বুধবার, সেপ্টেম্বর ৮, ২০২১
চোখের ব্যান্ডেজ খোলার পরপর বেশ টেনশনে ছিল আনিস, কারণ সৈয়দ সাহেব নিশ্চুপ ছিলেন খানিকক্ষণ। দীর্ঘদিন বাদে দৃষ্টিশক্তি পুরোপুরি ভাবে ফিরে পাবার বাকরুদ্ধ আবেগ ছিল সেটা। তারপর আনন্দে কেঁদে ফেললেন, জড়িয়ে ধরলেন আনিসকে। ডাক্তার হওয়ার সুবাদে এই পৃথিবীতে থেকেও কিছু স্বর্গীয় দৃশ্য দেখার সৌভাগ্য হয় মাঝেমধ্যে। সৈয়দ সাহেবের আনন্দ মাখা মুখ পরিতৃপ্ত করল আনিসকে। তার কাজ শেষ, রাতে গোছগাছ করে ফেলবে সব। সকালে ট্রেন ধরতে হবে। এখানের স্টেশনে ট্রেন থামে মাত্র দশ মিনিট, তাই আগে ভাগেই বেরিয়ে পড়তে হবে। কোনভাবে ট্রেন মিস করা যাবেনা। অযাচিত কোন ঝামেলায় কোনভাবেই জড়াবেনা সে।
দুপুরে বিদায় উপলক্ষে বিশেষ ভোজের আয়োজন করা হল। বড় সাইজের একটা ছাগল জবাই করা হল, পুকুর থেকে জাল ফেলে মাছ ধরা হল। দুজন মধ্যবয়সী মহিলা এসেছেন দুপুরের দিকে, তারা নাকি পিঠা তৈরী করবেন। এদের কান্ডকারখানায় আনিস খুবই অস্বস্তি বোধ করছে, পাশাপাশি একধরনের অপরাধবোধেও আচ্ছন্ন হচ্ছে। এত সম্মান এত আদর পাবার আদৌ যোগ্য নয় সে। কি এমন করেছে সে! টাকার বিনিময়ে একজনের চোখ অপারেশন! সেটা তো অহরহ করে আসছে গত দুবছর থেকে।
কয়েকবার বলার চেষ্টাও করেছে সৈয়দ সাহেব কে এই বিশাল আয়োজন বন্ধ করতে, কিন্তু তার অতি উৎসাহ, আচরণের গাম্ভীর্য আটকে দিয়েছে তাকে। কিছুটা নিরাশ হয়ে আনিস দোতলায় উঠে এলো। সিগারেটের প্যাকেটের সাথে টুকরো কাগজটা উঠে এলো, আনিস আপন মনে হাসল। ধাঁধাঁটার অর্থ আর জানা হলো না। কাগজটা টুকরো টুকরো করে ফেলে দিল, সিগারেট ধরিয়ে জানালায় দাড়িয়ে হঠ্যাৎ মনে হলো বুকের ভারটা নেমে গেছে। বেশ শান্তি লাগছে এখন। এখান থেকে আরশাদকে দেখা যাচ্ছে, কসাইয়ের পাশে চেয়ারে বসে গভীর মনোযোগে ছাগলের চামড়া ছাড়ানো দেখছে। ছেলেটা একদম বাইরে আসেনা, এলেও কোরবান সাথে থাকে সবসময় হাত ধরে।
দুপুরের খাওয়া দাওয়া শেষে সৈয়দ সাহেব নিজ হাতে মশলা পান বানালেন, "এইটা খাও, হজমে সুবিধা হইব।"
পান জিনিসটা একদম পছন্দ না তার, প্রচন্ড অনিচ্ছা স্বত্তেও নিতে হল, পান মুখে দেয়া মাত্রই চেনা একটা সুগন্ধে আচ্ছন্ন হল সে। জোহরার গা থেকে ঠিক এই ঘ্রাণই পেয়েছিল সে! স্বপ্নে হলেও অনুভূতি এত জীবন্ত ছিল! প্রতিটা মূহুর্ত ছবির মত স্পষ্ট তার কাছে। সে সৈয়দ সাহেবের দিকে তাকালো, "কিছু মনে না করলে আমি এখন উঠি! একটু বিশ্রাম নিতে চাই।"
অতিরিক্ত খাওয়ার কারনে শরীরে অস্বস্তি হচ্ছে, বিছানায় শোয়া মাত্র ঘুমিয়ে গেল তাই, তীব্র চিৎকারে ঘুম ভাঙল আনিসের, কিছুই বুঝতে পারলনা, শুধু আরশাদের কণ্ঠস্বরটা চিনতে পারল। দ্রুত স্যান্ডেল পরে বাইরে বেরোলো, সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামতেই কোরবানের সাথে দেখা, সিঁড়ির শেষ মাথার স্তম্ভটা আঁকড়ে ধরে কাদঁছে সে। হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞেস করল সে, "কি হয়েছে?"
