শনিবার, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪

প্রতিদান

বৃহস্পতিবার, সেপ্টেম্বর ২, ২০২১
প্রতিদান

ডা. ইকবাল আনোয়ার  :

আখাউড়া চাকুরী করার সময়, সব রকম ডাক্তারী করতাম। ঠোঁট সেলাই, মুসলমানী, ক্যান্সার রোগীর ক্যামো দেওয়া থেকে ডেলিভারী; সব।

এখন আমি আগের সেই সময়ের চেয়ে বেশী জানি। কিন্তুু শিশু ছাড়া অন্য রোগী দেখতে চাইনা। বড়দের ব্লাড প্রেসারের ঔষধও লিখে দেইনা, পাছে ভুল হয়!

বেশী জানার ফল এটাই হয়েছে। তা ছাড়া গ্রামের মানুষ, রেফার করলে যেতে চাইতো না, পারতোনা। বলতো, 'আপনে স্যার একটা কিছু করেন। আমরা নিতে পারবোনা।' রোগীর জান বাঁচাতে রিক্স নিতাম। তখন যৌবন। সাহসও বেশী।
এক ঝড়ের রাতে আমার বাসায় একজন রোগীনির স্বামী এসে হাজির। তার স্ত্রী সন্তানপ্রসবা। রক্ত ক্ষরণ হচ্ছে। কিন্তু বাচ্চা খালাস হচ্ছে না। তিনি নৌকা নিয়ে এসেছেন। যেতে হবে 'বৈশ্যল'। বর্ষা কাল। হাসপাতালের যে কোয়াটার থাকি, সেটার কলাপসেবল গেইট পার হয়ে সামান্য একটা ঘাসে ছাওয়া উঠান মতো। তার পরেই পানি থই থই। থপর থপর পানির লেহনে ঘাস ভিজে গিয়ে নরম কাদা। বড়শিতে ব্যঙ গেঁথে দিলে গজার উঠে। পানির নীচে জলজ সব লতা পাতা।

ফড়িং ওড়ে বসে, কলমির শিশু ডগায়। একটা সেঁদো গন্ধ। শেওলায় ময়লা আটকে পানি স্ফটিক যেনো। দেখা যায় শৈল, গজার তাদের পোনা নিয়ে ঘুরছে।
একটু দূরে আরেক ঘাটে নৌকা বাঁধা।
আমি যা কিছু নেবার, ব্যাগে নিয়ে রওয়ানা দিলাম। নৌকায় উঠে দেখি, আরেকজন, নৌকার ভিতরের পানি সেচে চলেছে। ইলেট্রিকের থামে বাতি ঘোলাটে। ক্রমশ নৌকা গাঢ় অন্ধকারে চলে গেলো। মাঝে মাঝে বিদ্যুত চমকালে আমাদের তিনজনকে দেখা যায়, আর দেখা যায় ছোট নৌকাটাকে। ঢেউয়ে দুল খাচ্ছে!

