নাঈমা পারভীন অনামিকা :
মন্ট্রিয়ালে এই সময়টায় ভারী তুষার পড়ে। ধোঁয়া ওঠা কফি মগ হাতে আমি দাঁড়িয়ে আছি জানালার ঝাপসা কাঁচের এপাশে। এখান থেকে বেডরুমটা বেশ স্পষ্ট দেখা যায়, ক্রিস্টিনের অর্ধনগ্ন শরীর দেখা যাচ্ছে, অনাবৃত ফর্সা বুকের খাঁজে চোখ আটকে যাচ্ছে বারবার। ঘুমে কাদা হয়ে আছে সে , পরিশ্রান্ত শরীরটা এলোমেলো ভাবে ছড়িয়ে দিয়েছে বিছানায়।
চোখ সরিয়ে নিলাম আমি, মনোযোগী হলাম বাইরের প্রকৃতিতে। নরম সাদা তুলোর মত শীতল আচ্ছাদনে একটু একটু করে ঢেকে যাচ্ছে সব ! দীর্ঘসময় তাকিয়ে থাকলে কেমন ঘোর লেগে যায়।
ক্রিস্টিনের সাথে পরিচয় মাস ছয়েকের, আমেরিকান মেয়ে। কোন একটা পার্টিতে পরিচয় হয়েছিল, তারপর ঘনিষ্টতা। কাছাকাছিই থাকে, প্রতি উইকেন্ডেতে চলে আসে আমার ফ্ল্যাটে, অনেকটা সময় কাটায় এখানে। গল্পগুজব আর শরীরী ভালবাসাবাসির পর ফিরে যায় ওর আবাসে। বিছানার সঙ্গী হিসেবে তার যোগ্যতাটা বাড়াবাড়ি রকমের বলেই হয়তো আমার আগ্রহে এখনও ভাটা পড়েনি। পাশাপাশি দুজনার চাওয়া পাওয়া আর হিসেব নিকেষ কখনও কোন নির্দ্দিষ্ট গন্তব্য চায়নি বলে আমাদের মধ্যে কোন রাগ, অভিমান , দ্বন্দ নেই। একান্ত জৈবিক চাহিদার সাথে প্রেম কিংবা আবেগের সংমিশ্রণ এলেই দারণ বিরক্ত লাগে আমার ! ক্রিস্টিন বুদ্ধিমতী, এসব আবেগী অনুভূতিতে কখনও যায়নি সে , আর তাই সম্পর্কটাও প্রাণ হারায়নি ।
চুলোয় পানি বসালাম, ব্রেকফাস্টের জন্য পাস্তা বানিয়ে ফেললে মন্দ হয়না ! পানি গরম হচ্ছে, একটু একটু করে উঠে আসা বুদবুদ গুলোতে আটকে রইলাম।
শেষ কবে প্রেম ভালবাসার শিহরণ জাগানো অনুভূতি হয়েছিল মনে করে বলতে পারব না। জীবনের এই পর্যায়ে এসে মনে হয় , এসব অর্থহীন অনুভূতি হাস্যকর ! শুধু মূল্যবান কিছু সময়ের অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয় , বয়সের আবেগ আর উন্মাদনায় ভেসে যাওয়াটাকে শ্রেফ বোকামিই ভাবা যায়।
ওহ ! আমার পরিচয় দেই---- আমি নাভিদ ইফতেখার, দীর্ঘ এগারো বছর দেশ ছেড়ে প্রবাসে আছি, বর্তমানে কানাডার স্বনামধন্য একটি কোম্পানীতে কর্মরত। এই ফ্ল্যাটের বাইরে কিছু অফিস কলিগ এবং বন্ধুবান্ধব নিয়ে আমার জীবন চলমান। নাহ, চলমান বললে ভুল হবে, বেশ ভাল আছি আমি। এমন বন্ধনহীন, মুক্ত জীবন উপভোগ্য আমার কাছে।
সেদ্ধ পাস্তা ছাকুনিতে ঢেলে দিতেই গরম বাস্প ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে, আমার চোখে মুখেও ছুঁয়ে গেল তার খানিকটা। এই কণকণে ঠান্ডায় বেশ আরাম বোধ হল। দেশে থাকতে কখনও রান্না বান্নার ধারে কাছেও যাইনি, কিন্তু তারপরও এই দীর্ঘ একাকী প্রবাস জীবনে বিষয়টা ভালই রপ্ত হয়েছে, ইনফ্যাক্ট পিছুটানহীন জীবনটার মত রান্না বিষয়টাও বেশ উপভোগ করি আমি।
ক্রিস্টিনা চলে গেছে অনেক্ষণ। ছুটির দিনে পড়ন্ত দুপুরের এই সময়টায় অদ্ভুত এক বিষন্নতা গ্রাস করে আমায়। বহুদিনের চেনা কিছু মুখ, সম্পর্ক ভীড় করে মনন মস্তিষ্কে। সেটা এড়াতেই সেলফোনটা হাতে নিলাম, রেগুলার কিছু ওয়ার্ক শেষ করে চোখ স্থির হল একটা মেসেজে। গত দুদিন আগে আমার পক্ষ থেকে একটা বার্তা পাঠিয়েছিলাম একজনকে, তিনি এখনও সিন করেননি। চেনা কেউ নন, তার লেখা কিছু ফিচার পড়ে দারুণ লেগেছিল, কৌতূহলী হয়ে প্রফাইল ঘেঁটে ফেললাম, বেশ সাদামাটা চেহারার, অভিব্যক্তিতে তেমন কোন অসাধারণত্ব চোখে পড়েনি। তবে চোখে একটা স্পার্ক আছে, সেটায় আকৃষ্ট হয়ে স্ক্রল করে আরেকটু পেছনে গেলাম প্রফাইলের, হাসিটায় স্তব্ধ হলাম। এত সুন্দর, নিষ্পাপ হাসি! যান্ত্রিকতায় মুড়ে থাকা এই ব্যস্ত জীবনে এমন হাসি বহুদিন চোখে পড়েনি ! মাথায় আটকে রইল বিষয়টা। বেশ কিছুক্ষণ দ্বিধা দ্বন্দ্বে কেটে গেল, তারপর ভেবে চিনতে চারলাইনের প্রশংসা সূচক একটা মেসেজ লিখে সেন্ড বাটন চেপে দিলাম। দুদিন পরেও বার্তা প্রাপক প্রয়োজন বোধ করেন নি উত্তর দেবার ! ইনফ্যাক্ট উনি খুলেই দেখেননি !
