ডিমেনশিয়া অনেকগুলো রোগ লক্ষণের সমষ্টি । ডিমেনশিয়া শব্দটি এমন একটি অবস্থাকে বোঝায় যার ফলে মস্তিস্কের বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রমে ধীরে ধীরে অবনতিঘটে যেমন— স্মৃতিশক্তি হ্রাস পাওয়া, চিন্তা ও চেতনার পরিবর্তন, কিছু বলতে গিয়ে সঠিক শব্দ খুঁজে না পাওয়া বা অন্যের কথা বুঝতে অসুবিধা হওয়া, ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন এবং সামাজিক কর্মকান্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া। ব্যাক্তি বিশেষে ডিমেনশিয়ার প্রাথমিক রূপ ভিন্ন হলেও সর্বশেষ অবস্থায় আক্রান্ত ব্যক্তিগণ নিজের শারীরিক যত্ন নিজেরা করতে পারেন না এবং জীবনের সকল ক্ষেত্রে পরনির্ভরশীল হয়ে পরেন। পায়খানা, প্রস্রাব সহ সকল কাজে অন্যের সাহায্য প্রয়োজন হয়। আর তাকে সুস্থ্য অবস্থায় ফিরিয়ে আনা যায় না। ধীরে ধীরে সমস্ত কার্যক্ষমতা চলে যায় আর বেঁচে থেকেও মৃতের জীবন যাপন করতে হয়।
ডিমেনশিয়া সমাজের সকল গ্রুপকেই সমানে আক্রমণ করে। এটা সমাজের কোন শ্রেণী, জেন্ডার, জাতিগত নৃ—গোষ্ঠী অথবা ভৌগলিক অবস্থানের উপর নির্ভর করে না। ডিমেনশিয়ার একটি ক্রমাবনতিশীল প্রক্রিয়া। এর অর্থ হল সময় বাড়ার সাথে সাথে মস্তিষ্কের গঠন এবং রাসায়নিক প্রক্রিয়া অধিক মাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আক্রান্ত ব্যক্তির স্মরণশক্তি, উপলব্ধি, প্রকাশ ক্ষমতা এবং যুক্তি বুদ্ধি ক্রমেই হ্রাস পায়। ডিমেনশিয়া কত দ্রুত হারে বাড়বে তা অনেকটাই ব্যক্তি নির্ভর। প্রতিটি ব্যক্তিই অভিনব এবং তাদের স্বতন্ত্র ভাবে ডিমেনশিয়া আক্রান্ত হয় ।
বেশ কিছু রোগের কারণে মস্তিষ্কের পরিবর্তন ঘটে যা পরিশেষে স্নায়ুকোষ (নিউরন) নষ্ট করে ডিমেনশিয়ার উদ্ভব ঘটায়। ডিমেনশিয়ার সংগে সংশ্লিষ্ট রোগের মধ্যে রয়েছে— আলঝেইমারস রোগ,ডিমেনশিয়ার সবচাইতে বড় কারণ হচ্ছে এই রোগটি, যা শতকরা ৬০ থেকে ৭০ ভাগের ক্ষেত্রেই ডিমেনশিয়ার জন্য দায়ী। ।১৯০৬ সালে জার্মান চিকিৎসক ডাঃ এলইস আলঝেইমারস্ সর্ব প্রথম এ রোগের র্বণনা দেন পরবর্তীতে তারই নাম অনুসারে এই রোগের নামকরণ হয় আলঝইমোরস্ রোগ। ডিমেনশিয়া ১০১ প্রকারের রয়েছে যেমন ভাসকুলার ডিমেনশিয়া,লিউবডি জনিত ডিমেনশিয়া, ফ্রন্টোটেম্পোরাল ডিমেনশিয়া (এতে পিকস রোগও অন্তর্ভুক্ত) ইত্যাদি।
