বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪

অর্জুন পুরুষ কবি ফখরুল হুদা হেলাল: প্রবীর বিকাশ সরকার

বুধবার, সেপ্টেম্বর ১, ২০২১
অর্জুন পুরুষ কবি ফখরুল হুদা হেলাল: প্রবীর বিকাশ সরকার

২০১১ সালে আড়াই বছর পর কুমিল্লায় ফিরে গিয়ে কুমিল্লা তথা বাংলাদেশের অন্যতম স্বনামধন্য কবি, সংগঠক এবং নাট্যকর্মী ফখরুল হুদা হেলালের সঙ্গে অন্যরকম ঘনিষ্ঠতা হয়েছে যেটা কোনোদিন আমাদের মধ্যে এরকমভাবে ছিল না। সেবার তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়ে সত্যিই বারংবার স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ছিলাম। তাঁকে দেখার অনেক স্মৃতি, এ যেন অরণ্যের সবুজে চিরুনি চালানো--টুপটাপ করে ঝরে পড়তে থাকে অজস্র রেণু-পাতা-ফুল! 

হেলাল ভাই ১ সেপ্টেম্বর, ১৯৫৩ সালে জন্মগ্রহণ করেন কুমিল্লার তৎকালীন মহকুমা চাঁদপুরের মতলব থানার একলাছপুর গ্রামের মামাবাড়িতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান হিসেবে। 

হেলালভাই আমার চেয়ে সাত বছরের বড়। তাঁর অগ্রজ বিশিষ্ট ছাত্রনেতা, মুক্তিযোদ্ধা এবং বিলুপ্ত সাপ্তাহিক “মাতৃভূমি” পত্রিকার সম্পাদক মাইনুল হুদা দুলাল। তাঁর অনুজ বদরুল হুদা জেনারেল তথা জেনু সকলের প্রিয়ভাজন ক্রীড়া সংগঠক ও সংস্কৃতিকর্মী। তিনি একজন পরিশীলিত বাচনশিল্পীও বটেন। “সচেতন নাগরিক কমিটি” (সনাক) সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা। তিন ভাই-ই আওয়ামী লীগ এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রতি অবিচল শ্রদ্ধাশীল। 

কবি ফখরুল হুদা হেলালের উত্থান মূলত মঞ্চনাটক বা থিয়েটারের অভিনয়শিল্পী হিসেবে সেই উন্মাতাল ১৯৬৯ সালে। যখন আমি মাত্র দশ। অসহযোগ আন্দোলনের সময় তখন। নগর মিলনায়তনের রঙ্গমঞ্চে “পাহাড়িফুল” নাটকে এদেশের প্রতিষ্ঠিত অভিনয় শিল্পীদ্বয় ব্যক্তিজীবনে দুবোন আনোয়ারা ও নার্গিসের সঙ্গে অভিনয় করে প্রশংসিত হয়েছিলেন হেলালভাই। এমনকি, নিজেও শিশু-কিশোরদের জন্য “মণিমালা” নামে নাটক লিখে এবং নির্দেশনা দিয়ে তুমুল আলোড়ন তুলেছিলেন সেই সময়। 

পরবর্তীতে “ত্রিধারা” শিল্পীগোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, “রেঁনেসা নাট্যগোষ্ঠী” এবং “প্রগতি নাট্য সংঘে”র উপদেষ্টাও ছিলেন। ১৯৭৭ সালেই তিনি “প্রতিধ্বনি” নাট্য সংগঠনের নাটক “অভিশপ্ত প্রেম” নাটকে অভিনয় করে শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার লাভ করেছিলেন। ২০০০ সালে পেলেন কুমিল্লার সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন আয়োজিত “কুমিল্লার সাংস্কৃতিক/নাট্য অঙ্গনের গুণীজন সংবর্ধনা ও নাট্যোৎসব-২০০০” এর সম্মাননা স্মারক পদক ও সদনপত্র।  

