শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪

আমার দেখা আমার কাল: বাংলাদেশে হিন্দু-মুসলিম | ড. মুহাম্মদ তাজাম্মুল হক

শুক্রবার, অক্টোবর ১৫, ২০২১
আমার দেখা আমার কাল: বাংলাদেশে হিন্দু-মুসলিম | ড. মুহাম্মদ তাজাম্মুল হক

আমার দেখা আমার কাল: বাংলাদেশে হিন্দু-মুসলিম  |  ড. মুহাম্মদ তাজাম্মুল হক

১ম পর্ব-

এক. আমাদের গ্ৰাম ‘ঝাটিয়া পাড়াতে’ হিন্দু বাড়ি নেই। কিন্তু পাশের গ্ৰাম বেল্টা, তুলাতলি আর পশ্চিম বাম পাড়া হিন্দু বাড়ি ছিল এবং এখনও আছে। তবে আমাদের গ্ৰামে প্রতি শনি ও বুধবার এলাকার সাপ্তাহিক বাজার বসতো এবং আশেপাশের হিন্দুরা কামার, কুমার, ধোপা, নাপিত ইত্যাদি পেশাবৃত্তিতে বাজারে কায়-কারবার করতো। বাজারের একসময় নাম ছিল "নাইত্তার হাট" (নাপিতের হাট)। শনি-বুধবার মৌকরা গ্ৰামের হিন্দু বোবা এসে পুরো বাজার ঝাড়ু দিতো আর বিকেলে টাকা উঠাতো। শীতের কুয়াশামাখা ভোরে খালি গায়ের লোকটা মগুড়া আর বেতাগাওর মেঠোপথ ধরে আসতো! দীর্ঘ মাঠ পার হয়ে আমাদের গ্ৰামে ঢুকতেই প্রথম বাড়িটা ছিলো আমাদের। পথে কুড়িয়ে নেওয়া তাল দুয়েক বার আমাদের বাড়িতে পৌঁছে দেয়ার কথা মনে পড়ে। খানিকটা বেঁকে যাওয়া ঈশত স্থূল থরথরে শরীরটা আমার স্মৃতিতে এখনো অম্লান। দোকানিরা তাকে তোলা দিতেন। আব্বাকে দেখলে হাত বাড়াতো আর আব্বাও কিছু না কিছু দিতেন। তার মুখের মুচকি হাঁসিটা উল্লেখ করার মতো। তাকে দেখিয়ে আব্বা আমাদের বলতেন-
"পরিশ্রমে ধন আনে পূণ্যে আনে সুখ
অলসতা দরিদ্র আনে পাপে আনে দুঃখ"

দুই. আমাদের পরিবার একটি রক্ষশীল পরিবার ছিলো। অন্যরা হিন্দুদের পূজা-পার্বনে তাদের বাড়িতে আড্ডা জামাতো। ‍কিন্তু আমরা জন্ম থেকে তা হারাম জ্ঞান করতাম। খুব অল্প বয়সে হিন্দু বাড়িতে মুসলিম ঢুকলে ওদের কী কী সমস্যা হয় তা আমাদের শিক্ষা দেওয়া হয়। শুনেছি ওদের রান্না করা খাবার ফেলে দিতে হয় আর পুরো ঘর গোবর দিয়ে লেপতে হয়। ইউনিভার্সিটি ভর্তির আগে কখনোও হিন্দু বাড়িতে যাওয়া হয়নি।

তিন. আমাদের বাড়ির পাশে ডাকাতিয়ার বর্ধিত অংশ “সাতমলিয়া বিল”। এ বিলের ধারে হিন্দুদের বাড়িগুলো। তাদের বাড়িগুলো কৈত্যবাড়ি নামে প্রসিদ্ধ ছিলো। শব্দটা কী কথ্য না লেখ্য ভাষার তা আমার জানা নেই। বর্ষা ও শীতকালে হিন্দু জেলেরা মাছ ধরতো। তাদের থেকে মাছ কেনার জন্য চাচার সাথে বিলের পাড়ে যেতাম। এটুকু অনুমতি ছিলো। কিন্তু বর্ষাকালে তারা নৌকা বাইছের আয়োজন করতো। এটা আমরা লুকিয়ে দেখতে যেতাম। বিলের ধারে ফুফুর বাড়ি ছিলো। আব্বা কড়াকড়ি দিলে ফুফুর বাড়ি গেছি বলতাম। তবুও আব্বা খুব কড়াকড়ি দিতেন।

