মহিউদ্দিন ভূঁইয়া ::
বাংলাদেশ পুলিশের বর্তমান পুলিশ সুপার, বিশিষ্ট গীতিকার, সুরকার, কণ্ঠশিল্পী, বাংলাদেশ পুলিশ সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক পরিষদের সাবেক সাধারণ সম্পাদক (২০১৫-২০১৭) এসএম জাহাঙ্গীর আলম সরকারের আজ শুভ জন্মদিন। ১৯৭৩ সালের আজকের এই দিনে পাবনা জেলার ফরিদপুর উপজেলার সোনাহারা গ্রামে এসএম জাহাঙ্গীর আলম সরকার জন্মগ্রহণ করেন। পিতা নজরুল ইসলাম সরকার ছিলেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, ফরিদপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের অন্যতম সংগঠক ও নেতা। মাতা আনোয়ারা বেগম গৃহিণী। এসএম জাহাঙ্গীর আলম সরকার ফরিদপুর উপজেলা থেকে বিসিএস পুলিশ ক্যাডারে নির্বাচিত প্রথম সদস্য।
এসএম জাহাঙ্গীর আলম সরকার গোপালনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন। তিনি বনওয়ারীনগর করোনেশন বনমালী পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে প্রথম বিভাগে এসএসসি এবং সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ, পাবনা থেকে স্টার মার্কস নিয়ে প্রথম বিভাগে এইচএসসি পাস করেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগ থেকে প্রথম শ্রেণিতে তৃতীয় স্থান অধিকার করে বিবিএ (সম্মান) এবং প্রথম শ্রেণিতে তৃতীয় স্থান অধিকার করে এমবিএ ডিগ্রি অর্জন করেন। এছাড়া তিনি Diplomat Institute of Bankers Bangladesh (DIBB) প্রথম পর্বে সমগ্র বাংলাদেশের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করায় ইস্টার্ন ব্যাংকের গোল্ড মেডেল, বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্রোঞ্জ মেডেল ও কৃষি ব্যাংকের নগদ টাকা পুরস্কারে ভূষিত হন। তদানীন্তন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফখরুদ্দিন আহমেদ তার হাতে এ সম্মাননা তুলে দেন।
সংগীতে হাতেখড়ি বাবার কাছে জারিগানের মাধ্যমে। এরপর সারগাম গীত করে নজরুল-সংগীতের ওপর তালিম নেন ওস্তাদ নরেশচন্দ্র হালদার (ফরিদপুর, পাবনা)-এর কাছে। আর্যসংগীত সমিতি (চট্টগ্রাম) থেকে তালিম নেন মিহিরবালা ও জয়ন্তীলালার কাছ থেকে। আধুনিক গানের তালিম নেন চয়ন সেন (ময়মনসিংহ)-এর কাছে। লোকসংগীতে তালিম নেন ওস্তাদ সম্রাট জাহাঙ্গীরের কাছে।
কর্মজীবনের প্রথম এসএম জাহাঙ্গীর আলম সরকার জাতীয় মজুরি কমিশনের গবেষণা কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এরপর মার্কেন্টাইল ব্যাংক লিমিটেডের সিনিয়র অফিসার হিসেবে সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে বাইশতম বিসিএস-এর মাধ্যমে সহকারী পুলিশ সুপার হিসেবে ২০০৩ সালে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীতে যোগ দেন। পুলিশ বাহিনীতে কর্মরত অবস্থায় তিনি সারদা পুলিশ একাডেমি, চুয়াডাঙ্গা জেলা এবং RAB-৭ (চট্টগ্রাম)-এ সহকারী পুলিশ সুপার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৭ সালে সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার, ২০১১ সালে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এবং ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পুলিশ সুপার পদে পদোন্নতি পান। সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার হিসেবে রংপুর জেলা, জাতিসংঘ মিশন কঙ্গোর বুকাভু শহর এবং ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশে দায়িত্ব পালন করেন। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিসেবে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (অর্থ ও বাজেট), ট্রাফিক দক্ষিণ বিভাগ-ডিএমপি এবং ময়মনসিংহ জেলার বিশেষ শাখায় দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পুলিশ সুপার (উপ-পুলিশ কমিশনার) পদে পদোন্নতি পান। উপ-পুলিশ কমিশনার (পুলিশ সুপার) হিসেবে তিনি পাবলিক অর্ডার ম্যানেজমেন্ট, মিরপুর ও উপ-পুলিশ কমিশনার (পরিবহণ) হিসেবে এবং ফেনী জেলার পুলিশ সুপার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
পুলিশ বাহিনীতে বিশেষ সাফল্যের জন্য, ঝুঁকিপূর্ণ কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রশংসাপত্র এবং আইজি ব্যাজ প্রদান করা হয়।
