ডা. শেহজাদ হোসাইন মাসুম :
এই হাসপাতালের চিকিৎসক, প্রশাসক এবং অন্য সবাই কেন হাসপাতালটিকে এতো ভালোবাসে? এর কোন সহজ উত্তর নেই। তবে ভালোবাসার ব্যাপারটি সত্যি।
ব্যাক্তিগতভাবে আমার কোন ফ্যান্টাসি নেই। সরকারি চাকরি। যেদিন এম আই এস থেকে টুং করে একটা মেসেজ আসবে বগলে সরকারি ফাইল এবং কাঁধে একটা ব্যাগ নিয়ে পরের হাসপাতালের দিকে রওনা হবো। একা। এই হাসপাতালের জন্য আমার করা সব কাজই আমার সরকারি দায়িত্ব। কেউ খুব বেশিদিন মনে রাখবেনা। কাজ করেছি সরকারি কোষাগার থেকে বেতন পেয়েছি, আর কোন লেনদেন সরকারিভাবে নেই।
তবে আমার অনেক কিছুই মনে থেকে যাবে। আমরা অনেকে মিলেই একটি বিশাল দালানকে হাসপাতাল হিসাবে তৈরী করেছিলাম। অসংখ্য রোগি অনেক উপকার পেয়েছিলেন। পরিচালক স্যাররা সবাই অসম্ভব পরিশ্রম করেছিলেন। চিকিৎসক, নার্স, ষ্টাফরা প্রানপনে খাটাখাটনি করেছি। প্রায় শুন্য থেকে ঢাকার যেকোন সরকারি হসপিটালের চেয়ে আমাদের আটডোর রোগির সংখ্যা বেশি ছিল। ইনডোরের রোগিরা এখানে যে সেবা পেয়েছে তা অন্য যেকোন হাসপাতালের চেয়ে কম নয়। অথচ আমাদের একটা ডিপার্টমেন্টের অর্গানোগ্রামও আজ পর্যন্ত অনুমোদিত হয়নি। জেনারেল হাসপাতালের জনবল দিয়ে আমরা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সেবা দিয়ে গেছি।
এরপর কোভিড। আমাদের অবস্থা সবারই জানা। আমাদের অনেক বদনাম অনেকে করেন। কিন্তু সবাই মনের গভীরে জানেন, এটিই একমাত্র সরকারি কোভিড হাসপাতাল যারা শুরুর দিন থেকে প্রানপনে চেষ্টা করেছে। আমাদের ব্যার্থতার হিসাব সবার কাছে আছে, আর সফলতার গল্পগুলো আড়ালেই থেকেছে। তবু আমরা অসংখ্য মানুষের কৃতজ্ঞতার কথা ব্যাক্তিগতভাবে জানি। অসংখ্য দরিদ্র এবং মধ্যবিত্ত মানুষ এখান থেকে হাসিমুখে বাড়ি ফিরেছেন। কোভিডকে প্রাথমিকভাবে মোকাবেলায় সারা পৃথিবীর উন্নত হাসপাতালগুলো হিমশিম খেয়েছে। আমরাও প্রথমে অনেক কষ্টের পথে হেঁটেছি। সেই পথ আজো কষ্টেরই রয়েছে। কিন্তু আমরা শক্তিশালী হয়ে গেছি। কোভিডকে কিভাবে দুই হাতের চাপে কতটুকু পিষতে পারা যাবে জেনেছি। কখন হেরে যেতে হবে তাও জেনেছি।
আমি কোভিড আক্রান্ত হইনি আমার হাসপাতাল থেকে। আমার কার্ডিয়াক চিকিৎসার সময় আমি নিজেকে সতর্ক থাকতে না পেরে নিজদোষে আক্রান্ত হয়েছি। হয়তো আবার আমার কোভিড হতে পারে। কারন আমি নিজে এখন অনেক সতর্কতা মানতে পারিনা। শরীর পারেনা। তারপরও আশা আছে, যতদিন কোভিড আছে আমরা সবাই মিলেই লড়ে যাবো। আমার কার্ডিওলজিষ্ট এবং ডিরেক্টার স্যার অনুমতি দেওয়ামাত্র আমার কাজ আবার শুরু হবে।
এটাই কুর্মিটোলা। এখানে সবাই এরকম। যদিও আমরা জানি এটা শুধুই একটা সরকারি হাসপাতাল। যেকোন দিন এখান থেকে চলে যাবো।
তবে সেইদিন পর্যন্ত একইভাবে কাজ করবো।
অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর, অ্যানেসথেসিওলজি বিভাগ, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, ঢাকা।