কাব্যজগতে তাঁর আগমন ঘটে স্বাধীনতার পরপর ১৯৭২ সালে। ১৯৭৪ সালের মে মাসে তিনি অসামান্য একটি কাজ সম্পাদন করেন কুমিল্লায় স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম কবি সম্মেলন এর আয়োজন করে। তখন আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন বিশিষ্ট কবিবৃন্দ যথাক্রমে শহীদ কাদরী, রফিক আজাদ, নির্মলেন্দু গুণ, মুহম্মদ নূরুল হুদা, মহাদেব সাহা, আবু করিম ও আসাদ চৌধুরী। কবি আবুল হাসানের আসার কথা ছিল আসতে পারেননি। আর এসেছিলেন বিশিষ্ট সাংবাদিক মুহম্মদ জাহাঙ্গীর এবং বিদেশ থেকে বিশিষ্ট লেখক মৈত্রেয়ী রায়--যিনি বিখ্যাত মননশীল সাহিত্য সাময়িকী “জিজ্ঞাসা”র সম্পাদক ও গবেষক শিবনারায়ণ রায়ের কন্যা। ভাবাই যায় না কী অসাধ্য সাধন করেছেন হেলালভাই ওই সালেই তাঁর প্রতিষ্ঠিত “সে আমি তুমি” সাহিত্য-সংস্কৃতি সংগঠনের মাধ্যমে! উল্লেখ্য যে, এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক ফখরুল ইসলাম রচি। এই সংগঠনটি বিপুল সাড়া জাগিয়েছিল এবং এর সুনাম কুমিল্লা ছাড়িয়ে রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, ময়মনসিংহ প্রভৃতি শহরেও ছড়িয়ে পড়েছিল। 

এ হেন কবি ফখরুল হুদা হেলালকে আমি দেখি ১৯৭৬ সালের দিকে। তিনি যখন কুমিল্লা শহরের নাভিস্থল বলে পরিচিত কান্দিরপাড়সহ নগর মিলনায়তন, ভিক্টোরিয়া কলেজ ক্যাম্পাস, পৌর উদ্যানে হেঁটে যেতেন বীর দর্পে তখন কেঁপে উঠত চারপাশ তাঁর জলদগম্ভীর অর্জুন-কণ্ঠস্বরের  ধ্বনিতে--আমি তখন নিতান্তই সাদাসিধে এক কিশোরোত্তীর্ণ কলেজ ছাত্র। 

রানীর দিঘিস্থ ভিক্টোরিয়া কলেজের ক্যাম্পাসে মাঝে মাঝে তাঁকে দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতাম আর ভাবতাম: আধুনিক কবিরা তাহলে এমনই হয়! দীর্ঘচুল, খদ্দরের পাজামা-পাঞ্জাবি, পায়ে পাতলা স্যান্ডেল, মুখে ধূমায়িত সিগারেট, রাজার মতো অকুতোভয়, দুর্বিনেয়, আপাদমস্তক চৌকস এবং ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। সে এক দারুণ স্মার্ট কবি ফখরুল হুদা হেলাল! এমন সুদর্শন বাঙালি কবি খুব কমই দেখেছি এই জীবনে আমি। শহরে তাঁকে চিনত না এমন কিশোর-কিশোরী বা তরুণ-তরুণী কেউ ছিল না। নাট্যাভিনয়ের মতো কাব্যচর্চায়ও তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত, এখন আরও ধারালো। তিনি যদি তাঁর সেইসব অম্লমধুর কর্মকাণ্ডের ইতিহাস লিখে রাখতেন তাহলে নিঃসন্দেহে কুমিল্লা শুধু নয়, আঞ্চলিক সংস্কৃতি, সমকালীন ইতিহাস সমৃদ্ধ হত। আঞ্চলিক ইতিহাস সমৃদ্ধ করে জাতীয় ইতিহাসকে। কিন্তু স্পষ্টভাষী হেলালভাই সেই ইতিহাস লিখতে নারাজ, তাহলে অনেকেই গোস্বা করবেন, কারো কারো মুখ চুপশে যাবে বলে বিরত আছেন তবে বলা যায় না লিখে ফেলতেও পারেন। কবিরা কখন কী ভাবেন? কী করে বসেন কেউ বলতে পারে না? শিশুচরিত্র তাদের মধ্যে যে কোনো বয়সেই ক্রীয়াশীল। কবিদের তাই শত্রু নেই, যে কবির শত্রু হবে তার মতো বোকা হদ্দ পৃথিবীতে নেই। কবি অর্থ জ্ঞানী--জ্ঞানীর কি শত্রু আছে? তবে ভণ্ড কবিদের ক্ষেত্রে আলাদা। সত্যিকার কবিরা স্পষ্টভাষী, স্বাধীনচেতা, তাঁরা ভূমিকা পছন্দ করেন না, ভণ্ডামি তো নয়ই। আমরা দেখেছি সামরিক বাহিনীর কেউ কেউ ভণ্ডকবি সেজে বাংলা কবিতাকে লজ্জিত করেছেন। তাজ্জব কী বাত! এসব সামরিক স্বৈরতন্ত্রের সময় একমাত্র বাংলাদেশেই ঘটেছে! কলকাতার সাহিত্য পত্রিকা “দেশ” তার প্রশংসা করে সম্পাদকীয় লিখে পরে নিজেই বোকা মনে গেছে! এইসব ভণ্ডামি হেলালভাই একদম পছন্দ করেন না। তাই ধুরন্ধুর রাজনীতিবিদরাও কবিদের সমালোচনা থেকে রেহাই পান না। যে কারণে রাজনীতিকরা কবিদের ভয় ও সমীহ করে চলেন। কবি ফখরুল হুদা হেলাল তার ব্যতিক্রম নন। এই জন্যই কবিরা জাতির জাগ্রত বিবেক বলে পরিচিত। কবি-সাহিত্যিক-লেখক-শিল্পীবিহীন শহর তাই অন্ধনগর নাহয় মৃত্যুপুরী। প্রকৃত কবিরা শহরের অহঙ্কার ও অলঙ্কার। 

