটে চলে গেলাম বাংলাদেশে। দেশে এক ডেন্টিস্ট এক্সরে করে যেগুলোতে রুট ক্যানেল করতে হবে বললেন, সেগুলো সব আবার আমেরিকান ডেন্টিস্টের সাথে কমন পড়ল না। আরো দুইজন ডেন্টিস্টের সাথে যোগাযোগ করে শেষ পর্যন্ত একজনকে দিয়ে রুট ক্যানেল করালাম সবসহ হাজার চল্লিশেক টাকা লাগলো। সত্যি আমেরিকা থেকে বাংলাদেশে গিয়ে দাঁতের চিকিৎসা করালে খরচ অনেক কম পড়ে। মেক্সিকান আমেরিকানদের অনেকে মেক্সিকো গিয়ে চিকিৎসা করিয়ে আসে।
আমার এখনকার ডেন্টিস্ট ইন্ডিয়ান (গুজরাটি)। সে দাঁত স্কেলিং আর ফিলিং করা ছাড়া আর কিছু করতে পারে না। দাঁত তুলতে হলে অন্য ডেন্টিস্টের কাছে পাঠায়। আমার একজন কলিগ আমাদের অফিসের অনেককেই তাঁর কাছে পাঠিয়েছে। ডাক্তার বড়দিন উপলক্ষে সেই কলিগকে একটা গিফট কার্ড দিয়েছে। কলিগ মনে করেছে বিশ ডলার হবে। বাসায় গিয়ে দেখে ২০০ ডলারের গিফট কার্ড। কলিগ ডাক্তারকে ফোন করে বলল, "ডাক্তার, এতো টাকার গিফট কার্ড কেন দিয়েছ"?
- তুমি আমাকে এত রোগী পাঠিয়েছ, তাই। এটা অনেক সামান্য গিফট।
ডাক্তার প্রতি বছর আমার কলিগকে গিফট দেয়া ছাড়াও আমাদের অফিসের সবার জন্য চকলেটের প্যাকেট পাঠায়। আমি একদিন বললাম, "ডাক্তার এটা তো তোমার ভালোই বুদ্ধি। আমাদেরকে চকলেট খাওয়াচ্ছ, যেন চকলেট খেয়ে আমাদের দাঁত নষ্ট হয় আর তোমার রোগীর সংখ্যা বেড়ে যায়"।
ডাক্তার বলল, "কি করব, তোমাদেরকে তো আমি ওয়াইন গিফট করতে পারি না! তাহলে আবার ড্রিঙ্ক করে গাড়ি চালানোর অপরাধে জেল, জরিমানা বা এমন কি চাকরিটাও চলে যেতে পারে। তখন আবার আমাকে দোষ দিবা"।
ডাক্তারের জবাব শুনে আমি লাজবাব।
ও আর হ্যাঁ ওই যে রিসিপশনের মেয়েটা বলেছিল যে আমার নিচের মাড়ির সামনের দাঁত দুইটা লুজ বা আলগা বা নড়বড়ে, সেই দাঁত দুইটা এখনো (প্রায় দশ বছর পরেও) বহাল তবিয়তে আছে।
মনে হয় কোন মাড়ি বিশেষজ্ঞের কাছে না যাওয়ার কারণেই উহারা নড়বড়ে হওয়া সত্ত্বেও এক দশক যাবত টিকিয়া আছেন।
লেখক : আমেরিকা প্রবাসী, সাবেক পরিচালক বিপিএটিসি।