২
জরুরী কিছু জিনিষপত্র কিনতে বাইরে যেতে হচ্ছে। আবিদের সাথেও দেখা নেই অনেকদিন, বেচারা রাগ করে আর ফোনই করেনা এখন ! আসবার সময় ওর ওখানটায় হয়ে আসতে হবে। দ্রুত তৈরী হয়ে নিলাম, নিজেকে ঢেকে নিলাম ভারী শীতের কাপড় আর মাফলারে। এসব ব্যাপারে আমি খুব সচেতন। একা প্রবাস জীবনে শারীরিক অসুস্থতা যে কতটা ভয়াবহ সেটার অভিজ্ঞতা হয়েছে আমার বেশ কয়েকবার। তাই বাধ্য হয়েই এই সচেতনতা।
আবিদের ওখান থেকে ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে গেল, ভাবী ডিনার না করিয়ে ছাড়লেনই না, বহুদিন বাদে বন্ধুর সাথে সাক্ষাৎ, তাই আবেগ আন্তরিকতার উষ্ণতা হুইস্কির বোতলের তলানীতে গিয়ে ঠেকলো, পুরো নেশায় বুদ হয়ে ঘরে ফিরলাম। তবে আমি মাতাল হইনা কখনও, অভিশপ্ত এই মস্তিষ্ক এক মুহুর্তের জন্যেও বিবেচনাহীন, অচল হয়না।
প্রচণ্ড ক্লান্ত আর অবসন্ন শরীর বিছানায় এলিয়ে দিতেই সেলফোনে আওয়াজ হল, ঘোলাটে চোখে দেখলাম এক শব্দের একটা বার্তা--- “ধন্যবাদ!” উনি জবাব দিয়েছেন শেষপর্যন্ত! আঙ্গুলগুলো চলছিল না, তবুও সাথে সাথে লিখলাম--- “কেমন আছেন ?” তারপর তাকিয়ে রইলাম স্ক্রিণে। জবাব এলোনা আর ! উত্তরের অপেক্ষার দীর্ঘ সময়টাতে হাসিমাখা মুখটা কেবলই ভাসছিল চোখের সামনে। দ্রবীভূত মনে যে অস্থিরতা টের পাচ্ছিলাম তাতে আশ্চর্য হচ্ছিলাম নিজেই ! কেন আমি এত গুরুত্ব দিচ্ছি এই ভদ্রমহিলাকে ! what’s wrong with me ? রীতিমত বিরক্ত লাগছিল নিজের ওপর ! তারপরেও স্নিগ্ধ হাসি আর দ্যুতিময় চোখের প্রতিচ্ছবিতে ভাসতে লাগলাম, কখন হারিয়ে গেলাম গভীর ঘুমে বুঝতেও পারলামনা।
ঘুম ভাঙলো ডোরবেলের আওয়াজে, মাথায় ভোঁতা যন্ত্রণা নিয়ে বিছানা ছাড়লাম। পাশের ফ্ল্যাটের জহিরভাই দাঁড়িয়ে আছেন হাসি মুখে, হাতে মাঝারি সাইজের একটা প্যাকেট, “আরও দুবার এসেছি ! এবার দরজা না খুললে সত্যি ভয় পেতাম ! কি ঘুম ঘুমাও রে ভাই !”
আমি লজ্জিতভাবে হাসলাম, “সরি ভাই! কাল খুব টায়ার্ড ছিলাম !”
গতকাল দেশ থেকে ফিরলাম, কিছু উপহার এনেছি সবার জন্য, এটা তোমার।“ প্যাকেটটা এগিয়ে দিলেন জহিরভাই। বাজার করতে যাচ্ছি, এসে কথা বলব।“ দাঁড়ালেন না উনি, দরজা থেকেই চলে গেলেন।
প্লাস্টিকের বয়ামে আঁচার, নারকেলের নাড়ু আর কিছু শুটকি। জিনিসগুলো সামনে রেখে বসে রইলাম অনেকক্ষণ। খুব যত্ন করে সরিয়ে রাখা অতীত যখন অপ্রত্যাশিতভাবে সরব হয়, তখন নিয়ন্ত্রণ হারাই কিছুটা। সারাটা সকাল আমার মন আচ্ছন্ন হয়ে রইল চিরচেনা এক দৃশ্যে, টানা লম্বা ঝুল বারান্দায় আরাম কেদারার পাশে রাখা আঁচারের বয়াম, আর জলচকিতে বসা সরু পাড়ের সাদা শাড়ীর আঁচলে ঢাকা মায়ের স্নিগ্ধ মুখটা।
ফ্রিজ থেকে দরকারি জিনিষপত্র গুলো বের করলাম, গতকালের কেনা পাবদা মাছগুলো বেশ বড় ছিল, তাই দেখামাত্র লোভ সংবরণ করতে পারলাম না, কিনে ফেললাম। টমেটো আর ধনেপাতায় মাখামাখা করে মাছ রান্নার স্বাদটা সবকিছুর স্বাদ ছাপিয়ে যায় এখনও। বহুবছর কেটে গেলেও কিছু জায়গায় আমি পুরোদস্তুর বাঙালিই থেকে গেলাম !