সহজ-সরল-প্যাঁচগোছহীন কোমল স্বভাবের মানুষ কবি ফখরুল হুদা হেলালভাইয়ের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় যখন কুমিল্লা “চাঁদের হাট” শিশু-কিশোর সংগঠনের একটি শাখার সাহিত্য সম্পাদক আমি, জীবনের প্রথম সাহিত্য সংকলন “ঝিলিমিলি” সম্পাদনা করতে গিয়ে তাঁর কবিতা সংগ্রহ করতে যাই ১৯৭৬ সালে। আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন তখনকার আরেক তুখোড় কবি ও গল্পকার সুমন্ত চট্টোপাধ্যায়। তারপর তো দেখা হলেই পারস্পরিক শুভেচ্ছা বিনিময় হত। তবে তাঁর ধারে কাছে ঘেঁষার মতো সাহস ও মেধা কোনোটাই তখন আমার ছিল না। কিন্তু আমার প্রতি তাঁর স্নেহ ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছিল কারণ তিনি জানতেন আমি তখন ছড়া প্রচুর লিখছি কুমিল্লা, ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলার কাগজে, সংকলনে এবং সাময়িকীতে। ছড়া পাঠ করছি বিভিন্ন সাহিত্য সভা ও আসরে। 

এভাবে বেশ কয়েক বছর চলে গেল। হেলালভাই আরও এগিয়ে গেলেন। কবিতায় তিনি আরও কান্তিময় আরও শৌর্যশালী। তাঁর আগে যাঁরা কবিতা লেখা শুরু করেছিলেন তাঁদেরকেও ছাড়িয়ে গেলেন যেন। সর্বত্র, সর্বমহলে তাঁর সুপরিচিতি। সেই সময় যখনই তাঁকে দেখেছি চায়ের দোকানে, মঞ্চে, কবিতা পাঠের আসরে, মাঠেময়দানে, কলেজ ক্যাম্পাসে, রাস্তায় তাঁর কণ্ঠে কবিতা ছাড়াও হঠাৎ হঠাৎ একটি ধ্বনি চমকে দিত আমাদেরকে! সমস্ত গুঞ্জনকে থামিয়ে দিত চকিতে তা হল: “হরিই ই ই ই...!” 