"জোহরা বিষ খাইছে! আমার ময়না মইরা যাইতাছে ডাক্তার সাব!"
বিদ্যুৎ খেলে গেল সমস্ত শরীরে, মনে হচ্ছে পায়ের নীচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছে ক্রমশ, কোন ভাবে টাল সামলালো আনিস। মাথা ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করছে আপ্রাণ, অস্থির হলে চলবেনা। "আমাকে নিয়ে চল ওর ঘরে, ওঠো কোরবান!"
সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে এলোমেলো ভাবনায় পা ফসকে গেল একবার, জোহরার পক্ষে খুব ভয়ংকর কোন বিষ সংগ্রহ করা কি সম্ভব! বোধ হয় না। তাছাড়া সে দুপুরে ভাত খেয়েছে, খালি পেট হলে বিষের প্রতিক্রিয়া দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে শরীরে, এক্ষেত্রেও আশা আছে। একরকম দৌড়ে সে দক্ষিণ দিকের ঘরটায় পৌঁছল।
ঘরে ঢুকেই সৈয়দ সাহেবকে দেখতে পেল আনিস, তার চেহারায় স্পষ্ট বিরক্তির ছাপ। আরশাদ তাকে দেখামাত্রই দৌড়ে এলো, হাউমাউ করে অসহায়ের মত অনেক কিছু বোঝানোর চেষ্টা করল, যার কিছুই বুঝতে পারল না সে। তার চোখ পড়ল খাটে শুয়ে থাকা শরীরটার দিকে, যেটা প্রতিমুহূর্তে কুঁকড়ে যাচ্ছে যন্ত্রনায়। দ্রুত হাত চালালো আনিস, হালকা শরীরটাকে কোলে নিতে কষ্ট হলোনা তেমন, ঘরের বাইরের খোলা করিডোরে পাটি পেতে শোয়ানো হল তাকে, কোরবানের দিকে তাকালো, " কি খেয়েছে বলতে পারবে?"
না সূচক মাথা নাড়ল সে। সৈয়দ সাহেব উঠে দাড়ালেন, "গঞ্জের বাজার থেকে ইদুর মারা বিষ আনানো হইছিল গত সপ্তাহে, সেইটা খাইছে! দেখো প্যাকেট পইড়া আছে। মেয়ে মানুষ মানেই বেকুবের জাত! লোক জানাজানি হইলে আমার ইজ্জত কই থাকবে চিন্তা কর একবার ডাক্তার!"
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সে, ভয়ংকর কিছু খায়নি! কোরবানকে তাড়া দিল, "কোরবান বমি করাতে হবে যে কোন ভাবে! সাহায্য কর আমাকে!" প্রায় আধা ঘণ্টা একটানা চেষ্টার পর বমি করল জোহরা। বমির উৎকট গন্ধে সৈয়দ সাহেব নাকে কাপড় চেপে স্থান ত্যাগ করলেন, আরশাদ একটু দূরে দাড়িয়ে আছে, তার চোখে আতংক। অনেক্ষণ বাদে চোখ খুলল জোহরা, চোখের কোন বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে ক্রমাগত,। আনিস কোরবানের মাথায় হাত রাখল, কেঁদোনা আর! ভয় কেটে গেছে, ইঁদুর মারা বিষ খুব ভয়ংকর কিছুনা। আর সে বেশি খেতেও পারেনি। ওর এখন ভাল ঘুম দরকার একটা, সুস্থ হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। বেশ কিছুসময় লক্ষ্য রাখার পর আনিস বুঝতে পারল স্বাভাবিকতায় ফিরে এসেছে জোহরা, মনে মনে কৃতজ্ঞতা জানালো সৃষ্টিকর্তাকে।
৬.