আজ ক্রিস্টিন আসবেনা, ডাউন সিটিতে যাচ্ছে সব বন্ধুবান্ধব মিলে ! দুপুরের খাওয়া শেষে অলস শরীর এলিয়ে দিলাম। নানা আজগুবি চিন্তার মাঝে হঠাৎই মনে পড়ল গতরাতের ভাবনাগুলো। সেলফোনটা হাতে নিলাম, ভদ্রমহিলার নামটা সুন্দর, “নিহারিকা!” আমার শেষ বার্তার জবাবটা এখনও আসেনি, অথচ দিনের বেশিরভাগ সময়েই জ্বলে থাকা সবুজবাতি জানান দেয় তার উপস্থিতি ! বেশ ভাল লেখেন একথা অনস্বীকার্য, তাই বলে এতটা ভাবগাম্ভীর্য দেখানোর কিছু নেই! মনে মনে বললাম --- “নাভিদ ইগনোর ! জাস্ট ইগ্নোর! এসব লেখক ফেখকের মেন্টালিটি ঠিক যায়না তোমার সাথে ! আকাশ আর পাতালের ফারাক ! দু একবার কনভারসেশনেই আগ্রহ হারাবে তুমি ! তাহলে কেন ঘুরে ফিরে এই অনাবশ্যক জায়গায় নিয়ে আসছ নিজেকে ! তোমার লাইফের আজকে ক্রিস্টিন, কালকে শ্যার্ণ, পড়শু ক্যাথরিন কিংবা জেনি এটাই ঠিক আছে ! অহেতুক এইসব বোরিং জঞ্জালে কেন মাথা ঘামাচ্ছো !” সেলফোন ছুড়ে টেবিলে রাখলাম, নাহ ! যায়না এসব আমার সাথে। মাথা থেকে বিষয়টা ঝেরে ফেললাম পুরোপুরি।
পুরো দুপুর ঘুমিয়ে কাটল। বিকেলের সময়টা হেঁটে এলাম কাছের ‘AT WATER’ পার্কে, ভালই লাগছিল, ছোট ছোট বাচ্চারা ছুটোছুটি করে খেলছিল বল ছোঁড়াছুড়ি করে, তাদের উল্লাস আর নির্ভেজাল আনন্দ দেখে মন ভাল হয়ে গেল আমার। ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। গরম এক মগ কফি নিয়ে বেশ আয়েশ করে বসলাম, মুভি দেখা ছাড়া বিনোদনের আর কোন মাধ্যম নেই আপাতত । তার আগে অফিসের একটা মেইল কমপ্লিট করতে হবে ! ফোনে মেইল এড্রেস খুঁজতে গিয়ে অবাক হলাম, উত্তর এসেছে--- “সরি ! ব্যস্ততার কারণে আপনার রিপ্লাই দিতে দেরী হল ! ভাল আছি ।
সবুজবাতি জ্বলছে এখনও ! আমি ঝটপট লিখে ফেললাম – “কথা বলতে পারি আপনার সাথে ?
মেইলের বিষয়টা মাথা থেকে উবে গেল। সোজা হয়ে বসলাম, সংকোচ করে লাভ নেই, আর এটা মানায়ও না আমাকে ! সরাসরি লিখে ফেললাম তাই, “ফোনে কথা বলতে চাই, যদি কিছু মনে না করেন !
বেশ অনেকটা সময় নিরবতার পর উত্তর আসলো – আচ্ছা।
একঘন্টা সাইত্রিশ মিনিট কথা হয়েছিল, কথাবার্তায় আহামরি তেমন কিছু নয় সে, আধুনিকতার রঙিন পলিশ মেশানো কথাবার্তায় অভ্যস্ত আমি শুধু মুগ্ধ হয়েছিলাম তার সহজ সরল অভিব্যক্তিতে। কোন কৃত্রিমতা নেই, ঢং নেই, কি অবলীলায় স্বাচ্ছন্দে মনের কথাগুলো বলছিল!
রাতে রঙিন তরল পানীয় গ্রহনের অভ্যেসটা পুরোনো, আজ ঠান্ডাটা বেশী হওয়ায় একটু বেশীই খেয়ে ফেললাম ! ঝিমঝিম একটা ভাব হচ্ছিল শরীর জুড়ে। আর মনজুড়ে বিরাজ করছিল নিহারিকা ! অদ্ভুত একটা ভাললাগায় আচ্ছন্ন হচ্ছিলাম ক্রমশঃ। কানে বাজছিল অকপটে বলা তার কথাগুলো আর রিনরিনে হাসির শব্দ !
দীর্ঘ প্রচেষ্টায় বাঙালিপনার সব আবরণ ছুড়ে ফেলে দিয়ে যেঁ আমি সাদা চামড়ার সংস্কৃতি , কৃষ্টি- কালচারে নিজেকে অভ্যস্ত করে ফেলেছি, সেই আমি এমন অচেনা বুনো ফুলের সুগন্ধে শিহরিত হচ্ছি ! এবসার্ড ! অসংলগ্ন পায়ে বেড সাইডে বড় আয়নাটার সামনে দাঁড়ালাম, আয়নার পাঁচ ফিট এগারো ইঞ্চি উচ্চতার সুঠাম দেহী প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে হাসলাম, "হাই নাভিদ ! এসব কি? কলেজ পড়ুয়া ছেলেদের মত কি শুরু করেছো এসব ? লাইনে আসো বুঝলা ? কোথাকার কোন নিহারিকা ! চেনোনা, জানোনা ! হঠাৎ কি হয়েছে তোমার ? কিসের এত অস্থিরতা! আয়নার নাভিদ ঠোঁটের কোণে হাসি নিয়ে ঝাপসা হচ্ছিল ধীরে ধীরে, আর আমি বিছানার উষ্ণ আরাম টুকুতে সমর্পণ করলাম অগোছালো নাভিদকে।
৩
ব্যস্ততার দিন শুরু হল ! কাজের চাপে দম ফেলার সুযোগ পর্যন্ত পাচ্ছিনা। অফিসিয়াল কিছু জটিলতার সমাধানে সীমাহীন ব্যস্ততায় জড়িয়ে গেলাম। আমার ব্যক্তিগত জীবন যাপনে যার প্রভাব পড়ছিল প্রচন্ডভাবে।! টানা দুসপ্তাহ দিনের শেষ আর শুরুর হিসেবটাও ছিলনা ! প্রতিদিনের খাওয়া, ঘুম, গোসল সবকিছুতে অনিয়ম হচ্ছিল ! আয়নায় দাঁড়িয়ে বেপরোয়া ভাবে বেড়ে যাওয়া চুল গুলো দেখে অনেকবার ভেবেছি, সেলুনে যাওয়া খুব জরুরী। কিন্তু সে সময়টুকু আর বের করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। মাকে ফোন দেয়া হয়নি এর মধ্যে একবারও ! এমন ওলট পালট হয়ে যাওয়া জীবনে আশ্চর্যজনকভাবে যে কাজটা আমি প্রতিদিনই নিয়ম মেনে করেছি তা হল , নিহারিকার বার্তার জন্য অপেক্ষা !
কেন ! এই প্রশ্নের উত্তর নেই আমার কাছে। প্রতিবার ফোনে কথা হবার পর কি এক অদ্ভুত কারণে আমি সম্মোহিত হয়েই যাচ্ছি প্রতিনিয়ত ! সারাদিনের হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের পর কিছু সময়ের এই কথপোকথন বুক জুড়ে পরম প্রশান্তি ছড়িয়ে দিত আমার, যার রেশ ছড়িয়ে থাকত জেগে থাকার পুরোটা সময়! এত স্নিগ্ধ ভাললাগার অনুভূতি থেকে নিজেকে বঞ্চিত করার অপরাধ কেমন করে করি ! আর তাই প্রাত্যহিক জীবনের অগণিত কাজের ভীড়ে বিশুদ্ধ অক্সিজেন নেবার ছোট্ট এক টুকরো আকাশ আপনা থেকেই আপন হল, যার নাম—নিহারিকা !