এটা আসলে একটি দীর্ঘ শ্লোক, এখানে আর উল্লেখ করলাম না তবে আমার লিখিত আত্মজৈবনিক উপন্যাস “অতলান্ত পিতৃস্মৃতি”তে আছে। এটা মূলত গঞ্জিকাসেবকদের আড্ডা বা আখড়ার মন্ত্র। হেলালভাই তো বটেই তখন অনেক তরুণ কবি, সাহিত্যিক, নাট্যকর্মীর কাছে দারুপান এবং গঞ্জিকাসেবন ছিল ডালভাতের মতো সহজ ব্যাপার। আমরাও কয়েকজন বন্ধু এই পথে অনেক দূর হেঁটে চলে গিয়েছিলাম। মাঝে মাঝে বিপর্যস্ত, এলোমেলো হয়ে হেলালভাইদের মুখোমুখি হয়ে পড়িনি তা নয়, নীরবে ছিটকে সরে গেছি। কোনোদিন বড়দের সামনে সিগারেট পর্যন্ত টানিনি। অনেকেই টানত। তখন সময়টা কী রকম ছিল তাও দেখতে হবে। বড্ড বাজে সময় বাংলাদেশের ইতিহাসে। সামরিক স্বৈরতন্ত্র, রাজনৈতিক অস্থিরতা, শিক্ষাঙ্গনে অস্ত্রবাজি, সন্ত্রাস, দুর্নীতি, আন্দোলন, গুম, হত্যা, হরতাল, মিছিল--জাতির আশার আলো কোথাও নেই। সর্বত্র ভাঙচুর, অবক্ষয়, অবনতির করাল গ্রাসে বিপর্যস্ত কিশোর ও তরুণ সমাজ। এই সময়টা আমাদের জীবনস্মৃতি থেকে কখনোই মুছে ফেলবার মতো নয়। বিশেষ করে, আমার জীবনে ১৯৭৬ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত আপাদমস্তক অস্থির মাতাল বেদনাবিধুর কখনো কখনো বড় দুঃসহ সেই সময়টা। 

তখন কুমিল্লায় একাধিক সাহিত্য, নাটক ও সঙ্গীত-সাংস্কৃতিক সংগঠন ছিল। বলা যায় শহরের প্রতিটি পাড়ায় একটি করে এই ধরনের সংগঠন ছিল যে কারণে সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে কুমিল্লার সুনাম ও অগ্রণী ভূমিকা ইতিহাসস্বীকৃত। সাহিত্য সংগঠনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল “অলক্ত” সাহিত্য ম্যাগাজিনকে ঘিরে একটি দল যার নাম আগে ছিল “গাঙচিল”, স্বনামধন্য কবি ও অধ্যাপক আবু তাহের ওরফে তিতাশ চৌধুরী এর সম্পাদক ও প্রকাশক ছিলেন। এরপর “কুমিল্লা সাহিত্য পরিষদ”, “উজান”, “উষসী”, “আমরা জ্যোৎস্নার প্রতিবেশী”, “সে আমি তুমি”, “জাগরণী”, “অগ্নিঝড়ের পাখি”, “হিন্দোল”, “কথকতা”, “বিনোদ”, “বিনয় সাহিত্য সংসদ”, “নান্দীমুখ” প্রভৃতি। “কথকতা” থেকে ১৯৮৬ সালে ফখরুল ইসলাম রচি আয়োজন করেছিলেন “কথকতা সাহিত্য পুরস্কার ও কবিতা জনসভা” টাউন হলে যা ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। তাছাড়া “কচি-কাঁচার মেলা”, “খেলাঘর”, “চাঁদের হাট”, “শাপলা শালুকের আসর”, “সত্যসেনা”, “স্পুটনিক”, “মানব কল্যাণ সংস্থা” ইত্যাদি সংগঠন তো ছিলই। চলচ্চিত্র আন্দোলন বিষয়ক সংগঠনও ছিল। এইসব সংগঠনগুলো থেকে তখন সাহিত্য সংকলন, পত্রিকা এবং দেয়ালিকা প্রকাশিত হত। 

উল্লেখ্য যে, “সে আমি তুমি”রও একটি দ্বিমাসিক সাহিত্য মুখপত্র ছিল “পরিচয়” নামে, সম্পাদনা করতেন হেলালভাই নিজে। আলাপকালে জানা গেল যে, “সে আমি তুমি”র “লোগো” তৈরি করেছিলেন কুমিল্লারই তরুণ কবি ফজল মাহমুদ। বুকটা কেমন করে উঠল বহু বছর পর তাঁর নাম শুনে! সেই প্রবল প্রতিভাবান কবি ফজল মাহমুদ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের ছাত্র ছিলেন, “তাহমিনা” নামের একটি মেয়ের সঙ্গে প্রেমবিষয়ক জটিলতায় প্রত্যাখ্যাত হয়ে ব্যথিত এই অভিমানী কবি আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিলেন। জাপানে এই সংবাদ আমি জেনেছিলাম সংবাদপত্রের মাধ্যমে। এখনো মনে পড়ে তাঁর কবিতার একটি পঙক্তি: “পৃথিবীর মতো কঠিন অসুখ আমাকে জড়ায়।” ফজল মাহমুদ “আমরা জ্যোৎস্নার প্রতিবেশী”র সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ ছিলেন, এরাও প্রকাশ করত একটি মুখপত্র সংগঠনের নামেই। 

