শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪

পার্কের অপব্যবহার

শিশু-কিশোরদের ব্যবহার করা হয় ভিক্ষা ও চুরিতে

শুক্রবার, মার্চ ১২, ২০২১
শিশু-কিশোরদের ব্যবহার করা হয় ভিক্ষা ও চুরিতে

সময় জার্নাল প্রতিবেদক : পুরান ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে ঐতিহাসিক বাহাদুর শাহ পার্ক। অভিবাসি ও আশেপাশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের বিনোদনের একমাত্র খোলা জায়গা। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বিশ্রাম, ব্যয়াম, আড্ডাস্থল। এই পার্কই আবার মাদকসেবীদের নিরাপদ আশ্রয়। দিন ও রাতে প্রকাশ্যে গাঁজা, ইয়াবা, ড্যান্ডি সেবন চলে হরদম। আট থেকে আঠারো বছরের নিচের শিশুকিশোররাই মাদকে বেশি আক্রান্ত। উদ্ভাস্তু পথশিশু কিশোররা পার্কের আশেপাশে চকলেট, প্লাস্টিক বিক্রি করে, হাত পেতে রোজগার করেন। আবার সুযোগ পেলেই বাসের জানালা দিয়ে মোবাইল ছিনতাই, মহিলাদের ব্যাগ, কানের দুল টান দিয়ে নেয়ার ঘটনাও ঘটে। 

বাহাদুর শাহ পার্কের উদ্ভাস্তু মাদকসেবি শিশুকিশোররা জানান, তাদের অনেকের বাবা-মা নেই। অনেকের বাবা-মা খোঁজখবর নেয় না। এ সুযোগে একটি চক্র জোর করে এ শিশুকিশোরদের ভিক্ষাবৃত্তি ও চুরির জন্য বাধ্য করে। ভিক্ষা ও চুরি না করলে তাদের ওপর নেমে আসে নির্যাতনের খড়গ। মানসিক ভারসাম্যহীন ও অক্ষম করতে তাদেরকে ড্যান্ডির নেশায় আসক্ত করা হয়। 

বাহাদুরশাহ্ পার্কে বর্তমানে ২০-২৫জন শিশুকিশোর আছে। তাদের মধ্যে কমবয়সী মেয়েও কয়েকজন। অধিকাংশের হাতে প্লাস্টিকের প্যাকেট। প্যাকেটের ভিতরে হলদে রংয়ের একটি বস্তু খানিক পর পর মুখে লাগিয়ে ধোঁয়া টানছে। তাদের ভাষায় এটা আঠা বা ড্যান্ডি। (চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় ‘গ্লু-স্নিফিং’ বা ‘গ্লু-গাম শুকা’। ডান্ডি এক ধরনের গ্লু-গাম বা আঠা জাতীয় উদ্বায়ী পদার্থ যা সাধারণ তাপমাত্রায় সহজেই বাষ্পে বা ধূম্রে পরিণত হয়)। ড্যান্ডি আঠা পলিথিনে তিনভাগের একভাগ লাগিয়ে পলিথিনের মুখ বন্ধ করে মুখ দিয়ে বাতাস টানে আবার ছাড়ে কিছুক্ষণের মধ্যে এই আঠার স্পিরিট  কেমিকেল মস্তিষ্কে আঘাত করে। আর এতে শরীরে ঝিমঝিম অনুভূতি সৃষ্টি করে। আর এভাবেই আঠা  নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ে তারা।

পার্কের পাশে রাস্তায় প্লাস্টিকের প্যাকেট হাতে দাঁড়ানো হৃদয় (১৪) জানান, বাবা মারা যাওয়ায় মা আরেকজনের সংসার করেন। তারা ঢাকার মোহাম্মদপুরে থাকেন। ছোট আরেকটি ভাই আছে। মা ডাকলেও সৎ বাবার কারণে সে বাসায় যায় না। আগে চুরি করত। চুরির পেশা বাদ দিতে চাই সে। কিন্তু চুরি বাদ দেয়ায় কেরাণীগঞ্জের মামুন (২৫) নামের এক ব্যক্তি তার পায়ুপথে ও শরীরের বিভিন্ন  জায়গায় ছুড়িকাঘাত করে। তাকে জোড় করে মহিলাদের ব্যাগ থেকে চুরি করানো হয়। চুরি না করলে আঙুল কেটে নেয়া বা মেরে ফেলার হুমকি দেয় সে। পাশেই কমবয়সী একটি মেয়ের হাতেও ড্যান্ডির প্যাকেট। নাম জিজ্ঞেস করতে দৌঁড়ে পালায় সে। তারা কি কারণে সে মাদক সেবন করছে তারা সেটা জানে না! তাদেরকে জোর করে চক্রটিই ড্যান্ডি খাওয়ানো শিখিয়েছে।

সজিবের (১১) পাঁচ ভাই বোন। বাবা ফরিদপুরে সিএনজি চালায়। মা মিরপুরে বাকি ভাই বোনদের নিয়ে থাকেন। বাহাদুর শাহ পার্কে থাকে। ভিক্ষা করে খায়। পাশে নজরদাড়ির উদ্দেশ্যে শাকিল (১৬) নামে একটি ছেলে। সেই তাদেরকে চুরি করতে বাধ্য করায়। রাস্তা দিয়ে হেটে যাওয়ার সময় টার্গেট দেখিয়ে দিয়ে সে দূরে দাঁড়িয়ে থাকে। সজিবের হাতেও সেই হলদে প্লাস্টিকের প্যাকেট।