প্রায় আধাঘণ্টা ধরে অন্ধকারে একরকম ভাবেই বসে আছে আনিস। মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছে, একসঙ্গে অনেক ভাবনা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে অনবরত, ক্লান্ত বোধ করছে সাংঘাতিক। দরজায় খুট করে আওয়াজে চমকে উঠল সে। টেবিলে আলো রেখে তড়িঘড়ি করে ফিরে যাচ্ছিল কোরবান, পিছু ডাকল সে, "দাঁড়াও! পালাচ্ছো কেন তুমি! আমার দিকে তাকাও! জোহরা তোমার মেয়ে? মিথ্যা বলবা না একদম!"
কোরবান ধীরে ধীরে মেঝেতে বসল, চুপচাপ কেটে গেল কিছুক্ষণ, স্নিগ্ধ আলোতে তার গড়িয়ে পড়া অশ্রুবিন্দু চিকচিক করছে।
"চুপ করে থাকবে না কোরবান! নিজের মেয়ের এতবড় সর্বনাশ কেন করলে তুমি? টাকার লোভে? একটা পাগলের সাথে বিয়ে দিলে? ছিঃ!"
হাত দুটো জোড় করে শব্দ করে কেঁদে উঠল কোরবান, "আল্লাহর দোহাই ডাক্তার সাব! এই কথা বইলেন না! আমি লোভী না! আমি সৈয়দ সাহেবের অনুরোধ ফেলতে পারিনাই, একদিন আমার হাত ধরে বললেন-- 'কোরবান! হঠাৎ করে যদি আমি মরে যাই, কি হবে রে, একমাত্র ছেলেটার মাথা খারাপ, তার মা শয্যাশায়ী, ভাল হবার কোন আশা নেই মরে গেলে আমার ছেলেটাকে কে দেখবে! এতবড় বিষয় সম্পত্তি কে সামলাবে, একটা মানুষ নাই! এই দুশ্চিন্তায় রাতে ঘুমাইতে পারিনা! আমি বললাম, 'কেন এত দুশ্চিন্তা করেন! আমি আছি তো! উনি বললেন, তোরও তো বয়স হইছে! কতদিন দেখবি তুই! আমি চিন্তা করে দেখলাম ভুল বলে নাই। আমি আর ক'দিন বাঁচব! নানান রোগ বাসা বাঁধছে শরীরে। অনেক ভাইবা একটা বুদ্ধি আসল মাথায়, বললাম গরীব ঘর দেখে আরশাদ বাবারে একটা বিয়ে করালে কেমন হয়! এই গ্রামে অনেক পরিবার আছে যারা নিজেদের সন্তানগো দুবেলা ঠিকমতো খাবার দিতে পারেনা, তেমন একটা পরিবার থেকে মেয়ে আনলে সারাজীবন আরশাদ বাবারে যত্নআত্তি করবে! দেইখা রাখবে। সৈয়দ সাহেবের মনে ধরল এই প্রস্তাব। শুরু হল মেয়ে দেখা, কিন্তু মানুষ যত অভাব অনটনে থাকুক, নিজের মেয়েরে কেউ পাগলের হাতে তুলে দিতে চায়না। বেশ কয়েক জায়গায় কথা বইলা হতাশ হইলাম, কেউ রাজী হয়না। আরশাদের পাগলামির সাথে গ্রামের সবাই কম বেশি পরিচিত, আগে প্রায়ই কাপড় চোপড় খুইলা দৌড় দিয়া এদিক সেদিক চলে যাইত, মাঝেমধ্যে গ্রামের মানুষের ঘরে ঢুইকা পড়ত! মহিলারা লজ্জায়, আতংকে চিৎকার করত! এমন অবস্থা বেশ কয়েকবার ঘটার পর সাবে আদেশ করলেন ঘরে আটকায়ে রাখতে। শেকল আনা হইল গঞ্জ দিয়া। তালাবন্ধ করে রাখা শুরু হলো, এত মায়া লাগত ছেলেটার জন্য! জানালা ধরে দাঁড়ায়ে থাকত সারাদিন।