সেইসময় মুদ্রণ ছাড়াও জাপানি সাইক্লোস্টাইল পদ্ধতিতে টেনসিল পেপার কেটে একরঙা পত্রিকা প্রকাশের ধুম্ পড়ে গিয়েছিল এই শহরে। আমিও টেনসিল পেপার কেটে কালোর সঙ্গে লাল রং মুদ্রণ করে দুরঙা ছড়া পত্রিকা প্রকাশ করেছিলাম। দুর্দান্ত ছড়াকার হানিফ সংকেত ডিম্বাকৃতির ছড়াপত্রিকা “ঘোড়ার ডিম” প্রকাশ করে দারুণ আলোড়ন তুলেছিলেন। কবি ও সাংবাদিক আজিজুর রহমান মোমীন (পরে কমল মমীন) “মরিচ” সাহিত্য সংকলন এবং ঢাউস ভলিয়মের “রংধনু” ট্যাবলয়েড প্রকাশ করে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন। বস্তুত, যে দুরন্ত অস্থির উন্মাতাল তারুণ্য আমি ১৯৭৬ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত কুমিল্লায় প্রত্যক্ষ করেছি তরুণ কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক এবং নাট্যকর্মীদের সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের মধ্যে, এমনটি বাংলাদেশ আর দেখেনি বলেই মনে হয়! বরং এর সঙ্গে একমাত্র তুলনা করা যায় এই শহরেই বৃটিশ-ভারতের সময় ৩০-৪০ এর দশকে একদল ঘরছাড়া তরুণ কবি, লেখক, সঙ্গীতশিল্পী এবং নাট্যকর্মী যেভাবে সৃজনশীল আলোড়ন তুলেছিলেন তাঁদের সঙ্গে। সংস্কৃতির রাজধানী কলকাতাকে পর্যন্ত প্রভাব বিস্তার করেছিল সেই উতপ্ত আন্দোলন যার পুরোধা ছিলেন কবি ও মাসিক “পূর্ব্বাশা” সম্পাদক সঞ্জয় ভট্টাচার্য, তাঁর অগ্রজ প্রখ্যাত গীতিকার ও চলচ্চিত্রকার অজয় ভট্টাচার্য, সঙ্গীতজ্ঞ শচীনদেব বর্মনসহ অনেক কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক এবং সংস্কৃতিকর্মী যেমন সুবীর সেন, সুধীর চক্রবর্তী, সুবোধ পুরকায়স্থ, অজিত গুহ, নারায়ণ চৌধুরী, অমিয় চৌধুরী, সত্যপ্রসন্ন দত্ত, সুশীল মজুমদার (পরে কলকাতার বিখ্যাত চিত্রপরিচালক) অনুজ ননী মজুমদার, ত্রিদিব দত্ত প্রমুখ। 

আমার তরুণকালে কুমিল্লার খ্যাতিমান কবি হিসেবে যাঁদের স্নেহ, ভালোবাসা ও উৎসাহ পেয়েছি তাঁরা হলেন জহিরুল হক দুলাল, আবদুল ওহাব, ফখরুল হুদা হেলাল, অনোয়ারুল হক, হাসান ফিরোজ, শওকত আহসান ফারুক, ফরিদ মুজহার, আলী হোসেন চৌধুরী, ফখরুল ইসলাম রচি, সৈয়দ আহমাদ তারেক, আলাউদ্দিন তালুকদার, বাবুল ইসলাম, গাজী মুহম্মদ ইউনূস, বিজন দাস, মিয়া বাদল বৈরাগী, সুমন্ত চট্টোপাধ্যায়, রেজা সেলিম, মমীন শাহগীর উল্লেখযোগ্য। বস্তুত এঁরাই হলেন পূর্বসূরিদের উত্তরাধিকারী। কিন্তু বাস্তব হলেও সত্য যে, এই হেলালভাইদের উত্তরসূরি হওয়ার মতো প্রজন্ম এখন কুমিল্লায় নেই বললেই চলে। অন্যান্য শহরের মতো কুমিল্লাতেও সৃজনশীলতার জোয়ার আগের মতো নেই। তার মধ্যে কুমিল্লার অবস্থা খুবই শোচনীয় এবং দৈন্য বলতে হবে। সেজন্য প্রয়োজন যে রকম পরিবেশ এবং উদ্যোগ তার কোনোটাই নেই এখন! শহরে তারুণ্যই নেই বললে চলে! আছে অবক্ষয়ের রাজনীতি যেখানে বিভ্রান্ত তারুণ্য হোঁচট খেয়ে মরছে প্রতিনিয়ত, উদ্ধারকারী বলতেও কেউ নেই। অথচ এমন ছিল না কুমিল্লা কখনো। 