পরপর দুই উইকেন্ডেতে ক্রিস্টিন কে সময় দেয়া হয়নি, ইনফ্যাক্ট সম্ভব হয়নি। অফিসের প্রচন্ড ব্যস্ততায় অন্যান্য ব্যক্তিগত চাহিদাগুলোর মত ক্রিস্টিনকেও বাদ দিতে হয়েছিল বাধ্য হয়ে। তাই আজ সকাল সকাল আমিই ফোনে ডেকে আনলাম। রান্না করতে করতে ওর গল্প শুনছিলাম, হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে ক্রিস্টিনের গল্প বলার ধরণটা বাচ্চাদের মত। দু মগ কফি নিয়ে ওর সামনাসামনি বসতেই উঠে দাঁড়াল, আমার চেয়ারের হাতলটায় বসে বাঁহাতে জড়িয়ে ধরল গলা। তাল সামলাতে গিয়ে আমার হাতের মগ থেকে কিছুটা গরম কফি ছলকে পড়ল সবুজ কার্পেটে ! মেজাজ খারাপ হল, বললাম – ‘রিল্যাক্স ডার্লিং !’
কফির মগে আর তৃতীয় চুমুক দেয়া হলোনা, কফির দ্বিগুণ উত্তপ্ততায় আমি উষ্ণ হতে লাগলাম ক্রিস্টিনের চুম্বকীয় কামনার উত্তাপে। বুঝতে পারছিলাম দুটো উইকেন্ডের বিরতিতে তার আগ্রাসী উন্মাদনা উত্তাল হয়ে আছে। বেশ কিছুক্ষণ পর সোনালী চুলগুলো দুহাতে সরিয়ে সে অবাক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো—“What happened ? kiss me !”
আমি ধাতস্থ হলাম, ঠোঁট ছোঁয়ালাম ওর ঠোঁটে, বুকে, তারপর আরও গভীরে ! জেগে ওঠা শরীরের প্রলয়ঙ্করী ঝড় থেমে পুরোপুরি শান্ত হবার পরও লেপ্টে রইলাম দুজন। তারপর শ্রান্ত অবসন্ন শরীর এলিয়ে দিলাম বিছানায়।
৪
দীর্ঘ প্রবাস জীবনে বহু অতৃপ্তির মধ্যে অন্যতম হল নিজের ভাষায় কথা বলতে না পারা। নকল হাসি আর গায়ে পড়া কৃত্রিম আন্তরিকতায় পরিপুষ্ট এই বিদেশী ভাষার কনভারসেশনে মাঝে মধ্যে হাঁপিয়ে উঠি আমি। মন খুলে নিজের ভাষায় কথা বলাটাও যে শরীরী চাহিদার চেয়ে কোন অংশে কম নয় , সেটা এমন পরবাসী না হলে হয়তো উপলব্ধিই হতোনা কখনও। অতৃপ্তির এই জায়গাটুকু কানায় কানায় পূর্ণ করেছে নিহার।
অনর্গল কথা বলতাম আমি ! ফোনের ওপাশ থেকে শুধু হু হ্যাঁ , মাঝে মাঝে দুয়েকটা প্রশ্ন আর হাসি ! আমি সব বলতাম নিহারকে! আমার পরিবার, পড়াশোনা, ইউনিভার্সিটি, প্রথম প্রেম, তারপরের প্রেম, প্রথম চাকরী, বিয়ে, বিচ্ছেদ ! সব বলতাম। কেন যেন ভাল লাগতো বলতে, অনেক স্বস্তি আর নিশ্চিন্ততা নিয়ে বলেই যেতাম অবিরাম ! এমনকি অগণিত শরীরী প্রেমের গল্পগুলোও গোপন রাখিনি ! মনে হত ওকে সব বলা যায়, সব। নিহার খুব মনোযোগ দিয়ে চুপচাপ শুনে যেত আর হাসতো, মাঝেমাঝে দুয়েকটা প্রশ্ন করত শুধু।
গত সপ্তাহে অফিসের বাই উইকলি মিটিংয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, তার মধ্যে আমাকে এবং আমার টিমকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে মার্কেটিং সেকশনকে একটা ট্রেনিং প্রভাইড করার জন্য। ভয়ংকর প্যারার বিষয়! রেগুলার ডিউটির পাশাপাশি ট্রেনিং এর সব আয়োজন সারতে হচ্ছে। গুরুত্বপুর্ণ বিষয় বলে এই দায়িত্ব ভাগাভাগি করে নেয়ার ঝুঁকিও নিতে পারছিনা। চাকরীর উপর বিরক্তি ধরে যাচ্ছে ! টানা ডিউটির পর বাসায় ফিরে কোন রকম নাওয়া খাওয়া সেরে আবার ল্যাপটপ নিয়ে বসা, রাত জেগে ট্রেনিং শীট, অন্যান্য পেপারস রেডি করা ! জাস্ট পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম।
টানা পনের দিনে ট্রেনিং এর পাট চুকলো, বেশ সফল ভাবে আমরা ট্রেনিং শেষ করতে পারলাম, হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম পুরো টিম ! পরদিন ছুটি নিয়ে ফেললাম, বিশ্রাম দরকার। বাসায় ফিরে গোসল করে লম্বা ঘুম দিলাম। প্রায় এক মাসের ধকল শেষে শান্তির ঘুম !
সকালের স্নিগ্ধ আলোর রেশ চোখে পড়তেই ঘুম ভেঙে গেল। ঘড়ি দেখলাম, ৭:১০ । আরও কতক্ষণ ঘুমানো যায় অনায়াসেই ! কম্বলটা জড়িয়ে নিলাম আবার। হাত বাড়িয়ে ফোনটা টেনে নিলাম।এত ব্যস্ততার মাঝেও নিহারকে কয়েকবার মেসেজ দিয়েছি আমি, আশ্চর্য! সে একটা মেসেজও সিন করেনি। অসুস্থ হল নাকি ! সরাসরি ফোন দিলাম, একবার, দুবার, তিনবার ! আজব ! ফোন রিসিভ হলোনা !