চার. বাজারে চুল কাটানোর দোকান ছিলো ”রতনশীল” পরে “রতন হেয়ার কাটিন শ্যালুন”। মাসের প্রথম জুমাবার আব্বা আমাদের চুল কাটানোর জন্য ঐ দোকানে বসিয়ে দিতেন। দোকানের মালিক মরণ তার ছেলে রতনের নামে স্যালুনটা চালু করে। মরণ মিয়া এখনোও আছেন। প্রাইমারিতে ভর্তি হয়ে জানতে পারি মরণ আমাদের সহপাঠি ‘ছায়া রানি আর শোভা রানির বড় ভাই। আমরা বসলে-ই চারদিকে এক সমান করে চুল চাটাই করতো। দুয়েক বছরের মাঝেও একবার তার কাছে চুল কাটিয়েছি। ছায়া-শোভার খবরাখবর নিয়েছি।

পাঁচ. প্রাইমারি স্কুলে পড়ার সময় একজন শিক্ষিকা পেয়েছি যিনি হিন্দু। “বন্ধনা” ম্যাম এখন কেশতোলা প্রাইমারিতে আছেন। অন্য শিক্ষকরা সবাই পুরুষ ছিলেন। তৃতীয় শ্রেণীতে উঠে আমার রোল নং এক হওয়ায় ওনী খুব আদর করতেন। ছায়া-শোভা ছিলো হিন্দু দু’বোন। একসাথে একই ক্লাসের। আমার বাংলার একটি খাতা হরিয়ে গিয়েছিলো। প্রধান শিক্ষকের কাছে নালিশ দেয়ায় তিনি সবাইকে পচিঁশ পয়শা করে জরিমানা করেন। শোভা আমাকে পরদিন পচিঁশ পয়সা দিয়েছিলো সে স্মৃতি মনে আছে। সেসব টাকা অবশ্য ”দরবেশের চালতা আচার” আর “শেক্কার বাপের আইসক্রিম” কিনে শেষ! দরবেশ আর শেক্কার বাপের কথা আমাদের সময়কার কেউ ভুলবার নয়।

ছয়. প্রাইমারি পড়া শেষ করে মাধ্যমিকে ভর্তি হবো সম্ভবত সে সময়টায় আমাদের দু'ভাইয়ের জন্য আব্বা দু'টি খাট সহ মোট চারটি খাট বানানোর উদ্যোগ নিলেন। "চাপালিশ" কাঠ নিয়ে এলেন মুন্সীরহাট বাজারের একটা স'মিল থেকে। বেল্টার "যোগেস" মিস্ত্রী বাড়িতে নিয়মিত কাজ করতে থাকলেন। তার  হাতুড়ি, বাটাইল, রান্তা এসব নিয়ে লুকোচুরি খেলতাম। আব্বা মাদ্রাসা থেকে ফিরে কাজের অগ্রগতি দেখতেন আর অসম্ভব এক মায়া দেখিয়ে কথা বলতেন। আর লোকটা বিনয়-নম্রতা প্রদর্শন করতেন। মাঝে মাঝে তার সাথে রান্তা টানতাম। কান থেকে পেন্সিলটা নিয়ে কানে রাখতাম। খাটের কাজ শেষে চেয়ার-টেবিলসহ সব ভার্ণিস একসাথে করেছিলো। যোগেশ মিস্ত্রী পরে আমাদের আরো অনেক কাজ করে দিয়েছে। বাজারে তার দোকান ছিলো এবং এখনো আছে। তার দোকানে অনেক গিয়েছি। হাটের দিন বাজারের ব্যাগ রাখা, আক্কাস ডাক্তারের (তুলাতুলি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক) দোকান খুলতে দেরি হলে তার দোকানে বসা ইত্যাদি অনেক স্মৃতি মনে পড়ে। পারস্পরিক সহযোগিতার এসব স্থানে হিন্দু-মুসলিম পরিচয়ের ভেদটা কখনো মুখ্য হয়ে উঠেনি।