শৈশবকাল থেকেই তিনি সংগীতাঙ্গনে সাফল্যের স্বাক্ষর রাখেন। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে কণ্ঠশিল্পী হিসেবে ব্যাপক পরিচিত পান। কর্মজীবনে এসে দেশব্যাপী গীতিকার, সুরকার ও কণ্ঠশিল্পী হিসেবে পরিচিত হন। এ পর্যন্ত তিনি রচনা করেছেন দুশতাধিক গান এবং সুর সংযোজন ও কণ্ঠ দিয়েছেন নিজেই। জাহাঙ্গীর আলম সরকার সংগীতে মুক্তিযুদ্ধ, বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও মানবিক মূল্যবোধকে প্রাধান্য দিয়ে থাকেন।
ছাত্রজীবনে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকার কারণেই সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে লিখেছেন--"ওরা যুদ্ধাপরাধী" শিরোনামে এবং পনেরো আগসট ট্রাজেডি নিয়ে গান-- যা প্রচারিত হয় বিটিভি, বিটিভি ওয়ার্ল্ডসহ বিভিন্ন বেসরকারি টেলিভিশনে। সময়ের দাবি মেটাতে তিনি শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চে তাৎক্ষণিক গান রচনা ও মিউজিক ভিডিও নির্মাণ করে ভিডিও প্রজেক্টরের দ্বারা প্রদর্শনের মাধ্যমে দর্শক শ্রোতাদের মাঝে আলোড়ন সৃষ্টি করেন। পরিবেশ রক্ষায় জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে গেয়েছেন 'বাঁচাও নদী, বাঁচাও দেশ' শিরোনামে গান। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ১৫ আগস্টের লোমহর্ষক হত্যাকাণ্ড ও জেলখানায় বন্দি অবস্থায় জাতীয় চারনেতা হত্যাকাণ্ডকে স্মরণ করে লিখেছেন,
‘কান্দে বাঙালি কান্দে
বঙ্গবন্ধুর লাইগা
আজো কান্দে বাঙালি কান্দে
জাতির পিতার লাইগা
বাংলার আকাশ-বাতাস কান্দে
মুজিব মুজিব বইলারে
মুজিব মুজিব বইলা।।
পঁচাত্তরের ১৫ই আগস্ট
ঘাতকের গুলিতে
লুটাইয়া পড়িলেন পিতা
বাংলার মাটিতে
বুকের রক্তে সোনার বাংলা
গেল যে ভিজিয়ারে
গেল যে ভিজিয়া।।
পিতা মারলো মাতা মারলো
মারলো বড়োভাই
শেখ রাসেল কান্দিয়া বলে
মাইরো না আমায়।
ঘাতকেরই বুকের মাঝে
হইল না মায়া
শেখ রাসেলের কচি বুকটা
করিল ঝাঁঝরা।
ওরা চারনেতাকেও হত্যা করলো
জেলখানায় আটকাইয়ারে
জেলখানায় আটকাইয়া।।
বঙ্গবন্ধু কন্যা ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে লিখেছেন,
‘বঙ্গবন্ধু কন্যা তুমি ছাড়া
ধরণিতে আর আছে যারা,
তোমার বিকল্প শুধুই তুমি
শিখিয়েছ তুমি
কিভাবে স্বপ্ন দেখতে হয়।
ক্ষুধার্ত বাঙালির তৃষ্ণা মিটিয়ে
জীবন তাদের করেছ পদ্যময়
তোমার তুলনা তোমাকে দিয়েই হয়।
বিশ্বের সাড়াজাগানো ও লোমহর্ষক হত্যার শিকার হয়ে, স্বরণার্থীবেশে বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণ ও পশ্চিমাদের কটাক্ষ করে লিখেছেন,
“মানবতা আজ থমকে গেছে
বিশ্ব বিবেক উল্টে গেছে
মানবাধিকার কোথায় আছে ?
শুনেছি সে নাকি পশ্চিমে।
রোহিঙ্গারা মানবতা খুঁজে
পেয়েছে স্বাধীন বাংলাতে
মানবতা আছে বাংলাদেশে।।”
এমনি অনেক গান তিনি রচনা করেছেন, সুর সংযোজন ও কণ্ঠ দিয়েছেন নিজেই। এছাড়াও বিবাদ-১ ও বিবাদ-২ খণ্ড নাটকের গানেও তিনি কণ্ঠ দিয়েছেন ।
২০০৭ সালে প্রকাশিত হয় তার প্রথম একক অ্যালবাম "প্রেমের বাউল"। ওই বছরেই তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশনে গীতিকার, সুরকার ও কণ্ঠশিল্পী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন এবং মেধাগুণে বর্তমানে বাংলাদেশ টেলিভিশনের প্রথম শ্রেণির গীতিকার ও কণ্ঠশিল্পী। এছাড়াও ২০০৮ সালে রংপুর বেতারে গীতিকার ও কণ্ঠশিল্পী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। "সংগীত ও আমাদের মুক্তিযুদ্ধ : ভাবদর্শনগত বিশ্লেষণ" শিরোনামের নিবন্ধ রচনা করে তিনি পাঠকসমাজে সমাদৃত হয়েছেন। তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় 'বাংলাদেশ পুলিশ সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক পরিষদ' ঈর্ষণীয় সফলতা অর্জন করেছে। ১৬ ডিসেম্বর ২০১৬ তারিখ (মহান বিজয় দিবস) থেকে প্রতি শুক্রবার সকাল ১০.৩০ মিনিটে দীপ্ত টেলিভিশনে "সাংস্কৃতিক চর্চায় পুলিশ পরিবার" নামে যে অনুষ্ঠানটি প্রচারিত হচ্ছে, সেটিরও গ্রন্থনা ও গবেষণার কাজটি তিনিই করেছেন।
পারিবারিক জীবনে এসএম জাহাঙ্গীর আলম সরকারের সহধর্মিণী উচ্চশিক্ষিতা মোনালিসা পারভীন (সনি) সংসার অভিযাত্রায় নিপুণ সারথি। শারাহ মেহজাবিন মাথিন ও মাস্টার কিষাণ বাঙালি তাদের দুই সন্তান ।
আমরা পুলিশ সুপার এসএম জাহাঙ্গীর আলম সরকারের দীর্ঘায়ু, সুস্বাস্থ্য ও কর্মজীবনের সফলতা কামনা করি । আমিন ।