বর্তমানে ডিমেনশিয়া পুরোপুরি ভাল করার কোন কার্যকর ঔষধ নেই যদিও ডিমেনশিয়ার সাথে জড়িত অনেক সমস্যা যেমন অস্থিরতা এবং বিষন্নতা ঔষধ দ্বারা চিকিৎসা করা হয়। যাহোক ডিমেনশিয়া আক্রান্তÍ ব্যক্তি এবং তার পরিচর্যাকারী হিসাবে আপনার বোঝা লাঘব করার অনেক উপায় আছে। এবিষয়ে আপনার ডাক্তার, সমাজসেবী ও অন্যান্য স্বাস্থ্য পেশাজীবি অথবা আলঝেইমার বাংলাদেশের পরামর্শ নিন।
ডিমেনশিয়া ১০টি গুরত্বপূর্ণ লক্ষণসমুহঃ
১। স্মৃতিশক্তি হ্রাস
২।পরিকল্পনা বা সমস্যা সমাধানে অপারগতা
৩। প্রতিদিনের চেনা কাজ সম্পূর্ণ করতে কষ্ট হওয়া
৪। স্পষ্টভাবে সময় ও স্থান সমন্ধে বলতে না পারা
৫। সাংকেতিক চিহ্ন, ছবি বা রাস্তার দূরত্ব নির্ণয়ে সমস্যা
৬। গুছিয়ে কথা বলতে বা লিখতে সমস্যা
৭। সঠিক জায়গায় জিনিসপত্র না রাখা
৮।বিচার—বিবেচনা ক্ষমতা কমে যাওয়া
৯। কাজকর্ম বা সামাজিকতায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলা
১০।মেজাজ ও ব্যক্তিত্ববোধের পরিবর্তন।
আপনার বাড়ীর বয়োজেষ্ঠ কারো উপরোক্ত লক্ষণগুলো দেখা দিলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
আমাদের দেশে ডিমেনশিয়া সচেতনতা এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে । ডিমেনশিয়া সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান অত্যন্ত সীমিত থাকায় এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির লক্ষণগুলো ও সঠিক পরিচর্যা সম্পর্কে আমরা জ্ঞাত নয়। ডিমেনশিয়া রোগের লক্ষণগুলো সম্পর্কে জানার জন্য সকলকে অনুরোধ করছি। আমাদের অজ্ঞতার কারণে ডিমেনশিয়া আক্রান্ত ব্যক্তিরা সামাজিক কুসংস্কার, ভ্রান্তধারণা,সামাজিক ংঃরমসধ,অযত্ন—অবহেলায় ও অতিকষ্টে জীবন—যাপন করছেন অথচ তাঁদেও উন্নত চিকিৎসা ও মানসম্পন্ন সেবা—যত্ন প্রাপ্য।
ডিমেনশিয়া সম্পর্কে সচেতনতার অভাবের কারণে পরিবারের সদস্যরা ডিমেনশিয়া আক্রান্ত মানুষের অধিকার পূরণের ক্ষেত্রে অনেক ধরনের সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক বাধা/চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে।
ডিমেনশিয়া রোগের সঠিক রোগ নির্ণয় ( Diagnosis) যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হবে, ততটাই তার মোকাবিলার প্রয়াস সফল হবে।রোগ নির্ণয়ের জন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ মতো ডাক্তারি পরীক্ষা করাতে হবে।কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়,রোগ শুরু হওয়ার অনেক দিন পরে চিকিৎসকের কাছে রোগী আসেন।আবার অনেকেই সঠিক ডাক্তার এবং হাসপাতাল চিহ্নিত করতে পারছেনা, তারা দ্বিধাদ্বন্দ্বে পরে যায়, তারা কোথায় যাবে?