সাত. ১৯৯৩ সনে পাশ্ববর্তী গ্ৰামে অবস্থিত "মন্তলী উচ্চ বিদ্যালয়"-এ ক্লাস সিক্সে ভর্তি হই। আমরা ভাই-বোন মিলে তিন জন ঐ স্কুলে পড়ি। বড় বোন দশম শ্রেণি আর বড় ভাই সপ্তম। তুলাতুলী, ঝাটিয়া পাড়া, বেল্টা, মন্তলী,  খাড়ঘর, মাহিনী প্রাইমারি স্কুলের ছাত্র-ছাত্রী মিলে সবাই ষষ্ঠ শ্রেণীর অনেক শিক্ষার্থী। তম্মধ্যে জীবন চন্দ্র আর স্বপন চন্দ্র দু'জন হিন্দু। ওরা পরস্পর মামাতো-ফুফাতো ভাই। দু'জন-ই শান্ত ও ভদ্র। জীবন অপেক্ষাকৃত স্বল্পভাষী। দু'বছর তাদের সাথে পড়েছি। অষ্টম শ্রেণীতে ওঠে আমি মাদ্রাসায় চলে যাই। কিন্তু স্বপন-জীবনের সাথে সম্পর্ক বজায় থাকে। জীবন বেশি পড়াশোনা করতে পারেনি। এলাকায় টিউশনি করতো জানতাম। পরে এখন চট্রগ্রামে কিছু করে শুনেছি। মাঝে মাঝে দেখা হলে কৌশল বিনিময় হয়। ও দ্রুত সটকে পড়ার চেষ্টা করে। মনে পড়ে জীবন-স্বপন হাফপ্যান্ট আর সাদা শার্ট পড়ে স্কুলে আসতো আর আমি সাদা পাজামা পাঞ্জাবী পড়ে স্কুলে যেতাম। আমাদের সাংস্কৃতিক ভিন্নতা থাকলেও ভালোবাসা কিংবা মেশামেশির কমতি ছিলো না। জীবন খুব কম স্মৃতি নিয়ে সরে গেছে কিন্তু স্বপন আছে এক জগত জুড়ে।

আট. মাধ্যমিক স্কুলে পড়াকালিন পরিচয়বদ্ধ হওয়া স্বপনের সাথে সম্পর্কটা বহুমাত্রিক। তুলাতুলি ছিলো ওর আত্মীয়ের বাড়ি। ওর বাবার ফিশারিজ ব্যবসা ছিলো। আশেপাশের সব দিঘি-পুকুর ওদের মাছের চাষ হতো। ফলে আমি মাদ্রাসায় চলে আসলেও পথে-ঘাটে হাটে-বাজারে দেখা হতো। শুভেচ্ছা বিনিময় হতো।একদিন দেখি সাইকেল চালিয়ে আমাদের বাড়ির পাশ দিয়ে যাচ্ছে। পিছনে বড় একটা টিফিন বক্স। আমাকে দেখে থামলো। মৌকরা দিঘি বেড় দিবে তাই ওর আব্বুর জন্য খাবার নিয়ে যাচ্ছে।