পুরো দিনটা বাসায় আমি ! কম করে হলেও ত্রিশ বার ফোন দিয়েছি , রিং হচ্ছে কিন্তু ফোন ধরছে না । প্রচন্ড অস্থিরতা নিয়ে মেসেজ লিখলাম--- নিহার !!!!! কি হয়েছে! ফোন ধরছনা কেন !
ওপাশ থেকে কোন সাড়া এলনা। আবার লিখলাম, তারপর আবার, আবারও ! কিন্তু কোন জবাব নেই ! কিছুক্ষণ পায়েচারী, গান শোনার চেষ্টা, মুভি দেখা ! কোনকিছুতেই নিহারের বিষয়টা মাথা থেকে তাড়াতে পারলাম না ! শেষ বিকেলে বের হলাম , প্রচন্ড মন খারাপ নিয়ে হাটতে লাগলাম উদ্দেশ্যবিহীন ভাবে ! ভেবে ভেবে কোন কূল কিনারা করতে পারছিলাম না, কি হতে পারে মেয়েটার ! খারাপ কিছু ! না ! কেন এসব ভাবছি ! নিহার ভালো আছে, অবশ্যই ভাল আছে !
৫
তুষারপাত বন্ধ হয়েছে, এখন প্রতিদিন ঝলমলে রোদের আলোয় সকাল হয়, আমার ফ্ল্যাটের ব্যালকনিতে প্রতি সকালে একফালি রোদ এসে পড়ে, আমি ছোট্ট চেয়ারটাতে বসে সেই উত্তাপ্টুকু নেই ! কারণ এখানে রোদের বড় অভাব, বছরের এই সময়টা ছাড়া বাকিটা সময় কাটে প্রায় সূর্যের স্পর্শ ছাড়াই।
আজ প্রায় তিন মাস, নিহারিকার সাথে আমার যোগাযোগ নেই। প্রথম দিকে দারুণ অস্থিরতা নিয়ে প্রতিদিন একের পর এক ফোন দিয়ে যেতাম, তারপর মেসেজ ! আবেগে কিছু বিবেচনা হারিয়েছিলাম , সেগুলো ফিরে আসতেই আমি বুঝলাম সে ভাল আছে এবং সুস্থ আছে। তার সব কিছুই স্বাভাবিক গতিতে চলছে , কৌশলে সবুজবাতির অস্তিত্ব বিলীন করা হলেও অনলাইনে তার উপস্থিতি আগের মতই। নিয়মিত তার লেখাও আসছে বিভিন্ন জায়গায় ! শুধুমাত্র আমার ক্ষেত্রেই তার এই আশ্চর্য নিরবতা ! কিন্তু কেন ?
প্রথমে দুশ্চিন্তা, পরে রাগ-অভিমান, তারপর আত্মসম্মানে ভাঙ্গন ! এই ধাপগুলো একে একে অতিক্রম করে এখন অনেকটা শীতল আমি। প্রচন্ড বিস্ময় ঘেরা একটা প্রশ্ন শুধু বুকে আটকে আছে--- কেন নিহারিকা?
ডোরবেলের আওয়াজে উঠে দাঁড়ালাম, প্রমা এসেছে। পরপর কয়েকবার ক্রিস্টিনকে ফিরিয়ে দিতে হয়েছে, সেটা অফিসের ব্যস্ততা, ব্যক্তিগত অস্থিরতা সব মিলিয়েই। তাই আপনা থেকেই সম্পর্কে নেমে এসেছিল শীতলতা। ক্রিস্টিন আর আসেনি, হয়তো খুঁজে নিয়েছে অন্য কাউকে ! দরজা খুলে দিতেই হাস্যজ্জল প্রমা পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢুকলো। বাংলাদেশ থেকে এসেছে বেশ কয়েক বছর, এখানে একটা হাসপাতালে জব করে, হাসবেন্ড নেই। বয়সে আমার থেকে দু এক বছরের ছোট হবে, আবিদের বাসায় পরিচয়। দেশে তার বারো বছরের একটা মেয়ে আছে, মায়ের কাছে থাকে। এসব গল্প তার কাছ থেকেই শোনা। প্রমার সাথে ঘনিষ্টতায় আগ্রহ আমারই বেশি ছিল। অথচ এখানের বাঙলি মেয়েদের আমি এড়িয়ে চলতাম সবসময়! চাহিদা আর ইমোশনের জগাখিচুড়ী পাকাতে জুড়ি নেই তাদের। ফিজিক্যাল এটাচমেন্টের পরই এরা ভালবাসা বাসিতে চলে যায়, তৈরী করে নানা অপ্রস্ততকর পরিস্থিতি। তাই আমার স্ট্রং প্রিন্সিব্যালিটিগুলোর একটা ছিল--- নো বাঙালি ! কিন্তু হঠাৎ কেন এই আগ্রহ ! অনেক প্রশ্নের মত এর উওরও আমার অজানা।
আমার ফ্ল্যাটে আজ প্রথম এসেছে প্রমা। তার চোখে মুখে তীব্র ভাললাগার দ্যুতি ছড়িয়ে আছে। আমি তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ তারপর ধীরে ধীরে কাছে এগোলাম। অদ্ভুত শিহরণে প্রমার ঠোঁট কাঁপছিল, অবনমিত হচ্ছিল চোখের দৃষ্টি । আমি দুহাতে তাকে কাছে টানলাম, হিংস্র ঠোঁট দুটো নামিয়ে আনলাম ঈষৎ গোলাপি ঠোঁটে। কিন্তু শেষমুহুর্তে কিছু একটা হল, থেমে গেলাম আমি, মুখ ঘুরিয়ে সরে দাঁড়ালাম কিছুটা। প্রচন্ড বিস্ময় নিয়ে প্রমা তাকিয়ে রইল অনেকক্ষণ , তারপর কাছে এলো, “কি হয়েছে নাভিদ ! এনিথিং রঙ ?”
মুখ ফেরালাম না আমি, বললাম—“তুমি আজ চলে যাও প্রমা, প্লিজ !”