এতে করে অনেক ক্ষেত্রে সঠিক রোগ নির্ণয় (Diagnosis) হয় না ফলে রোগীর পরিবার রোগীকে নিয়ে বিভিন্ন ডাক্তার, হাসপাতাল ও ক্লিনিক গুলোতে ঘুরে বেড়ান এতে রোগীর পরিবারের সময়ক্ষেপণ, হয়রানি ও অর্থের অপচয় হচ্ছে।
বিশ্বে প্রতি ৩ সেকেন্ডে একজন করে মানুষ নতুন ভাবে ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী ডিমেনশিয়া নিয়ে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্ব সাস্থ্য সংস্থা (WHO ) সেপ্টেম্বর ২০২১ এর রিপোর্ট অনুযায়ী প্রতিবছর প্রায় ১০ মিলিয়ন মানুষ নতুন ভাবে ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে। বর্তমানে ৫৫ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ (৮.১ % নারী এবং ৫.৪ % পুরুষ ৬৫ বছরের বেশি) ডিমেনশিয়া নিয়ে বসবাস করছে। এই সংখ্যা ২০৩০ সালের মধ্যে ৭৮ মিলিয়ন এবং ২০৫০ সালের মধ্যে ১৩৯ মিলিয়নে উন্নীত হবে বলে অনুমান করেছে। বর্তমানে যার প্রায় ৬২ শতাংশই নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশ গুলোতে এবং ৩৮ শতাংশ ইউরোপে বসবাস করে ।
২০১৫ সালে বাংলাদেশে অনুমিত ডিমেনশিয়া আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিলো ৪ লক্ষ ৬০ হাজার এবং ২০৩০ সালে তা বেড়ে গিয়ে দাঁড়াবে ৮ লক্ষ ৩৪ হাজার এবং ২০৫০ সালে সেটা হবে ২১ লক্ষ ৯৩ হাজার।(ADI. Asia pacific report)
আমাদের দেশে ডিমেনশিয়া সংক্রান্ত যে সমস্যা গুলো রয়েছে তা নিন্মে দেওয়া হলোঃ
১। সমাজের সকল স্তরে সচেতনতার অভাব।
২। ডিমেনশিয়া আক্রান্ত ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যরা চিকিৎসার জন্য সঠিক ডাক্তার এর কাছে পৌছাতে বা
চিহ্নিত করতে পারছেন না ।
৩। ডিমেনশিয়া আক্রান্ত ব্যক্তিদের দ্রুত সনাক্তকরন ও রোগ নির্ণয় হয় না।
৪। ডিমেনশিয়া খাতে সরকারি ও বেসরকারি তহবিলের অভাব ।
৫। ডিমেনশিয়া আক্রান্ত রোগীদের বিশেষায়িত হাসপাতাল নাই ।
৬। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও ডিমেনশিয়া বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের সংখ্যা সীমিত ।
৭। ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত মানুষের সুরক্ষায় সঠিক আইনি কাঠামোর অনুপস্থিতি।
৮। ডিমেনশিয়া বিষয়টি নার্সিং কারিকুলামে অন্তর্ভূক্ত না হওয়ার ফলে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও দক্ষ নার্স তৈরী হচ্ছে না।
৯। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও দক্ষ কেয়ারগিভার না থাকার ফলে ডিমেনশিয়া আক্রান্ত ব্যক্তির পরিবার গুলো বিভীন্ন সমস্যার সম্মুক্ষীন হচ্ছে প্রতিনিয়ত এবং মানসম্পন্ন সেবা—য্ত্ন থেকে ডিমেনশিয়া আক্রান্ত ব্যক্তিরা বঞ্চিত।
১০। ডিমেনশিয়া আক্রান্ত রোগীদের জন্য বিশেষায়িত পূর্ণবাসন কেন্দ্র ও ডে—কেয়ার সেন্টার নাই।
১১। জাতীয় পর্যায়ে আলঝেইমার রোগের কোন গবেষণা কেন্দ্র নাই ।
১২। ডিমেনশিয়া আক্রান্ত রোগীদের জন্য বিশেষায়িত পূর্ণবাসন কেন্দ্র ও ডে—কেয়ার সেন্টার নাই।
ডিমেনশিয়া কেন গুরুত্বপূর্ন ?