সজল (০৯) গুলিস্থানের এক মাদ্রাসায় পড়ে। বাহাদুর শাহ পার্কের একটি চক্র তাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে সেখান থেকে পার্কে নিয়ে আসে। তাকে প্রথমে ড্যান্ডি খাওয়ানো শেখায়। এরপর তাকে দিয়ে ভিক্ষাবৃত্তি ও চুরি করানো হয়। ভিক্ষাবৃত্তিতে কম টাকা পেলে তাকে মারধর করা হয়। আজাদ সিনেমা হলের সামনে থেকে চক্রটি তাকে চক্রের বাসায় নিয়ে যেতে চাইলে সে মারধরের ভয়ে তাদের সাথে না যেতে কান্নাকাটি শুরু করে। এসময় আশেপাশের লোকজন তার কান্নাকাটি শুনে এগিয়ে আসলে সে শুধু তার মায়ের নাম শিউলি বলতে পারে। পরে আশেপাশের লোকজন পুলিশকে খবর দিলে পুলিশ তাকে নিয়ে যায়।

অমিত (১৫) তিন ভাইয়ের মেঝ। বড় ভাই একটি সরকারি হাসপাতালে কাজ করে। সেও মাঝে মাঝে সেখানে যায়। ড্যান্ডির ডিব্বা নিয়ে বসে থাকা এ কিশোর জানান ডিব্বা খুললেই এখনই শেষ হয়ে যাবে। সবাই আকাশে উড়বে। চাঁদ-তারার সাথে খেলা করবে তারা।

মাদকাসক্ত এ শিশুকিশোররা জানান পুরান ঢাকার বিভিন্ন হার্ডওয়ারের দোকান, কেরাণীগঞ্জ, গুলিস্থান থেকে তারা ড্যান্ডি কিনে নিয়ে আসে। ছোট ডিব্বার দাম চল্লিশ টাকা, বড়টার দাম ৯০। ড্যান্ডির সাথে গাঁজা, কেউ কেউ ইয়াবাও সেবন করেন তারা। শিশু কিশোরদের সাথে যুবক ও মধ্যবয়সী মাদকসেবীদের ভিড় থাকে পার্কে। মুলত পার্কে অবস্থানরত কয়েকজন মহিলা ও কেরাণীগঞ্জের কয়েকজনের একটি চক্র এ শিশুকিশোরদের জোর করে মাদক সেবন ও চুরি করিয়ে থাকে।

বাহাদুর শাহ্ পার্কের কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যরা জানান, পার্কে সবসময় এ পথ শিশুরা থাকে। তাদেরকে পুর্নবাসনকেন্দ্রে পাঠানো হলেও তারা আবার ফিরে আসেন। তাদেরকে বিভিন্ন উপায়ে তারা মাদকের পথ থেকে ফিরায় আনতে চেষ্টা করেন তারা। কিন্তু ফেরানো সম্ভব হয় না। 

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ও লাইফ এন্ড আর্থ সাইন্সের সাবেক ডিন অধ্যাপক ড. কাজী সাইফুদ্দিন বলেন, সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন এ পথ শিশুরা সোস্যাল বিহ্যাভিয়ার ও ক্রিমিনাল বিহ্যাভিয়ার বুঝে না। তারা মাদক সেবন ও চুরিকে অপরাধ হিসাবে মনে করে না। আর সবসময়ের জন্য মাদক সেবনের কারণে তারা মানষিকভাবে ভারসাম্যহীন। তারা চুরির মত ছোট ছোট অপরাধ করতে করতে বড় অপরাধে জড়িয়ে পরে। পরবর্তীতে তারা বড় সন্ত্রাসীতে পরিণত হয়। অনেক রাজনৈতিক দলের হাতিয়ার হিসাবেও ব্যবহার হয় তারা।  

লালবাগ জোনের এডিসি হাফিজ আল আসাদ বলেন, পথশিশুদের নিয়ে মুলত কাজ করে সমাজকল্যাণ মন্ত্রনালয়। তবে আমাদের ঊর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনায় পূর্নবাসনের জন্য পথ শিশুদের একটি ডাটা কালেকশন করছি।

সময় জার্নাল/আরইউ 



Somoy Journal is new coming online based newspaper in Bangladesh. It's growing as a most reading and popular Bangladeshi and Bengali website in the world.

উপদেষ্টা সম্পাদক: প্রফেসর সৈয়দ আহসানুল আলম পারভেজ

যোগাযোগ:
এহসান টাওয়ার, লেন-১৬/১৭, পূর্বাচল রোড, উত্তর বাড্ডা, ঢাকা-১২১২, বাংলাদেশ
কর্পোরেট অফিস: ২২৯/ক, প্রগতি সরণি, কুড়িল, ঢাকা-১২২৯
ইমেইল: somoyjournal@gmail.com
নিউজরুম ই-মেইল : sjnewsdesk@gmail.com

কপিরাইট স্বত্ব ২০১৯-২০২৪ সময় জার্নাল