প্রমা কথা বাড়ায়নি, কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিল আমার দিকে, সে দৃষ্টিতে অপমানবোধ আর ক্রোধের সংমিশ্রণ ছিল তীব্র। তারপর ঝট করে দরজা খুলে চলে গেল। দরজা বন্ধের প্রচন্ড ধাক্কায় দেয়ালে ঝোলানো পেইন্টিংটা পড়ে গেল মেঝেতে। কাঁচ ভাঙ্গা ঝনঝন শব্দ ছড়িয়ে পড়ল ঘরটাতে।
বেশ অনেকটা সময় পার হয়ে যাবার পর স্বাভাবিকতা ফিরে আসল আমার চিন্তাধারায়। ফ্রিজ খুলে আস্ত বোতল বের করলাম, বহুদিন আয়েশ করে পান করা হয়না! প্লেটে কিছু রোস্টেড কাজু আর চিপস সাজালাম, গ্লাস, বরফ আর স্টেরিওতে প্রিয় গজল ! আমার এই একান্ত জগতে দীর্ঘ সময়ের বিচরণ ক্লান্ত করেনা আমাকে, শুধুই প্রশান্তি দেয়, পরম প্রশান্তি !
আমার দৃষ্টি, শরীর মন যখন পুরোপুরি অবসন্ন ঠিক তখন নিহারকে দেখতে পেলাম, শাড়ির আঁচল কোমরে গুঁজে কিচেনে কাজ করছে ! নাকের ডগায় আর কপালে জমে আছে বিন্দু বিন্দু ঘাম ! নাকের নাকছবিটার মতই চিকচিক করছে। গালের পাশ বেয়ে নেমে আসা অবাধ্য চুল গুলো বড্ড জ্বালাচ্ছে তাকে। আশ্চর্য! আমি কি স্বপ্ন দেখছি ! নাহ, জেগেই তো আছি ! আমার মস্তিষ্ক এখনও অচেতন হয়নি ! তাহলে কিভাবে সম্ভব ! এলোমেলো পা ফেলে সামনে এগোলাম আমি, স্পর্শ করতেই নিহার ফিরে তাকালো, স্মিত হেসে কাছে এল। হ্যাঁ সত্যি তো নিহার ! আমি দুহাতে ঘামে ভেজা মুখটা তুললাম, খুব যত্ন করে সরিয়ে দিলাম ঘামে লেপ্টে থাকা চুল গুলো। গাঢ় স্বরে ডাকলাম-- নিহার ! সে জবাব দিলোনা, আমাকে জড়িয়ে বিছানায় নিয়ে শুইয়ে দিল, ঠিক মাথায় কাছটায় বসে হাত ডুবিয়ে দিল চুলে। গা থেকে ভেসে আসা মিষ্টি একটা সুবাসে আচ্ছন্ন হচ্ছিলাম, চোখের পাতা ক্রমশঃ ভারী হতে লাগল আমার।
টিকিট আর প্রয়োজনীয় ফর্মালিটিস গুলো সেরে ঘুরে ঘুরে কিছু শপিং করলাম। দেশে ফেরা মানেই আত্মীয় পরিজন বন্ধু বান্ধবদের জন্য কিছু উপহার সামগ্রী সঙ্গে নিয়ে যাওয়া। এটা একটা অলিখিত নিয়ম, ভালোও লাগে অবশ্য! কাউকে উপহার দেয়ার মধ্যে অদ্ভুত একটা আনন্দ লুকিয়ে থাকে।
গত চারদিন থেকে মায়ের ব্যাপারে কথা হচ্ছে বড়পার সাথে, মায়ের শরীরটা বেশ খারাপ ! হসপিটালাইজড করা হয়েছে গতকাল। বিপি, সুগার লেবেল প্রচন্ড ভাবে ফল করেছে। হঠাৎ এমন কেন হল বুঝতে পারছিনা। মায়ের শারীরিক কন্ডিশন তার বয়সী অন্যান্যদের চেয়ে তুলনামূলকভাবে সবসময়েই অনেক ভাল, কারণ তিনি ব্যক্তিগত ভাবে অনেক সচেতন। আপার বক্তব্য অনুযায়ী গত এক সপ্তাহ ধরে মা দারুণ অনিয়ম করছেন সবকিছুতে, বারবার আমার কথা বলছেন, কান্নাকাটি করছেন আমার জন্য। একছেলে হিসেবে পাকাপাকি ভাবে আমার প্রবাসে থাকার বিষয়টায় ঘোর আপত্তি ছিল মায়ের শুরু থেকেই। তবে দৃঢ় ব্যক্তিত্বের কারণে আবেগাপ্লুত হয়ে মাকে কান্নাকাটি করতে কখনই দেখিনি।
মায়ের বিষয়টা বুঝতে চেষ্টা করলাম আমি। মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যায় যদি যাই, একজন মানুষ তার চিন্তা-চেতনা, নীতিবোধে কিংবা ব্যক্তিত্বে যতই দৃঢ় হোক, সবসময় একই ধারায় স্থিতিশীল বা অবিচল থাকতে পারেনা। যাপিত জীবনে কখনও না কখনও এই বোধ অনুভূতিতে ভাঙ্গন আসে, স্খলন হয়, এলোমেলো হয় গোছানো অভিব্যক্তি। মায়ের ক্ষেত্রে হয়তো সেটাই হয়েছে।
এমন একটা পরিস্থিতিতে সন্তান হিসেবে তার কাছে গিয়ে দাঁড়ানো দায়িত্ব আমার। তবে এমন দায়িত্ব গত এগারো বছরে বেশ কয়েকবার সামনে এলেও আমি এড়িয়ে গেছি সযত্নে। কিন্তু এবার এড়াতে মন সায় দিলোনা। কি অদ্ভুত কারনে নিজেকে দায়িত্ববান হিসেবে প্রমাণের ঝোঁক চেপে গেল। এই অদম্য ঝোঁকের অন্তর্নিহিত বিশেষ কোন কারণ আছে কিনা, হৃদয়ের এই ভাবনাটুকুকে মস্তিস্কের বিচার বিশ্লেষণের ধারেকাছেও ঘেঁষতে দিলাম না। কারণ আমি বিশ্বাস করি কিছু একান্ত গোপনীয়তার প্রকাশ অস্বস্তি জাগায়। আর তাই একটা স্বস্তিকর যুক্তি সাজিয়ে নিলাম মনে মনে----- অনেক কিছু থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে খোলসে আবৃত হলেও অমানুষ হতে পারিনি এখনও! সেজন্যই দেশের সব বন্ধন থেকে সর্বদা বিলুপ্ত হবার প্রচেষ্টারত এই আমি দেশে ফিরছি অবশেষে!