তারপর একদিন সৈয়দ সাব আমার হাত ধরে বললেন 'তোর কাছে একটা জিনিস চাইব, দিবি? আমি কইলাম আমার সামর্থ্য থাকলে নিশ্চয়ই দেব সাব ! সারাজীবন আপনাগো নুন খাইছি! হুকুম করেন খালি! আমি কল্পনাও করিনাই সে আমার কলিজার উপর হাত দিবে! যখন জোহরার কথা বললেন, আমার মাথায় আকাশ ভাইঙ্গা পড়ল, কিন্তু সৈয়দ সাহেবের মুখের উপর না বলার সাহস হইলনা, তাছাড়া আমার পূর্বপুরুষ এই সৈয়দবাড়ীর কাছে অনেক ঋণী। বুকে পাথর চাপা দিয়া মেয়েটারে আমার কুরবানির দিলাম! বিয়ার দিন মেয়েটা আমার দিকে অবাক হইয়া চাইয়া ছিল শুধু! হয়তো ভাবতে ছিল, কেমন জালিম বাপ আমি!" চোখ মুছল কোরবান, "বিয়ার পর থেইকা আজ পর্যন্ত মাইয়া আমার সাথে একটা কথাও কয় নাই! জানেন! মেয়েটার খুব শখ ছিল পড়াশোনার! মেট্রিকে অনেক ভাল পাশ দিছে, হেড মাস্টার তারে দুইটা বই আর পাঁচশ টাকা দিছিলো খুশি হইয়া, আমারে স্কুলে ডাইকা বলছিল, 'মেয়েটারে পড়াইয়ো কোরবান! লেখাপড়ায় অনেক ভাল তোমার মেয়ে! কলেজ অনেক দূরে, তাই ভর্তি করি নাই। অনেক কান্নাকাটি করছিল প্রথম প্রথম মেয়েটা, পরে মেনে নিছে। গানও গাইতে পারে আমার ময়না, এত সুন্দর গান গায়! মায়ের গলা পাইছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ মুছলো কোরবান।
আনিস তাকিয়ে রইল স্তব্ধ হয়ে, কিছু বলবার মত খুঁজে পাচ্ছেনা এইমূহুর্তে। এত মায়া লাগছে! কাছে গিয়ে কুরবানকে জড়িয়ে ধরল সে। মানুষের মনের প্রবল আবেগ কিংবা শোকাচ্ছন্নতা সবসময় ভালবাসার স্পর্শ খোঁজে, যে স্পর্শ তাকে ফুলিয়ে ফাপিয়ে আরও উত্তাল করে, নিয়ন্ত্রণহীন সেই আবেগ শোক সব ভেঙেচুড়ে ভাসিয়ে শান্ত হয় ধীরে ধীরে একসময়, তারপর শীতলতা আসে মনে, শ্রান্ত হয় শরীর। আনিস অপেক্ষা করতে লাগল সেই শীতলতার! কারণ কিছু বিষয়ে কোরবানের সাথে কথা বলা দরকার। খুব দরকার! কাল সকালে চলে যাবে সে, হাতে সময় নেই! কিন্তু কিভাবে শুরু করবে বুঝে উঠতে পারছেনা। শেষ বারের মত গুছিয়ে নেয়ার চেষ্টা করল। 'আচ্ছা কোরবান, জোহরার সাথে কারো সম্পর্ক আছে? মানে আমি প্রেম ট্রেমের কথা বুঝাতে চেয়েছি।"
এক লাফে ছিটকে সরে গেল কোরবান, "ওয়াস্তাগফিরুল্লাহ! এইটা কি বললেন আপনি ডাক্তার! ছিঃ ছিঃ! এমন কথা তো মুখে আনাও পাপ! আমার মেয়েটা ফুলের মতন পবিত্র! "
তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে রইল আনিস, "জোহরা সন্তান সম্ভবা কোরবান! বমি হয়ে যাবার পর যখন আমি তাকে পরীক্ষা করছিলাম, তখন বিষয়টি ধরা পড়ল।"
বজ্রাহতের মত স্তব্ধ হয়ে রইল কোরবান, আপন মনে বিড়বিড় করতে লাগল, "এইটা অসম্ভব! অসম্ভব এইটা! আনিসের দিকে তাকালো উদ্ভ্রান্তের মত, " কোথাও ভুল হইতেছে আপনার ডাক্তার, এটা হইতেই পারেনা! কোন ভাবেই সম্ভব না। এই বাড়িতে আসার পর আমার মেয়েটা একমুহূর্তের জন্যেও কোথাও যায়নাই! কোথাও না! চোখের পাতায় আগলায়ে রাখি তারে সারাদিন। আমি কসম কাইটা বলতে পারি, কোথাও গড়মিল হইছে আপনার!"