হেলালভাই তাঁর জীবনে অনেক বড় বড় কাজ করেছেন। তার মধ্যে আগেই বলেছি কবিসম্মেলন উল্লেখযোগ্য। লাগাতার কবিতা পাঠের আয়োজন তো করেছেনই। যে বছর আমি অর্থাৎ ১৯৮৪ সালে জাপান প্রবাসী হই তার কিছুদিন আগে হেলালভাইয়ের সংগঠন “সে আমি তুমি”র সাহিত্য সম্পাদক হয়েছিলাম। সে বছর হেলালভাই সংগঠনের সভাপতি হিসেবে আবার উদ্যোগ নিলেন “কবি সম্মেলন ও পুরস্কার প্রদান” অনুষ্ঠানের। এই সালে “সে আমি তুমি”র সাধারণ সম্পাদক ছিল বন্ধুবর বিশিষ্ট সাংস্কৃতিককর্মী মাসুদ সিদ্দিকী। কবিবন্ধুদ্বয় আবু হাসান শাহরিয়ার ও সৈয়দ আল ফারুক এর সহযোগিতায়, “কুমিল্লা উদীচী”র জসীম উদ্দিন আহমেদ ও হুমায়ুনভাই (পরবর্তীতে সপ্তম সভার সভাপতি, মাসুদ সম্পাদক) সহ অনেকের দিন রাত পরিশ্রমের ফসল ওই কবি সম্মেলন যার উদ্যোক্তা ও সংগঠক ছিল মাসুদ। হেলালভাইয়ের সুযোগ্য নেতৃত্বে মাসুদরা এই সম্মেলনের আয়োজন করেছিল এবং সফল হয়েছে কাজেই কৃতিত্বটা হেলালভাইয়েরই। এই রকম সাহসী নেতৃত্ব এখন কোথায়? 

সারাদেশব্যাপী ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টিকারী সফল সেই সম্মেলনের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো বাংলাদেশের দুই মেরুর দুই দিকপাল আদর্শগত দিক দিয়ে পরস্পরবিরোধী কবি শামসুর রাহমান এবং কবি আল মাহমুদের দুর্লভ উপস্থিতি। কবি ফখরুল হুদা হেলাল এই প্রথম তাঁদের দুজনকে একই মঞ্চে হাজির করলেন। একটি ঐতিহাসিক ঘটনা বাংলা সাহিত্যের জগতে। এই দুরুহ কাজটি সমাধা করার জন্য হেলালভাইকে কতখানি প্রভাব খাটাতে হয়েছে ভাবলে আশ্চর্য না হয়ে পারা যায় না! অবশ্য সাধারণ সম্পাদক মাসুদ সিদ্দিকীরও অবদান কম নয়। এই প্রসঙ্গে একটি তথ্য তুলে ধরার লোভ সামলাতে পারছি না। জাপানে আমার সম্পাদিত মাসিক “মানচিত্র” কাগজে আল মাহমুদের একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেছিলাম কবি সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলালের অনুরোধে “বাংলাদেশের রাজা কবি প্রসঙ্গে” যাতে তাঁর প্রতিপক্ষ শামসুর রাহমানকে উদ্দেশ করে অনেক কথা লিখেছিলেন তিনি। লেখাটি সেই সময়ে ঢাকার কোনো পত্রিকাই প্রকাশ করতে রাজি হয়নি, কেননা কবি শামসুর রাহমান তখন জীবিত। আরও উল্লেখ্য যে, পরবর্তীকালে কবি শামসুর রাহমান “মানচিত্র” পত্রিকার প্রধান  উপদেষ্টা হয়েছিলেন! 