নয়. ১৯৯৮ সালের ১০ অক্টোবর চন্দ্রগন্জ কারামতিয়া আলিয়া ভর্তি হওয়ার উদ্দেশ্যে বাড়ি ত্যাগ করি। সিদ্দিক, সায়েম, বাবলু, স্বপনসহ ওরা কয়েকজন ভিক্টোরিয়ায় ভর্তি  হলো আর থাকতো কুমিল্লা। এসময় আমি চন্দ্রগন্জ থেকে ”সায়েম”-কে বেশ কয়েটি চিঠি লিখেছিলাম। তারপর উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে সবাই ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি নিচ্ছে। ওরা ঢাকায় চলে এসেছে। ঢাকার মীরপুরের ঠিকানায় যেসব পত্র পোস্ট করি তাতে “পুরনো হেড মাস্টারের গলি/বাসা” লেখতে হতো মনে আছে। সিদ্দিক চবিতে সিএসসি আর সায়েম শাবিপ্রবিতে সমাজকর্মে ভর্তি নিয়ে ঢাকা ছাড়লো। আর আমি কাগজ-পত্রের জটিলতায় পড়ে এক বছর শিক্ষাবিরতিতে পড়ে গেলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি নিয়ে ক্লাস শুরু করলাম ২০০৩-এর মার্চ মাসে। ছুটির দিনগুলোতে কে কখন বাড়িতে ফিরবে এটার জন্য যোগাযোগ হতো। আমি জিয়া হলে থাকতাম। স্বপন দা তখন পিপলস্ ইউনিভার্সিতে বিবিএ পড়ে। সে সুবাধে ”নাঙ্গলকোট ছাত্র ফোরাম” গঠনকালীন তাকে ’বেসরকারী ইউনিভার্সিটি বিষয়ক সম্পাদক করলাম। পরে এআইইউভি থেকে সে এমবিএ করলো। ও প্রায় আমার কাছে আসতো। টিএসসি, মহসিন হলের মাঠ, পাবলিক লাইব্রেরীর সামনে বসে আড্ডা দিতাম।সূর্যসেন ক্যাফেটেরিয়ায় একসাথে খেতাম। এক সাথে বাড়ি যেতাম। সবাই  মিলে বিকেলে নৌকায় ঘুরে বেড়াতাম। আসর-মাগরিব-এশার নামাজ পড়তে যেতাম আর সে মসজিদের সামনে দাড়িয়ে অপেক্ষা করতো। হিন্দু-মুসলিম মিলেমিশে শবে বরাত খুজতাম রাস্তায় রাস্তায়! এলাকার গ্রামকে গ্রাম রাত-বিরাত চষে বেড়াতাম! কত বিকেল কত স্মৃতি! সব কী লেখা যায়? সব কী ভুলা যায়!

দশ. স্বপন পাশ করে ‘বিআরবি”তে চাকুরী নিয়েছে। অফিস পান্থপথ আর বাসা মোহাম্মদপুরে নুরজাহান রোড। আমি তখনো জিয়া হলে থাকি।অফিস শেষ করে সে মাঝে মাঝে আসতো। আর আমিও যেতাম মাঝে মাঝে। বন্ধু-বান্ধবরা ঢাকায় ফিরতে শুরু করেছে। দিনের আড্ডা ঢাবি আর রাতের আড্ডা জমতো স্বপনের বাসায়। থাকা-খাওয়া আর মুভি-নাটক ইত্যাদি ম্যানেজ করাও ছিলো তার দায়িত্ব। মোহাম্মদপুরে পুরনো-নতুন মিলে ওর বেশ কয়েকটা বাসায় গিয়েছি-থেকেছি বহুবার। নামাজের সময়ে সে একটা জায়গা দেখিয়ে বলতো বুয়াকে দিয়ে মুছায়ে রাখছি। আমাদের ধর্মচর্চা না ওর কোনো সমস্যা করেছে! না ওর ভাইদের! ওরা খুব যত্ম করতো আমাদের নিয়ে!