১। বিশ্বে প্রতি ৩ সেকেন্ডে একজন করে মানুষ নতুন ভাবে ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে। ডিমেনশিয়া রোগের প্রবণতা যদি এই হারে বাড়তে থাকে তাহলে এটা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। ডিমেনশিয়া একবিংশ শতাব্দির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সামজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব পরতে পারে।
২। ডিমেনশিয়া মস্তিষ্কের রোগ অথচ আমাদের দেশে ডিমেনশিয়া সংক্রান্ত সামাজিক কুসংস্কার ও ভ্রান্ত ধারণার ফলে অনেকেই ডিমেনশিয়া একটি পরিবারের অভিশাপ, আক্রান্ত ব্যক্তিকে পাগল অথবা মানসিক রোগী বলে থাকেন। ফলে পরিবারের সদস্যরা মানুষের সমালোচনা ও চক্ষুলজ্জার ভয়ে বিষয়টি আড়াল করে রাখে, এতে করে পরিবারটি ধীরে ধীরে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পরে এবং অন্ধকারময় জীবন—যাপন শুরু করে।
৩। গ্রামে বসবাসকারী সাধারন জনগন মূলত অন্ধবিশ্বাস কুসংস্কারে বিশ্বাসী তাই ডিমেনশিয়া আক্রান্ত ব্যাক্তিদের প্রথমে আদ্ধ্যাতিক শক্তির প্রভাব অথবা পাগল মনে করে বিভিন্ন অপচিকিৎসা চালায় যেমন, ঝাড় —ফুক, কবিরাজি,হাতুড়ে চিকিৎসা ইত্যাদি।
৪।ডিমেনশিয়া আক্রান্ত ব্যক্তিদের সাথে প্রতিদিন যুদ্ধ যুদ্ধ করে দিন পার করতে হয় সেবাদানকারীকে অথবা পরিবারকে এবং এ যুদ্ধ ধীরে ধীরে বেড়েই চলে ডিমেনশিয়া আক্রান্ত ব্যক্তির জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। ফলে ঐ পরিবারের মাঝে যে ভয়াবহ দূর্যোগ নেমে আসে তা অসহনীয় এবং পরিবারের প্রতিটি সদস্যের দিনকাটে উদ্বেগ আর উৎকন্ঠায় ।
৫। ডিমেনশিয়া আক্রান্ত ব্যক্তিদের সার্বক্ষনিক এবং দীর্ঘদিন সেবা——যত্ন করতে হয় তাই অধিকাংশ পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তিরা বেকার হয়ে পড়ার আশংকা রয়েছে এবং দেশে আরো বেকারত্ব বিৃ্দ্ধ পেতে পারে এছাড়াও পরিবারের কোন সদস্য তার প্রিয়জনকে সার্বক্ষনিক এবং দীর্ঘদিন সেবা——যত্নের কারণে সুস্থ্য ব্যক্তিও ডিপ্রেসন বা মানসিক রোগী হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে।
৬।ডিমেনশিয়া আক্রান্ত ব্যক্তির স্মৃতিশক্তি লোপ পাওয়ায় তার ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থ উত্তোলন করতে পারেনা কারণ তারা স্বাক্ষর দিতে ভুলে যায়।এছাড়া আক্রান্ত ব্যক্তির পরিবারের সদস্যরা তাদের বিষয়সম্পত্তি, জমিজমা নিয়েও নানান ভোগান্তির স্বীকার হন।এজন্য সুনিদৃষ্ট আইনিকাঠামো ও বিধিমালার জরুরী প্রয়োজন রয়েছে।
৭।ডিমেনশিয়া শুধু বয়ষ্ক ব্যক্তিরা আক্রান্ত হচ্ছেনা যুবশ্রেণির মধ্যেও (Young-onset dementia) ডিমেনশিয়া আক্রান্ত হওয়ার প্রবনতা দেখা দিয়েছে যেটা অনেক বড় উদ্বেগ ও চিন্তার কারণ।
৮। ২০৫০ সালে আমাদের দেশে ডিমেনশিয়া আক্রান্ত সংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় ২২লক্ষ । তাঁদের সেবা—যত্ন ও দেখাশুনার জন্য সেবাদানকারী প্রয়োজন হবে প্রায় ৪৪ লক্ষকারণ প্রতি ডিমেনশিয়া আক্রান্ত ব্যক্তির জন্য ২ জন করে সেবাদানকারী প্রয়োজন হবে সেক্ষেত্রে ২২লক্ষ দ্ধ ২ = ৪৪ লক্ষ জন। এত বিশাল সংখ্যক দক্ষ সেবাদানকারী পাওয়া যাবে না কারণ মানুষ এখন ১ টি অথবা ২ টিসন্তান নেওয়ার জন্য। এতে করে একটা রড় দুর্যোগ দেখা দিবে সেজন্য ডিমেশিয়াকে আমরা “আসন্ন দুর্যোগ” হিসাবে আখ্যায়িত করতে পারি এবং ২০৫০সালে আমাদের Millennium Development Goals অর্জনে বাধা হতে পারে।
