মো. নিজাম উদ্দিন, লক্ষ্মীপুর প্র্রতিনিধি: লক্ষ্মীপুরে প্রায় ৫৪ হাজার জেলে রয়েছে। এদের মধ্যে বেশিরভাগ নদী এবং সাগরে মাছ শিকারে নিয়োজিত। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা উত্তার নদী বা সমুদ্র থেকে মাছ শিকার করলেও তাদের জীবন মান রয়েছে একেবারে পিছিয়ে। নায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত রয়েছে এসব জেলেরা।
জেলে পরিবারের সদস্যরা নানামুখী সমস্যার মধ্যে রয়েছে। বিশেষ করে শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য সেবার দিক থেকে একেবারে পিছিয়ে রয়েছে জেলে ও তাদের পরিবারের সন্তানেরা। কোন কোন জেলে পরিবারের নেই বাসস্থান ও কবরস্থানের জায়গা। ফলে উদ্বাস্ত এবং ভাসমান জীবন-যাপন করছে অনেকে।
জেলেদের এসব জীবন এবং তাদের অধিকার রক্ষায় কাজ করছে কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট সেন্টার (কোডেক)।
‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’ এর কারিগরি সহায়তায় এবং ‘ইউকেএইড’ এর অর্থায়নে সংস্থাটি জেলেদের অধিকার উন্নয়ন ও সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিত করনের লক্ষ্যে তিন বছর মেয়াদী প্রকল্প হাতে নিয়েছে। ২০১৯ সালের জানুয়ারী থেকে শুরু হওয়া প্রকল্প শেষ হবে চলতি বছরের ডিসেম্বরে। কোডেক জানায়, প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সহায়ক হবে।
শনিবার (২৫ সেপ্টেম্বর) বিকেলে লক্ষ্মীপুর পৌর এলকার দক্ষিণ মুজুপুর গ্রামের কোডেক এর কার্যালয়ে স্থানীয় সাংবাদিকদের সাথে এক মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়। এতে জেলেদের জন্য সরকারের করণীয় নিয়ে বিভিন্ন কর্মসূচি তুলে ধরা হয়েছে। এ সময় উপস্থিত ছিলেন, কোডেক পিআরইডিএফসি প্রকল্প- লক্ষ্মীপুর এর সমন্বয়কারী মোরশেদা বেগম, প্রকল্প কর্মকর্তা মো. হানিফ, ট্রেনিং অফিসার দেব দুলাল হাওলাদারসহ লক্ষ্মীপুরে কর্মরত গণমাধ্যমকর্মীরা।
সভায় কোডেক জানায়, অবহেলিত জেলেদের স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা বেষ্টনী, কৃষি সম্প্রসারণে জেলেদের প্রবেশাধিকার বাড়ানো, জেলে পরিবারের নারী ও বালিকাদের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি করণ, তাদেরকে বিকল্প আয়বর্ধনমূলক প্রকল্পের সাথে যুক্ত করা এবং জাতীয় পর্যায়ে মৎস্য আইন নিয়ে এডভোকেসি করা প্রকল্পের উদ্দেশ্য।
প্রকল্পের প্রধান কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে- সরকার প্রদত্ত সুযোগ-সুবিধায় জেলেদের প্রবেশাধিকার বাড়ানোর লক্ষ্যে দল গঠন ও দলীয় সভা, সমন্বয় পরিষদ উজ্জীবিকরণ এবং জেলেদের সাথে সমন্বয় বৃদ্ধি করণ, জেলে সদসদের তালিকা হালনাগাদ করণ এবং সরকারী সুযোগ সুবিধা নিশ্চিতের জন্য কর্মশালা, কমিউিনিটি ক্লিনিক ও উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রের সাথে সংলাপ, গণশুণানি, স্থানীয় সরকার ও প্রশাসনের সাথে কর্মশালা এবং দিবস উদযাপন।