"শান্ত হও কোরবান! আমিও ধাক্কা খেয়েছি প্রচন্ড, কারণ আরশাদ এই বাচ্চার বাবা হইতে পারেনা, সেটা তুমিও বোঝ। কিন্তু আমি তো ডাক্তার, আমার ভুল হবে কেন কোরবান?"
অপ্রকৃতস্থের মত এলোমেলো পা ফেলে কোরবান সামনে এগোলো, বিড়বিড় করে একটা কথাই বলছিল, 'এইটা অসম্ভব! অসম্ভব এইটা!"
আজ যেন একটু তাড়াতাড়িই নিস্তব্ধতা নেমে এল চারদিকে, একটানা ঝিঁ ঝিঁ পোকার একটানা শব্দও বন্ধ হয়ে গেল কিছুক্ষণ আগে। জানালায় দাঁড়িয়ে আকাশপাতাল ভেবেই যাচ্ছে একের পর এক, বেরোতে পারছেনা এই ভাবনা থেকে। কিছুক্ষণ আগে জোহরাকে দেখে এসেছে, গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন সে। রাতে কিছুই খেলোনা আনিস, খাবার মত মনের অবস্থা নেই আসলে। কোরবানের দেয়া তথ্য অনুযায়ী যা দাঁড়ায়, জোহরা ভয়ংকর এক পরিস্থিতির শিকার। ভয়ংকর এবং লজ্জাজনক! কিন্তু কি করবে সে! তার কি করার আছে! সৈয়দ সাহেবের মুখটা মনে পড়ছে বারবার, শুভ্র দাড়ি, চোখে সুরমা, লম্বা পাঞ্জাবী পাজামা পড়া মানুষ টার চেহারায় পবিত্রতাই খুঁজেছে সে সবসময়। চোখ বন্ধ করল সে, আজ চরম ঘৃনায় একদলা থুতু বেরিয়ে এলো অজান্তেই। মানুষ! কি উদ্দেশ্য? ঘৃন্য লালসা চরিতার্থ নাকি বংশরক্ষা? উহ! ভাবতে পারছেনা আর! জোহরার ঘুমন্ত নিষ্পাপ মুখটা দেখে কান্না পাচ্ছিল! কি যে অসহায় লাগছে! মানসিক যন্ত্রণায় আর অস্থিরতায় কখন যে পুরো রাত কেটে গেল বুঝতেই পারলনা সে! ফজরের আজান প্রতিধ্বনিত হচ্ছে চারদিকে! আবছা আলোয় নিজেকে অশরীরী মনে হচ্ছে তার!"