নায়ে ছইয়া নাই। ছাতাই ভরসা। তারা ছাতা এনেছে। আমারও ছিলো। ছেলেটা আমার মাথার উপর ছাতা ধরে আছে। অন্ধকারে ধারনা করে নৌকা চলছে। টর্চের বেটারী শেষ পর্যায়ে। মাঝে মাঝে তা ধরা হয়। আমি কেবল অস্তিত্ব বুঝি, বইঠার সাথে নায়ের ঘর্ষণের শব্দে। দ্রুত নাও বাইছেন তিনি।
হঠাৎ চরম এক বিপদ এলো।
খরার দিনে এ জায়গাটা মাঠ - জমি। এখানে বিদ্যুতের খুঁটি। বর্ষায় বিল। একটা খুঁটি ঝড়ে কাত হয়ে গেছে। অন্ধকারে তা বুঝা যায়নি। তার পাশ দিয়ে নৌকা চলে গেলো। একটা তার আমার গায়ের পাশ দিয়ে গেলো। গায়ে লাগলে মৃত্যু ছিলো নির্ঘাত। বড় একটা বিপদ কেটে গেলো। আল্লাহপাকের কাছে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করলাম। মনে এলো মা বাবা ভাই বোনের কথা।
আমরা চলে এলাম রোগীনির বাড়িতে। তাদের ঘরটা পুকুরের একদম পারে। ছোট ঘর। নৌকা গাছের শিকড়ে বেঁধে আমাকে ধরে উঠানো হলো। পিচ্ছিল পাড়।
ঘরে গিয়ে দেখি, ছালার দরজা। তার ভিতরে মেঝেতে মা শোয়া। মেঝে স্যাতস্যাতে। একটা চাটাইয়ের উপর পলিথিন। রক্তে ভেজা। পাশে ধাইমা।
এ ভাবে কাজ করা বড় বেকায়দা।
তবু আমি চেষ্টা করে ফোরসেপ ডেলিভারী করলাম। বাচ্চা কেঁদে উঠলো।
আমার মনে শান্তি এলো। সবাই খুশী।
ভিজিট চাইবো কী। পারলে দিতে হয়। কাজেই সে কথা তুললাম না। বরং স্বামী বললেন-' কী দিতাম স্যার। আপনে যে উপকার করলেন, তার দাম হয় না'।
আমি বললাম- না আপনাদের কিছু দিতে হবেনা।
আমি চিন্তা করছি, যে বিপদ গেছে, তার ভিতর দিয়ে কী করে ফেরত যাবো।
তাই থেকে যেতে মন বলছিলো।
একজন প্রস্তাব করলো, তাদের ঘরের লাগোয়া একটা ঘর, তারা কিছু অবস্থাপন্ন, সেখানে রাতের বাকি অংশটা কাটিয়ে দিতে। আমি রাজী হলাম। সেখানে চৌকিতে সুন্দর করে বিছানা পাতা হয়েছিলো। ক্লান্তিতে শুয়ে পরলাম।
আমাকে চা পরিবেশন করা হলো। লবনযুক্ত তেজপাতা দেয়া চা। বড় ভাল লাগলো খেতে।
ভোরে ফিরে এলাম কোয়াটারে।
তার চার পাঁচদিন পরে, অতি ভোরে কোয়াটারের পেছনে চরচরে আওয়াজ।
এ বাসায় ডাকাতি হয়েছিলো। আমার টেলিভিশন ছাড়া সব নিয়ে গিয়েছিলো। এমনই বর্ষায়। এটা বইশ্যলের ডাকাত দলেরই কাজ ছিলো বলে ধারনা। এরা নুতন অসি এলে নাকি গাভী নজরনা দেয়, এমন গল্প চাউড়!

রাতে ঘরের পেছনে শেয়াল আসতো। হঠাৎ শেয়ালের বিকট ডাকে ঘুম ভেঙ্গে যেতো। আমি পেছনে ভয়ে ভয়ে গিয়ে দেখি, বাঁশ আর জিংলা দিয়ে কে যেনো আমার লাউগাছের মাচা বেঁধে দিচ্ছে। আমি তো এমন কাউকে বলি নি!
কোয়াটারের মাটি ছিলো উর্বর। বেগুন লাগিয়েছিলাম। সিমনাথ বেগুন। এক একটা লম্বায় মাটি ছুঁই ছুঁই। গাজরের বিচি এনে গাছ তোলে, সেটা কেলিকেটে লাগিয়েছিলাম। এটা শম্ভুর এক্সপেরিমেন্ট। আমার অনুজপ্রতিম ডাক্তার শম্ভু নাথ দত্তের কৃষিতে দারুন দক্ষতা ছিলো। আমার সাথে খেতো শম্ভু। সারাদিন সময় পেলেই পড়তো। ডেভিটসনের বইটা মাথার নীচে দিয়ে ঘুমাতো (শম্ভু এখন নরওয়েতে), যেনো আয়েশী ঘুমে পেয়ে না বসে। এক এক গাজর মোটা হয়ে ফেটে গেছে। হালুয়া করেছিলাম গাজরের। ছাদে হয়েছিলো মিষ্টি কুমড়া। সীম হয়েছিলো এতো যে পাতা দেখা যায় না। সেই সীমের বিচি, ইঁদুরের গর্ত থেকেও উদ্ধার করা গেছিলো এক উরা। যা লাগাতাম, যত্ন ছাড়াই বেসুমার হতো।

দেখি সেই স্বামী। যার বাড়ি থেকে ভিজিট না নিয়ে ফিরেছিলাম সেই ঝড়ো রাতে। তিনি নায়ে করে বাঁশ- জিংলা এনে আমার কোন মতে দাঁড় করানো লাউ গাছের মাচা করে দিচ্ছেন।


Somoy Journal is new coming online based newspaper in Bangladesh. It's growing as a most reading and popular Bangladeshi and Bengali website in the world.

উপদেষ্টা সম্পাদক: প্রফেসর সৈয়দ আহসানুল আলম পারভেজ

যোগাযোগ:
এহসান টাওয়ার, লেন-১৬/১৭, পূর্বাচল রোড, উত্তর বাড্ডা, ঢাকা-১২১২, বাংলাদেশ
কর্পোরেট অফিস: ২২৯/ক, প্রগতি সরণি, কুড়িল, ঢাকা-১২২৯
ইমেইল: somoyjournal@gmail.com
নিউজরুম ই-মেইল : sjnewsdesk@gmail.com

কপিরাইট স্বত্ব ২০১৯-২০২৪ সময় জার্নাল