এগার. হল ছাড়বো ছাড়বো এমন সময় ঢাকায় একটি ঠিকানা থাকবার বিষয়টা মাথায় আসতে থাকে। পুর্বাচল সরকারী প্রজেক্টে আবেদন করে পেলাম না। ঢাকার আশেপাশের এলাকাগুলো তখন ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। স্বপন বিআরবির চাকুরী ছেড়ে বাংলালিঙ্কে যোগ দিয়েছে। পরিবারের চাপ না থাকায় টাকা-পয়সা জমতে শুরু করেছে। আমার হাতেও বেশ কিছু টাকা ছিলো। স্বপনের সাথে আমার ঢাবি ফ্রেন্ড তারেকের ততোদিনে বেশ পরিচয়। তিনজন মিলে একদিন ইউএসবাংলা গুলশান অফিসে গেলাম। তাদের গাড়িতে চড়ে পূর্বাচল গেলাম। প্রজেক্টা এক দেখায় পছন্দ হয়ে গেল। তিনজনের তিনটি ডুপ্লেক্স পরিকল্পনা করে তিন কাঠার একটি ফ্লট বুকিং দিয়ে দিলাম। ইতিমধ্যে দীর্ঘ তিরাশিটি কিস্তিুও পরিশোধিত হয়েছে। মাঝখানে স্বপন বাংলালিঙ্কের চাকুরী ছেড়ে ‘আরএমজি’ সেক্টরে একটি চাকুরী নিয়েছে এবং পাশাপাশি বিজনেস শুরু করেছিলো। কিন্তু ব্যবসাটা চরম আর্থিক বিপর্যয় ডেকে আনায় তার আর্থিক সংকট সমাধানে ফ্লটের এক তৃতীয়াংশটি ছেড়ে দেয়। আমরা যথাসম্ভব তার আর্থিক সংকট সমাধোনের প্রচেষ্ঠাও চালিয়ে যাচ্ছি। ইতিমধ্যে সে একটি চাকুরী নিয়ে ঢাকার বাহিরে পোস্টিং নিতে হয়েছে। 

বার. স্বপনের সাথে স্মৃতি বর্ণনাতীত। ২০১১ সাল আমার জীবনের  দুশ্চিন্তার বছর। সে সময় স্বপন আমাকে নিজ খরচে কক্সবাজর নিয়ে যায়। বেশ কয়েকদিন বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে আবার ঢাকায় আসলাম। ঢাকার আমার ঠিকানাগুলোতে সে প্রায় আসতো। ওর বিয়ের পাত্রী নিয়ে সেও তখন দুশ্চিন্তায় থাকতো। প্রায় বিভিন্ন সিভি আর পাত্রীর ছবি নিয়ে আসতো। আলাপ করতাম আর ঝাড়-ফুক দিয়ে পাত্রী দেখতে পাঠাতাম। দুয়েকটা পাত্রী আমিও দেখিয়েছিলাম। এটা মিলেতো ঐটা মিলে না! এ সময়টায় সে বেশ পুজা-পার্বন করতো। মনে পড়ে আরকে মিশন আর ঢাকেশ্বরীতে পুজায় যাওয়ার সময় আমাকেও সাথে যেতে হয়েছিলো। আরকে মিশনে ওর সাথে প্রবেশ করেছিলাম। হিন্দুদের বিভিন্ন পুজা পদ্ধতি অবলোকন করেছিলাম। 