স্টেশনে পৌঁছতে পৌঁছতে সূর্য উঠে গেল, পথটা বড় দীর্ঘ মনে হচ্ছিল, ফুরোতেই চাইছিল না। প্লাটফর্মের এক কোণে নড়বড়ে কাঠের টুলটায় বসল চুপচাপ, এখান থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চলে যাওয়া ছাড়া আর কিছু করার নেই তার, মানুষ হিসেবে হয়তো এই ভাবনা অমানবিক, কিন্তু রুখে দাড়ানোর সৎ সাহস থাকেনা সবার, সেই ভীরু কাপুরুষদেরই একজন সে। তাই অন্ধকার কাটবার আগেই চোরের মত কাউকে কিছু না বলে পালিয়ে এসেছে। সে কি কাপুরুষ! না! সে কাপুরুষ নয়! অন্যের বিবাহিত স্ত্রীকে উদ্ধার করার দায়িত্ব সে কেন নেবে? কি দায় তার! আচমকা জোহরার ধাঁধাটার কথা মনে পড়ল, প্রতিটা লাইনের অর্থ জলের মত পরিষ্কার এখন তার কাছে। মেয়েটা কৌশলে এই জঘন্য ঘটনাটাই জানাতে চেয়েছিল তাকে! আহা! মুক্তি পেতে চেয়েছিল! হয়তো ভেবেছিল বাইরের সভ্য সমাজের মানুষটা তাকে উদ্ধার করতে পারবে! সেই আশার আলোটুকুও যখন নিভে গিয়েছে, তখনই কি সে নিজেকে শেষ করে দিতে চেয়েছে! কেন এত অর্থহীন ভাবনা আসছে মাথায়! সিগারেটের তৃষ্ণা পেয়েছে প্রচন্ডরকম, অস্থিরভাবে উঠে দাড়ালো সে। আশেপাশে দু'একটা দোকান থাকার কথা, কিন্তু এত সকালে কি খুলেছে এগুলো! হাঁটতে হাঁটতে ডান দিকে চলে এলো সে। বড় ব্যাগ পাশে দুএকজন যাত্রী দেখা যাচ্ছে, অলস ভঙ্গিতে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে তারা, হাত উলটে ঘড়ি দেখল আনিস, খুব বেশি সময় নেই, ১৫/২০ মিনিট হাতে আছে আর। সদ্য খোলা একটা দোকানের সামনে দাঁড়ালো, সিগারেট ধরিয়ে সামনে এগিয়ে ব্যাগগুলো দেখে নিল একবার, ডাক্তারী সরঞ্জাম ছাড়া অবশ্য ব্যাগে তেমন দামী কিছু নেই। ট্রেনের হুইসেল শোনা যাচ্ছে, সামনে পা বাড়ালো আনিস, ব্যাগ গুলোর কাছে পৌঁছামাত্র দূরে ট্রেনের মাথা চোখে পড়ল, দ্রুত এগিয়ে আসছে এদিকে। তাকিয়ে রইল আনিস, মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিলো রুপগঞ্জকে বিদায় জানানোর। পেছনে কারো অস্তিত্ব অনুভূত হতেই চমকে ঘুরে দাঁড়ালো সে, "কোরবান, তুমি! কি ব্যাপার!"
"কাউরে কিছু না বইলা চইলা যাইতেছেন! আমি কি দোষ করছি কন? এই বোঝাগুলা টাইনা একা একা এত দূর আসছেন আপনি!"
"কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছিলো না কোরবান। বাদ দাও, জোহরার শরীর কেমন! ভাল আছে তো!"
কোরবানের বিশাল দেহের আড়াল থেকে বোরকায় ঢাকা একটা শরীর বের হল ধীরে ধীরে, বিস্ময়ে হতবাক আনিস! অনাবৃত ফর্সা পা দুটো অনেক চেনা তার। একসংগে অনেক প্রশ্ন নিয়ে সে কোরবানের দিকে তাকালো।
"ডাক্তার সাব, মেয়েটার জীবনটা আমি নষ্ট করছি, আমার পাপের শেষ নাই! আপনি জোহরারে নিয়া যাবেন? দুইটা খাইতে দিয়েন, আপনার বাসার সব কাজ করে দেবে আমার ময়না। ওরে এই নরক থেইকা বাঁচান! একমাত্র আপনিই পারেন ওরে বাঁচাতে! আল্লাহর দোহাই লাগে ডাক্তার সাব! আপনি রাখতে না চাইলে কোন নিরাপদ জায়গায় একটা কাজের ব্যবস্থা করে দিয়েন, কাজকর্মে অনেক ভাল আমার মেয়েটা! মানুষের বাড়িতে কাজ কইরা খাক, আফসোস নাই! তবুও এই রাক্ষসের হাত থেইকা তো বাঁঁচবে! হাতজোড় করি আপনার কাছে!"