সে যাই হোক, ১৯৮৪ সালের কবি সম্মেলনে আরও এসেছিলেন বিশিষ্ট রম্য লেখক ও ব্যাংকার লুৎফর রহমান সরকার, তরুণ কবিদ্বয় আবিদ আজাদ এবং আবু হাসান শাহরিয়ার। নগর মিলনায়তন উপচে পড়েছিল মানুষে। সারা কুমিল্লা শহরই উৎসবমুখর হয়ে পড়েছিল। স্থানীয় কবি ও ছড়াকার সবাই কবিতা ও ছড়া পাঠ করেছিলেন। পুরস্কার হিসেবে সনদপত্র এবং সম্মানী ৫০০ টাকা প্রদান করা হয়েছিল কবিদ্বয় শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ এবং রম্য লেখক লুৎফর রহমান সরকারকে--সাহিত্যচর্চায় তরুণদেরকে উৎসাহদান এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে তাঁর বিশেষ অবদানকে স্মরণে রেখে। আর পুরস্কার হিসেবে সনদ প্রদান করা হয়েছিল আবিদ আজাদ ও আবু হাসান শাহরিয়ারকে। শাহরিয়ারকে নির্বাচিত করা হয়েছিল সে এবং সৈয়দ আল-ফারুক যৌথভাবে “কবি শামসুর রাহমান প্রামাণ্য গ্রন্থ” নামক একটি বই লিখেছিল--তাদের সেই তরুণ প্রচেষ্টাকে সম্মানিত করার জন্য।   

নিরলস পরিশ্রমী ফখরুল হুদা হেলাল সাম্প্রতিক “কবিতাবাংলা” আন্দোলনেরও পথিকৃৎ কুমিল্লা শহরে। ২০০৮ সালে “কবিতাবাংলা”র একটি অনুষ্ঠানে আমি উপস্থিত থাকার সুযোগ পেয়েছিলাম, অতিথি ছিলেন কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা, ছড়াকার ও কবি আইউব সৈয়দ, জেলা প্রশাসক কবি মনজুরুর রহমান প্রমুখ। মিলনায়তন ভর্তি দর্শকের সামনে কবিতা পাঠ এবং বক্তব্য রেখেছেন শহরের বিশিষ্ট শিক্ষক, কবি, লেখক এবং সাংবাদিকবৃন্দ। আমাকেও দুটি কথা বলার সুযোগ দিয়েছিলেন হেলালভাই। উপস্থাপনা করেছিলেন তিনি নিজেই। সেই মেঘগম্ভীর গমগম কণ্ঠস্বর--বিরল এক সম্পদ যাঁর। 

কবি ফখরুল হুদা হেলালের এই পর্যন্ত পাঁচটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে কুমিল্লাতেই সবই ‘“সে আমি তুমি” প্রকাশনী সংস্থা থেকে--এটা ব্যতিক্রমই বটে! সবাই যেখানে রাজধানীমুখী হয় সেখানে হেলালভাইকে দেখেছি আপন শহরেই স্থিতু হয়ে থাকতে অটল অবিচল সিদ্ধার্থের মতো। অথচ কুমিল্লা থেকেই তাঁর প্রতিভা ও কর্মকাণ্ডের সংবাদ বাংলাদেশ, ভারতসহ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে গিয়েছে অনেক অনেক আগেই। তাঁর স্বচিন্তিত গ্রন্থগুলোর নামকরণও ব্যতিক্রম যেমন “অনামিকায় প্রবাল” (২০০০), “ঈশ্বরের পৌরসভা” (২০০১), “পপির চিঠির শেষ অংশ” (২০০৩), “তোমার হাতে খাবো” (২০০৪) এবং “জোড়া টিকটিকি” (২০০৭)। প্রতিটি গ্রন্থেরই প্রচ্ছদ অসাধারণ। বিশেষ করে “তোমার হাতে খাবো” গ্রন্থটির প্রচ্ছদ সৃজন করা হয়েছে বিখ্যাত আলোকচিত্রশিল্পী নাসির আলী মামুনের তোলা ফখরুল হুদা হেলালের একটি প্রতিকৃতি দিয়ে। হেলালভাই একাধিক ব্যতিক্রমধর্মী সংকলন সম্পাদনা করেছেন। তাঁর কাব্যপ্রতিভা ও কর্মগুণের জন্য তাঁকে বাংলা একাডেমী আজীবন-সদস্য পদ দিয়ে সম্মানিত করেছে। এটা দুর্লভ একটি মর্যাদা। তিনি আরও একাধিক সংস্থার আজীবন-সদস্য। কিন্তু বয়সের এই পড়ন্ত বিকেলে তাঁর দৈহিক ও মানসিক অবয়বে আদৌ দুর্বলতার কোনো ছায়া নেই! আশ্চর্য সতেজ এবং কর্মপাগল তিনি এখনো! অবশ্য হেলালভাইয়ের এ পর্যন্ত সাফল্যের পেছনে সহধর্মিণী ফাতিমা আক্তার পারভীন ভাবীর অনুপ্রেরণা ও অবদান অনস্বীকার্য। 