৯। ডিমেনশিয়া আক্রান্ত ব্যক্তির জীবন—যাপন অনেক ব্যায়বহুল এবং দীর্ঘদিন বহন করতে হয় যা ব্যায়ভার বহন করা একটি পরিবারের পক্ষে খুবই কঠিন হয়ে পরে ফলে পরিবারগুলো সর্বশান্ত হয়ে পড়ছে।
১০। ডিমেনশিয়া শুধু মাত্র আক্রান্ত ব্যক্তির একক সমস্য নয় এর দীর্ঘমেয়াদী বিরূপ প্রভাব পড়ছে তার পরিবারে, সমাজে এবং দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে।
১১। অনেকে পেশা ছেড়ে দিয়ে মাতা,পিতার প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও দায়িত্ব বোধের কথা চিন্তা করে সেবা—যত্নের কাজে লিপ্ত হচ্ছেন এতে বেকারত্বের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে পেশাগত ও অর্থনৈতিক দিক থেকেও সে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
১২। ডিমেনশিয়া আক্রান্ত ব্যক্তির ২৪ ঘন্টাই সেবা—যত্নের প্রয়োজন হয়। প্রায় ১ থেকে ১৫ বছর করতে হয়। সেবাদানকারীদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও সম্মানী ভাতা দেওয়া হয় না ।
১৩। ডিমেনশিয়া আক্রান্ত ব্যক্তির পরিবারের সদস্যরা তাদের বিষয়সম্পত্তি, জমি—জমা নিয়েও নানান ভোগান্তির স্বীকার হন এ জন্য সুরক্ষার প্রয়োজণ।
ডিমেনশিয়া বিষয়টি আমাদের সকলেরই গভীর ভাবে জানা ও উপলব্ধি করা জরুরী প্রয়োজণ তা না হলে বিষয়টি সবার অন্তরালে থেকে যাবে এবং ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য এটি মোকাবেলা করা অনেক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ৭০তম এসেম্বলী গত ২২ থেকে ৩১ মে,২০১৭ জেনেভাতে ১৯৪টি দেশের প্রতিনিধিদের নিয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেখানেও ডিমেনশিয়া সস্পর্কে গুরুত্বের সাথে আলোচনা হয়। বিশ্ব সাস্থ্য সংস্থা (WHO )তাদের স্বাস্থ্য এজেন্ডাতে ডিমেনশিয়া অর্ন্তভূক্ত করেছে। প্রতিটি সদস্য রাষ্ট্রকে অনুরোধ করেন, ডিমেনশিয়া সচেতনতা বৃদ্ধি, দ্রুত ডিমেনশিয়া নির্ণয় এবং গুনগত যত্ন, ডিমেনশিয়া ঝুঁকি হ্রাস সহ জাতীয় ডিমেনশিয়া একশন প্লান গ্রহন করার জন্য।
ডিমেনশিয়া মোকাবেলার জন্য পৃথিবীর প্রায় দেশেই ডিমেনশিয়াকে এখন অধিকতর গুরুত্ব এবং মানবিক বিবেচনায় এনে নিজ নিজ দেশে জাতীয় ডিমেনশিয়া নীতিমালা প্রণয়নসহ স্বাস্থ্য তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করছে। দক্ষিন এশিয়ার মধ্যে যেমন ভারত, সিংঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, জাপান, মালয়েশিয়া, তাইওয়ান, হংকং, অষ্টে্রলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া ইত্যাদি।