৬
প্রথম দিনটা মায়ের কাছেই ছিলাম আমি ! কখনও জড়িয়ে ধরে, কখনও পাশে শুয়ে, কখনও হাত ধরে ! খুব জরুরী কিছু ছাড়া কাছ ছাড়া হইনি একদম ! এতটা বছরের দূরত্বের হাহাকার এত অল্প সময়ে ঘোচেনা, শীতল একটা প্রলেপ পড়ে হয়তো। মায়ের দীর্ঘদিনের জমানো অভিমান ভরা চোখের জলে তাই প্রশান্তির ঝিলিক ঠিকই ছিল, যা নজর এড়ায়নি আমার।
আজ প্রথম বের হলাম। একসময়ের অতি পরিচিত যে শহর, সময়ের আবর্তনে আজ অচেনা প্রায়। সাজিদের বাসার উদ্দেশ্যে বের হয়েছি, আমার স্কুল ফ্রেন্ড সে। বনানীর ২০৬/৪ এর ওদের বাড়ীটা নিশ্চয়ই পালটে যায়নি! তবুও মনে শঙ্কা নিয়ে এগোলাম। আশ্চর্য হলেও সত্যি, সাজিদের কোন ফোন নম্বর নেই আমার কাছে। ফেসবুকের বদৌলতে শুধু জানি সে এখনও এবাড়ীতেই থাকে।
খুঁজে পেলাম অবশেষে। সারপ্রাইজিং, তীব্র অভিমান, মারামারি, সময়ে যুক্ত হওয়া তার পরিবারের সাথে পরিচয়, এই পর্বগুলো শেষ হতে অনেকটা সময় চলে গেল। সাজিদের একের পর এক আবেগাপ্লুত স্মৃতিচারণ চোখ ভেজালো আমার। কিছু সময় নিরবতায় কাটল, আমি সরাসরি তাকালাম সাজিদের দিকে “একটা সাহায্য লাগবে আমার ! খুব জরুরী!”
সাজিদের চোখে কিছুটা বিস্ময়, “হ্যা বল !”
“একজনকে খুঁজে দিতে হবে! যে করেই হোক , শুধু নামটা জানি। প্লিজ হেল্প মি !”
“কাহিনী কি বস ! শুধু নাম জানি ! আর কিছু জানিনা ! এইযুগে এসে তোর মত মানুষের মুখে এমন সিনেমেটিক কথা ! জাস্ট একটু ভাব, নাভিদ ইফতেখার এই ডায়লগ মারতেছে !”
প্লিজ! ফাজলামি করিসনা। একমাত্র তুইই পারবি এ বিষয়ে সাহায্য করতে! ফেসবুকে পরিচয়। লেখালেখি করে। আর কোন ইনফরমেশন জানিনা ওর সম্পর্কে! প্রফাইলে কোন ডিটেইল নেই।
এবার সিরিয়াস হল সাজিদ-- কোথায় কোথায় লেখালেখি করে ? পেজগুলার নাম দে। চেষ্টা করব যথাসাধ্য !
"চেষ্টা না, খুঁজে দিবি তুই !"
অপলক তাকিয়ে রইল সাজিদ, তারপর স্মিত হেসে হাত রাখল হাতে, “খুঁজে দেব, প্রমিস।“
নিহারিকা সেন ; একটা প্রাইভেট ফার্মে এক্সিকিউটিভ হিসেবে কর্মরত। অফিস ফার্মগেটে, ঠিকানাঃ রোড নং-০৬, ২৪/২ তৃতীয় তলা। সম্ভবত ডিভোর্সি, নয় বছরের একটা মেয়ে আছে। ঠিকানাটা হাতে নিয়ে তাকিয়ে রইলাম দীর্ঘসময়। সাজিদের প্রতি কৃতজ্ঞতার সীমা রইল না আমার !
দ্রুত তৈরী হয়ে নেমে এলাম নিচে, গ্যারেজে ঢুকলাম। পুরোনো মডেলের এক্স করোলা! বাবার কেনা শেষ গাড়ী, এতবছর হয়ে গেছে তারপরও সার্ভিসিংটা বেশ ভাল।এটাকে নিয়েই বেরিয়ে পড়লাম তাড়াহুড়ো করে।
মালিবাগের লম্বা জ্যাম পার হয়ে যখন ফার্মগেট পৌঁছলাম তখন দুপুর ২:২৫ । লাঞ্চ টাইম ! ঠিকানা অনুযায়ী খুঁজে পেতে সমস্যা হলনা বিল্ডিংটা। গাড়ীটার একটা ব্যবস্থা করে সরাসরি চলে গেলাম তিনতলায়। স্বচ্ছ কাঁচের দরজার এপাশে দাঁড়ানো সিকিউরিটি গার্ডকে পরিচয় দিয়ে ঢুকে গেলাম ভেতরে। অস্থির চোখদুটো স্থির হল বাম পাশের দেয়াল ঘেঁষা একটা টেবিলে, আমি এগিয়ে গেলাম ধীর পায়ে। খুব মনোযোগী হয়ে ফাইলে মুখ ডুবিয়ে রাখা মানুষটার টেবিলের সামনে নিঃশব্দে দাঁড়ালাম। কারো উপস্থিতির সঙ্কেত ইন্দ্রীয়তে পৌঁছোতে যতটুকু সময় লাগে, ঠিক তারপরই মুখটা উপরে ওঠে এলো ধীরে ধীরে।
প্রচন্ড বিস্ময় নিয়ে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে টেবিলে ঢেকে রাখা গ্লাস উলটে গেল, পানি ছড়িয়ে পড়ল টেবিলে, কিছুটা মেঝেতে। দিশেহারা হয়ে সে কাউকে ডাকল, পঁচিশ ত্রিশ বছরের একটা যুবক এসেই আবার ঝড়ের বেগে চলে গেল। ফিরে এলো একটা পুরোনো তোয়ালে হাতে। পুরো সময়টা আমি পলকহীন ভাবে তাকিয়ে ছিলাম, তার আতঙ্কিত চোখ দুটো আটকে যাচ্ছিল বারবার আমার চোখে! টেবিলে রাখা হাতটা কাঁপছিল সামান্য !
নিরবতা ভাঙ্গলাম আমি, “কেমন আছ নিহারিকা ?”
খুব অস্পষ্ট ভাবে জবাব এলো, “ দেশে এসেছো কবে?”
চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে সরাসরি তাকালাম, “কথা বলতে চাই, এখানে বলব নাকি বাইরে যাবে আমার সাথে?