কবি বলতেই সবুজসরস আর নতুনত্বের পিয়াসী। তাই তো তিনি সহযোগিতা করছেন আমার সম্পাদিত মাসিক “কিশোরচিত্র” কাগজকে কেন্দ্র করে মাতৃভাষায় কিশোরসাহিত্য আন্দোলনকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য। তাঁর সাগ্রহ সান্নিধ্য পেয়ে আমি তখন অনেক আশাবাদী এবং সাহসী হয়েছিলাম। হেলাল ভাইয়েরও একই চিন্তা দেখেছি: সঠিক ও মেধাবী উত্তরসূরি সৃষ্টি করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই, তা না হলে আমাদের সব সৃষ্টি ও কর্ম হারিয়ে যাবে। তাঁর সম্পাদিত “স্বাধীনতা মানেই পতাকা” এক ঝাঁক শিশুদের ছড়া ও কবিতার চমৎকার একটি সংকলন। কাজটি অসামান্য এবং ব্যতিক্রম--এই কারণে যে, কাঁচা হাতের লেখাগুলো হুবহু মুদ্রণ করেছেন, প্রচলিত মুদ্রাক্ষরে কম্পোজ ছাড়াই। নানা কারণেই এটা স্মৃতিজাগানিয়া। “কিশোরচিত্রে”র ২০১২ সালের মে সংখ্যাতে আমি এটা নিয়ে আলোচনা করেছি। খুব খুশি হয়েছিলেন তিনি।  

কুমিল্লা যে ঐতিহাসিক বড় বড় কর্মকাণ্ডের পথিকৃৎ সেই ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য কবি ফখরুল হুদা হেলাল অটল এক মহীরুহ, স্পষ্টভাষী এক বিদ্রোহী--তাঁর ছায়ায় আমরা আরও বহুদিন মুখর থাকব কখনো পাখপাখালি হয়ে কখনোবা শিশু-কিশোর। তাঁর সংগঠন “সে আমি তুমি”র সদস্য হয়েছিলাম জাপান যাওয়ার ঠিক প্রাক্কালে; দু-একটি অনুষ্ঠানে জড়িতও ছিলাম তারপর হঠাৎ করেই এসেছিল বিচ্ছিন্নতা। সেই বিচ্ছিন্নতার ছেঁড়া সুতোর গিঁট লাগল সেবার ফিরে গেয়ে, তার জন্য খরচ করতে হয়েছে ২৫টি বছর! 

মনে হচ্ছে, অতীতে যে তারুণ্যভরা অরণ্য ফেলে এসেছি সেদিকেই আবার ফিরে চলা শুরু হল যেন আসন্ন ষাট হেলাল ভাইয়ের সঙ্গেই। (পুরনো লেখা, কিছুটা সংশোধিত ও সংযোজিত।) 

ছবি পরিচিতি: কবি আল মাহমুদ এবং কবি আসাদ চৌধুরীর মাঝখানে কবি ফখরুল হুদা হেলাল 

সময় জার্নাল/আরইউ


Somoy Journal is new coming online based newspaper in Bangladesh. It's growing as a most reading and popular Bangladeshi and Bengali website in the world.

উপদেষ্টা সম্পাদক: প্রফেসর সৈয়দ আহসানুল আলম পারভেজ

যোগাযোগ:
এহসান টাওয়ার, লেন-১৬/১৭, পূর্বাচল রোড, উত্তর বাড্ডা, ঢাকা-১২১২, বাংলাদেশ
কর্পোরেট অফিস: ২২৯/ক, প্রগতি সরণি, কুড়িল, ঢাকা-১২২৯
ইমেইল: somoyjournal@gmail.com
নিউজরুম ই-মেইল : sjnewsdesk@gmail.com

কপিরাইট স্বত্ব ২০১৯-২০২৪ সময় জার্নাল