ডিমেনশিয়া আক্রান্ত ব্যক্তিদেরও ভাল বসবাস, ভাল যত্ন, মর্যাদা এবং সমান অধিকার রয়েছে।যে মানুষ গুলো আমাদের লালনপালন করবার জন্য কিংবা সফল জীবন গড়ে দেবার জন্যে শত কষ্টের মধ্যেও আমাদের একটু ভালো থাকার জন্যে কঠোর পরিশ্রম করেছেন তারাতো আমাদেরই মা, বাবা। আজ তাদেরই মধ্যে কেউ না কেউ ডিমেনশিয়া নামক ভয়াবহ প্রকৃতির মস্তিস্কের ক্ষয় জনিত অসুখে আক্রান্ত।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনাকে আমি অভিবাদন জানাই অটিজম,প্রতিবন্ধীদের প্রতি আপনার অসীম স্নেহ—ভালবাসা, সহানুভূতি ও সহমর্মিতার জন্য। আপনি তাদের জন্য নীতিমালা করেছেন, ঐ নীতিমালা হওয়ার কারণে তাদের অধিকার নিশ্চিত হয়েছে, তাদের সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং তাদের ভবিষ্যত জীবন চলার পথ আরো সুন্দর হয়েছে। ফলে আন্তর্জাতিক ভাবে দেশের সুনাম বৃদ্ধি পেয়েছে ।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনার সময়পযোগী দ্রুত পদক্ষেপ ও স্বহৃদয় মহৎ উদারতার জন্য শুধু এক জন নয় অনেক ডিমেনশিয়া আক্রান্ত ব্যক্তি ও পরিবার গুলোর মুখে হাসি ফুটবে বলে আমার বিশ্বাস। সরকারী ভাবে ডিমেনশিয়াকে গুরুত্ত্ব দেওয়ার এখনই উপযুক্ত সময়। ডিমেনশিয়া আক্রান্ত ব্যক্তি ও তাঁদের সেবাদানকারীদের সমাজে সামান মর্যাদা ও অধিকার নিয়ে উভয়ে স্বাচ্ছন্দময় ভাবে জীবন—যাপন করতে পারে সেজন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহনের জন্যআপনাকে একটি জাতীয় ডিমেনশিয়া নীতিমালা প্রনয়ণ করার জন্য স্বনির্বন্ধ অনুরোধ করছি।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী,একটি জাতীয় নীতিমালা হলে ডিমেনশিয়া আক্রন্ত ব্যক্তিদের অধিকার নিশ্চিত হবে, তাদের সামাজিক মর্যাদা ও সম্মান প্রতিষ্ঠিত হবে এবং সুন্দর ও স্বাচ্ছন্দ্য ভাবে বাঁচার পথ সৃষ্টি হবে এবং তাদের পরিবার গুলোর দুঃখ ও ভোগান্তি লাঘব হবে এবং সাধারণ জনগোষ্টির দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনেব্যাপক কার্যকর ভূমিকা রাখবে এবং ডিমেনশিয়া রোগ সম্পর্কে প্রচলিত ভ্রান্ত ধারণার অবসান হবে ।সর্বোপুরি উভয়ে (রোগী ও সেবাদানকারী) অপেক্ষাকৃত ভালভাবে জীবনযাপন করতে পারবেন । ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে ডিমেনশিয়া চ্যালেজ্ঞ মোকাবেলা সহজ হবে এবং বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশ একটি ডিমেনশিয়া বান্ধব দেশ হিসাবে পরিচিতি লাভ করবে।
ডিমেনশিয়া মোকাবেলায় সফল হওয়ার জন্য নিন্মের ৮টি পদক্ষেপ গ্রহণেরজন্য আমাদের সুপারিশ সমূহ ঃ
১। জাতীয় ডিমেনশিয়া নীতিমালা প্রনয়ণ, ডিমেনশিয়া অসংক্রামক রোগের (ঘঈউ) তালিকায় অন্তর্ভুক্তি করণ এবং সর্বসাধারণকে ডিমেনশিয়া সম্পর্কে সচেতন করতে প্রতি বছর ২১ শে সেপ্টেম্বর বিশ্ব আলঝেইমারস্ দিবস সরকারি ভাবে পালন করার উদ্যোগ গ্রহণ।
২। ডিমেনশিয়া নিয়ে সুর্নিদৃষ্ট পরিকল্পনা গ্রহণ ও উচ্চপর্যায়ে একটি বিশেষ কমিটি গঠন এবং কাজের অগ্রগতির জন্য একটি মনিটরিং সেল স্থাপন করা।
৩। ডিমেনশিয়া প্রতিরোধে ও ঝুঁকি হ্রাসের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ দেওয়া ।
৪। সমাজের সকল স্তরে সচেতনতার জন্য স্বাস্থ্য শিক্ষা কর্মসূচী গ্রহণ করা, সনাক্তকরন, রোগ নির্ণয়, দেশের প্রতিটি সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ডিমেনশিয়া চিকিৎসা ওপরামর্শ কেন্দ্র স্থাপন এবং সহযোগিতা উন্নতকরণ এবংডিমেনশিয়া বিষয়টি নার্সিং কারিকুলামে অন্তর্ভূক্ত করণ।