চারপাশের অতি উৎসাহী কিছু চোখ আর দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সে মাথা নিচু করে কিছু ভাবল একটু, তারপর বলল, “নিচে অপেক্ষা করতে পারবে একটু? বেশিনা, ১০/১৫ মিনিট ! আসছি আমি।“
অনেকটা সময় পার হয়ে গেছে, শহরের ব্যস্ততম কয়েকটা জায়গা পার হয়ে এসেছি এর মধ্যে। এতখানি সময়ে একটা শব্দও উচ্চারণ করেনি নিহার। আড়চোখে কয়েকবার তাকিয়ে ছিলাম, বাইরে মেলে দেয়া তার উদাস দৃষ্টিতে স্পর্শিত হয়নি তা। ক্রমাগত গাড়ীর গতি বাড়তে থাকায় শুধু একবার বলেছিল ‘আস্তে চালাও নাভিদ ! প্লিজ!’
সাজিদ বলেছিল বসুন্ধরার যে জায়গাগুলো এখনও যান্ত্রিক হয়নি সে জায়গার প্রকৃতি এখন সজীব, কোলাহল্মুক্ত। এমন একটা জায়গা অবশেষে খুঁজে পাবার পর গাড়ী থামালাম, ব্যস্ত পায়ে নেমে খুলে দিলাম অপরপাশের দরজা।
দীর্ঘসময় আমি তাকিয়েই রইলাম, জলপাই রঙের তাঁতের শাড়ী, বাতাসে এলোমেলো হওয়া খোলা চুল আর প্রসাধণবিহীন মুখটা ! রাস্তার দুপাশে শ্বেত শুভ্র কাশবন, ওপরে নীল আকাশ! মনে হচ্ছিল কোন অতিমানবী দাঁড়িয়ে আছে আমার সামনে ! ধীরে ধীরে সামনে এগোলাম, মুখোমুখি হলাম--- “কিছু বলবে না নিহারিকা?”
অবনত দৃষ্টি তুলে তাকিয়ে রইল সে নিষ্পাপ দৃষ্টিতে, ঠোটদুটো কাঁপছিল একটু একটু। কারো দৃষ্টিতে কেমন করে এত মায়া থাকে ! দীর্ঘশ্বাস ফেললাম, বুকের ভেতর কেমন চিনচিনে ব্যাথা হচ্ছিলো !
নিহার নিরবতা ভাঙল – “আমার নয় বছরের একটা মেয়ে আছে নাভিদ। ওর বাবা নেই।
আমি তোমার ধর্মের নই, আমার পুরো নাম নিহারিকা সেন।
নিরবতা নেমে এলো আবার, মাথা নিচু করে রইল নিহার।
“কথা বল নিহার ! আমার সাথে এভাবে হঠাত বিচ্ছিন্ন হবার কারণ বলতে হবে তোমাকে ! তোমার একটা মেয়ে আছে, তুমি আলাদা ধর্মের, এগুলোর সাথে তোমার বিচ্ছিন্ন হবার কি সম্পর্ক ? কোন কথা নেই বার্তা নেই , তোমার ইচ্ছে হল , বন্ধ করে দিলে যোগাযোগ ? why ! answer me !
স্থির চোখের কাণায় কাণায় পূর্ণ হয়ে ওঠা টলমলে অশ্রুবিন্দু সামলাতে নিহার ঠোঁট চেপে আছে অসহায় ভাবে। তারপরেও গড়িয়ে পড়ল দুয়েক ফোঁটা মুক্তদানার মত!
হঠাৎই আমার আশ্চর্য শিহরণ হল শরীর জুড়ে, দুহাতে শক্ত করে কাঁধ চেপে ধরলাম --- ভালবেসে ফেলেছিলে আমাকে? তাকাও আমার দিকে ! প্লিজ বল !
নিহার চোখ বন্ধ করল, কোমল গালদুটোতে জমা হওয়া রক্তিম আভা, কপাল জুড়ে স্বেদ বিন্দু আর নিঃশ্বাসের প্রগাঢ়তা ! আমি স্তব্ধ হয়ে রইলাম মুহুর্তটায় ! প্রচন্ড আবেগে ধরে আসা গলায় কোন মতে বললাম--- “বললে না কেন আমায় ! একটাবার বলতে নিহার ! কেন এত কষ্ট দিলে বলতো !”
পরে, অনেক পরে আমি জড়িয়ে ধরলাম নিহারকে, কোন কামনা নয়, আদিমতা নয়, কি যে আশ্চর্য এক প্রশান্তি ছড়িয়ে পড়ছিল আমার শরীর-মন জুড়ে! কিযে শীতল শান্তির আবেশ ! বহুদিনের ক্ষরায় তাপে জরায় বিধ্বস্ত বিবর্ণ এই আমি হয়তো এমনই এক প্রবল বর্ষণের অপেক্ষায় ছিলাম বহুকাল !
লেখক পরিচিতি ঃ
নাঈমা পারভীন অনামিকা। বাবা: বেলায়েত হোসেন। মাঃ মাজেদা বেগম। শৈশব কেটেছে বরিশাল শহরে। বরিশাল ব্রজমোহন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজকল্যাণ বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি।
লেখালেখির শুরুটা ২০০৯ এর দিকে। শুধুমাত্র নিজের ভাললাগা থেকে শুরু করা। ২০১৬ থেকে অনলাইন ভিত্তিক লেখা শেয়ার করা শুরু করেন। ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা পাবার পর লেখার উদ্যম, আগ্রহ বেড়ে যায়। সিরিয়াসভাবে জড়িয়ে পড়েন লেখালেখির সঙ্গে। জাগৃতি প্রকাশনী এবং পেন্সিল এর যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহন করেন নিজের লেখা গল্পের পান্ডুলিপি নিয়ে এবং নির্বাচিত হন। পুরস্কার প্রাপ্ত প্রথম গল্পগ্রন্থ আসে জাগৃতি প্রকাশনী থেকে --- " বনলতা নই"( গল্পগ্রন্থ - ২০১৮ এর বইমেলা)। অন্যান্য প্রকাশিত বই:
১.ক্ষরণ(উপন্যাস) (পেন্সিল প্রকাশনী- ২০১৯ এর বইমেলা )
২.দ্য হিডেন পার্ট অব লাইফ (উপন্যাস) (পেন্সিল প্রকাশনী- ২০২১ এর বইমেলা ।