জেলে পরিবারের নারী ও বালিকাদের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি করন প্রকল্পের আরেকটি উদ্দেশ্য। এ লক্ষ্যে নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে সচেতনতা বৃদ্ধি, বিদ্যালয় পর্যায়ে বিতর্ক, ক্রীড়া ও চিত্রাংকন প্রতিযোগীতা এবং মা দিবস উদযাপন করা ও জেলে পরিবারের নারী সদস্যদের নেতৃত্বে উন্নয়ন করার কাজ করে থাকে কোডেক।
সংস্থাটি জানায়, নারী ও বালিকাদের বিকল্প কর্মসংস্থানের জন্য চাহিদা নিরুপন করা, নারীদের ট্রেড ভিত্তিক প্রশিক্ষণ প্রদান, উপকরণ বিতরণ, যুবকদের কারিগরী প্রশিক্ষণ প্রদান ও কাজের ব্যবস্থা করা, সরকারী-বেসরকারী সংস্থার প্রদত্ত আর্থিক সহায়তার সাথে সম্পৃক্ত করানোর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়।
কোডেক জানায়, জেলেরা মৎস্য আইন ও নীতিমালা সংশোধনের জন্য কিছু প্রস্তাবনা দিয়েছে। এর মধ্যে গ্রেফতারী পরোয়ানা ছাড়া কোন জেলেকে গ্রেফতার না করা, সমুদ্রে বিদেশী মাছ ধরার ট্রলারকে মাছ শিকারের অনুমুতি বাতিল করা, ছোট মাছ ধরার ক্ষেত্রে কম ফাঁস বিশিষ্ট জাল ব্যবহারের অনুমুতি, অবৈধ জাল তৈরীর কারখানা এবং ওই জাল বিক্রয় ও আমদানী নিষিদ্ধ বিধায় কঠোর আইন কার্যকরে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা, মৎস্য আইন ও নীতিমালায় ‘জেলে’ শব্দটি অন্তভূক্ত করা, লাইসেন্সধারী নৌকাকে সকল সুযোগ সুবিধার আওতায় আনা, নারী জেলেদেরকেও পরিচয়পত্রের আওতায় আনা, পরিচয়পত্রপ্রাপ্ত জেলে মারা গেলে পরিবারের প্রাপ্তবয়স্ক অন্য সদস্যকে পরিচয়পত্র প্রদান ও ওই পরিবারকে অর্থিক সহায়তা প্রদানের প্রস্তাবনা জানায় জেলে প্রতিনিধিরা।
কোডেক লক্ষ্মীপুর কার্যালয়ের প্রকল্প সমন্বয়কারী মোরশেদা বেগম জানান, তারা লক্ষ্মীপুরের উপকূলীয় এলাকার ১০টি ইউনিয়নের ১২ হাজার ২৫০ জন জেলেকে নিয়ে ২৪৫টি সংগঠন তৈরী করছেন। তাদের মধ্যে অর্ধেক নারী ও অর্ধেক পুরুষ। প্রতিমাসে তারা সদস্যদের সাথে সভা করেন এবং তাদের বিভিন্ন ধরণের প্রশিক্ষণ দেন।
তিনি বলেন, নদী বা সাগরে মাছের তুলনায় জেলেদের সংখ্যা বেশি হওয়ায় তারা আশানুরুপ মাছ শিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তাই জেলেদের কৃষি পেশায় সম্পৃক্ত করতে এবং তাদের পরিবারের সন্তানদের শিক্ষিত করার লক্ষ্যে কোডেক কাজ করে যাচ্ছে। ফলে জেলে পরিবারের সদস্যরা শুধু মাছ ধরার প্রতি নির্ভর না হয়ে অন্য পেশাতেও তাদেরকে অন্তভূক্ত করতে পারবে।
তিনি আরও জানায়, জেলেদের মান উন্নয়নের পশাপাশি তাদের আর্থিক সুবিধা প্রদান করছে কোডেক। করোনাকালীন সময়ে ১ম ধাপে ৪৭৫ জন জেলেকে তিনবারে সাড়ে সাত হাজার টাকা করে প্রনোদনা দেওয়া হয়েছে। ২য় ধাপে ৫শ জন জেলেকে সাত হাজার টাকা করে প্রদান করে কোডেক।
এছাড়া কমলনগরের মতিরহাটে দুটি গুচ্ছগ্রাম (কোডকে কলোনী) তৈরী করা হয়েছে। সেখানে দুইশ পরিবারকে জমিসহ ঘর দেওয়া হয়েছে। ভাসমান জেলেদের বাসস্থানের জন্য স্থানীয় প্রশাসের সাথে আলোচনা করে তাদের ঘরের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে ২৫টি ভাসমান জেলে পরিবার সরকারের পক্ষ থেকে ঘর পেয়েছে বলে জানান প্রকল্প সমন্বয়কারী।
সময় জার্নাল/এমআই