৫। ডিমেনশিয়া বিশেষজ্ঞ হিসেবে ডাক্তারদের প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং ডিমেনশিয়া আক্রান্ত ব্যক্তিদের সঠিক সেবা—যত্নের জন্য প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মানবিক নার্স ওকেয়ারগিবার তৈরী করা। ডিমেনশিয়া আক্রান্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসা ও সেবা—যত্নের জন্য উপযুক্ত বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান আর দক্ষলোকবল তৈরি করা ।
৬। ডিমেনশিয়া আক্রান্ত ব্যক্তিরা যাতে স্বাচছন্দময় স্থাপন ভাবে জীবন—যাপন করতে পারে সেজন্য প্রতি বিভাগে বিশেষায়িত পূর্ণবাসন কেন্দ্র্র ও ডে—কেয়ার সেন্টার নির্মাণ করা।
দেশীয় সংস্কৃতির ভিত্তিতে ডিমেনশিয়া নীতিমালা প্রনয়ণ ও ডিমেনশিয়া রোগ অসংক্রামক রোগের (ঘঈউ) তালিকায় অন্তর্ভুক্তি করে সরকারি ভাবে দেশব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ এবং ডিমেনশিয়া চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় অংশীদার হওয়ার জন্য আপনাকে সবিনয়ে অনুরোধ করছি।
৭। ডিমেনশিয়া আক্রান্ত ব্যক্তির পরিবারের সার্বক্ষনিক যত্নকারীর জন্য প্রয়োজনীয় সহযোগিতা যেমন, সন্মানীভাতা, ইন্সুরেন্স ও চিকিৎসাভাতা প্রদানের ব্যবস্থা করা।
৮।ডিমেনশিয়া আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য ডিমেনশিয়া বান্ধব সমাজ প্রতিষ্ঠা করা।
ডিমেনশিয়া যুক্ত অসুস্থ্য বার্ধক্য আজ অপ্রিয় সত্য হলেও একটি কঠিন বাস্তবতা সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো প্রিয়জনও এ অবস্থায় সেবা করে না । অনেক সময় পরিবারের সদস্যরাও অধৈর্য, ক্লান্ত এবং কর্মব্যস্ততার মধ্যে পর্যাপ্ত সময় দিতে পারে না এবং তার প্রতি অবহেলা ও খারাপ আচরণ করে । আবার টাকা দিয়ে রাখা পরিচর্যাকারীগণও এক সময় পালিয়ে যায়। এসব রোগীর বিধিলিপি হল সেবাহীন অবমাননাকর মৃত্যু। আজ আমি এই বাস্তবটাই সবার সামনে তুলে ধরতে চাই । অথচ এসব ব্যক্তিরা দেশের জন্য,সমাজের জন্য,দেশের অর্থনেতিক উন্নয়নে কারো না কারো সামান্য হলেও অবদান রয়েছে । তাদের জন্য কি আমাদের কিছুই করার নেই?
ডিমেনশিয়া চ্যালেজ্ঞ মোকাবেলায় আমাদের দ্রুত জাতীয় ডিমেনশিয়া নীতিমালা ও কৌশলগত পরিকল্পনা গ্রহণ করা উচিৎ বলে আমরা মনে করি ।
ডিমেনশিয়া আক্রান্ত ব্যাক্তিরা খুব অবহেলিত হয় পরিবার ও সমাজ থেকে তাই তাদের প্রতি ভালোবাসা, আদর, স্নেহ ও বন্ধুসুলভ আচরণ করা সঠিক সেবা—যত্ন ও কমিনিউটির সহযোগিতা খুবই প্রয়োজন ।
আজ যারা ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত তারা আমাদের মা, বাবা অথবা প্রিয়জন তারা বোঝা নয় তারা আমাদের সামাজেরই অংশ ও পথ প্রদর্শক।
পরিশেষে ডিমেনশিয়া আক্রান্ত ব্যক্তিদেও প্রতিঅসীম স্নেহ ও ভালোবাসা প্রদর্শন করবেন । আসুন, আর কালক্ষেপন না করে সবাই মিলে ডিমেনশিয়া প্রচারণায় অংশগ্রহণ করি এবং ডিমেনশিয়া মোকাবিলায় সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়ে ডিমেনশিয়া আক্রান্ত ব্যক্তি এবং পরিচর্যাকারীর পাশে এসে দাঁড়াই এবং একটি ডিমেনশিয়া—বান্ধব সমাজ গড়ে তুলি।
লেখকঃ
মোঃ আজিজুল হক
সেক্রেটারী জেনারেল,
আলঝেইমার সোসাইটি অব বাংলাদেশ
alzbangladesh@yahoo.com