আনিস বুঝতে পারছেনা কি করা উচিৎ, ভয়াবহ সংকটে আটকা পড়েছে সে, কিছু একটা বলা উচিৎ, ট্রেনে লোকজন সব উঠে গিয়েছে, সাদা ইউনিফর্ম পড়া লাল ফ্লাগ হাতে দাঁড়ানো লোকটা কিছুটা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে, সম্ভবত বুঝতে চেষ্টা করছে বিষয়টি। চমকে উঠল হুইসেলের শব্দে, লাল ফ্লাগ নাড়াতেই ধীর গতিতে ট্রেন চলতে শুরু করল, কোরবান অসহায় চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে!
হঠ্যাৎই যেন গতি সঞ্চালন হল শরীরে, একহাতে জোহরাকে শক্ত করে ধরে দৌড়ে উঠে পড়ল ট্রেনে ! আচমকা তাল সামলাতে না পেরে পরে যাচ্ছিলো প্রায় জোহরা, দুই বাহুর দৃঢ় প্রতিরোধে শেষপর্যন্ত দুর্ঘটনাটি ঘটলোনা আর!
"ছাড়েন! ঠিক আছি আমি, লোকজন তাকায়ে আছে তো! আব্বাজান দেখতেছে!"
সম্বিৎ ফিরে পেল আনিস, চেনা মিষ্টি গন্ধটা নাকে লাগছে, স্মিত হেসে ছেড়ে দিল জোহরাকে। কোরবান ব্যস্ত হয়ে ব্যাগগুলো তুলে দিচ্ছে, দারুণ নিশ্চিন্ততা তার চোখে মুখে। ট্রেনের গতি এতক্ষণে বিন্দুমাত্র বাড়েনি, অবাক হলো আনিস, কারণ খুঁজতে সে বাইরের দিকে ঝুঁকে তাকাতেই লাল ফ্লাগওয়ালার সাথে চোখাচোখি হল, ভদ্রলোক হাসছেন। প্রকৃতি কখনও কখনও সবকিছু অনুকূলে এনে সাহায্যের হাত বাড়ায় রহস্যজনক ভাবেই, হয়তো সৃষ্ট ঘটনায় তার সায় থাকে বলেই! ভদ্রলোকের দিকে কৃতজ্ঞ চোখে তাকিয়ে রইল সে। ট্রেন কাঁপতে শুরু করেছে এবার, ক্রমশ দ্রুত হচ্ছে গতি। রুপগঞ্জ, একজন অসাধারণ বাবা আর লালফ্লাগওয়ালাকে পেছনে ফেলে ট্রেন ছুটে চলল সামনের দিকে.........।
লেখক পরিচিতি ঃ
নাঈমা পারভীন অনামিকা। বাবা: বেলায়েত হোসেন। মাঃ মাজেদা বেগম। শৈশব কেটেছে বরিশাল শহরে। বরিশাল ব্রজমোহন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজকল্যাণ বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি।
লেখালেখির শুরুটা ২০০৯ এর দিকে।শুধুমাত্র নিজের ভাললাগা থেকে শুরু করা। ২০১৬ থেকে অনলাইন ভিত্তিক লেখা শেয়ার করা শুরু করেন।ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা পাবার পর লেখার উদ্যম, আগ্রহ বেড়ে যায়। সিরিয়াস ভাবে জড়িয়ে পড়েন লেখালেখির সঙ্গে। জাগৃতি প্রকাশনী এবং পেন্সিল এর যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত প্রতিযোগিতায় অংশ করেন নিজের লেখা গল্পের পান্ডুলিপি নিয়ে এবং নির্বাচিত হন। পুরস্কার প্রাপ্ত প্রথম গল্পগ্রন্থ আসে জাগৃতি প্রকাশনী থেকে --- " বনলতা নই"( গল্পগ্রন্থ - ২০১৮ এর বইমেলা)
অন্যান্য প্রকাশিত বই:
১.ক্ষরণ(উপন্যাস) (পেন্সিল প্রকাশনী- ২০১৯ এর বইমেলা )
২.দ্য হিডেন পার্ট অব লাইফ(উপন্যাস) (পেন্সিল প্রকাশনী- ২০২১ এর বইমেলা