তের. ক্লাসমেটদের মাঝে যারা গ্রামে ছিলো তারা অনেক আগেই বিয়ে করে। আমরা যারা গ্রাম থেকে শহরে এসেছি তাদের গত চার-বছরের মাঝে সবার বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে। স্বপনের বিয়ের অনুষ্ঠানটা ছিলো ভিন্ন। আমি ওর বিয়েতে অংশ নিতে বাড়িতে গেলাম। বিয়ের দিন ওর বাড়িতে গিয়ে শুনি মুসলিমদের জন্য মুসলিম বাড়ি আর হিন্দুদের জন্য হিন্দু বাড়িতে আলাদা আলাদা খাবার আয়োজন করেছে। তবে খাবার একই আর বাবুর্চিও অভিন্ন। আমার সাথে আমার বাল্যবন্ধু পশ্চিম বামপাড়ার সাইফুল ছিলো। সাইফুল মুসলিম বাড়িতে বসে খাবে। আমি ওর বিয়ে ওর বাড়িতে বসে খাবো। আমি স্বপনকে ডেকে ভালো করে প্লেট ধুয়ে খাবার দিতে বললাম। সে কয়েকজন ‍মুসলিম দিয়ে পুরো খাবার পরিবেশন করলো আর খুব খুশি হলো।বিকেলে বাড়ি ফিরে আব্বার বিভিন্ন প্রশ্ন করলেন। কোথায় অনুষ্ঠান হয়েছে? কী রান্না হয়েছে? কে রান্না করেছে? কোথায় খেয়েছি? আব্বা রিয়েক্ট করেননি দেখে বেচেঁ গেলাম। আমার বিয়ের গ্রামের অনুষ্ঠানটিতে স্বপন হাজির হয়েছে। খাতিমদার খুব সর্তকতার সাথে ওকে খাবার দিয়েছে। ওর বাবার সাথে ব্যবসায়িক সুসম্পর্কের কারণে গ্রামের একজন সর্দারকে দেখলাম তাকে খুব আদর-আপ্যায়ন করছেন। আমি খুব খুশি হয়েছি। হিন্দুর বিয়েতে ‍মুসলিম কিংবা মুসলিমের বিয়ের খাবারে হিন্দুর অংশগ্রহণ আমাদের মতো রক্ষণশীল পরিবারেও সমস্যা হয়নি। 

চৌদ্দ. এখনো বাড়ি গেলে স্বপনের আব্বা ‘সুদ্বীপ’ চাচা খবরাখবর নেন। আমার আব্বা বা ভাইয়া স্বপনকে দেখলে জড়িয়ে ধরেন। স্বপনের সাথে আব্বার যেন এক রাজ্যের আলাপ। একজন ভদ্র, নম্র, ধৈর্যশীল, জ্ঞানী-গুণী সবাইকে জয় করতে পারে। পৃথিবীতে কত রকম বুঝা-পড়া! কতো আলাপ-আলোচনা! আজও স্বপনের সাথে কয়েকবার আলাপ হয়েছে। ঢাকা থেকে সুনামগন্জ যাচ্ছে। বলেছি পোস্ট দিচ্ছি, পড়ে নিস গাড়িতে বসে বসে। যেখানে থাকিস বন্ধু ভালো থাকিস সারাজীবন, সারাদিন-সারাবেলা।

পনের. স্কুলে অষ্টম শ্রেণী ছেড়ে মাদ্রাসায় অষ্টম শ্রেণীতে ভর্তি হলাম। মাঝখানে এক বছর আব্বার ব্যক্তিগত পরিচর্যায় মাদ্রাসার ১ম শ্রেণী থেকে সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত আরবী সাহিত্য পাঠ শেষ করেছি। এ সময়ে আব্বা কোনো বই ছাড়া আমাদের দু’ভাইকে আরবী ব্যাকরণের প্রাথমিক ছাত্র থেকে শিক্ষকে রূপান্তরিত করেছেন! এ সময়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের সাথে মিথষ্ক্রিয়া নেই। তবে কোনো একটি পুজোর দিনে চাঁন্দেরবাগ গ্রামে ঘুরতে গিয়েছিলাম। এ গ্রামটা চৌদ্দগ্রাম থানায় নাঙ্গলকোটের চিটমহল! ঢাকাতিয়ার পূর্বপাড়ে নাঙ্গলকোটের আর কোনো গ্রাম নেই। মরকটা থেকে একটি নৌকা করে চান্দেঁরবাগ গিয়েছিলাম। এ গ্রামে শুনেছি জল্লাল (সম্ভবত মূল নাম জওহরলাল) ডাক্তার নতুন বাড়ি বেঁধেছেন। তার বাড়িটি খুঁজে পাইনি। তিনি আমাদের পাশের গ্রামের অধিবাসি ছিলেন। গ্রাম্য এ চিকিৎসক সম্পর্কে অনেক রটনা আছে। একটি রটনায় তিনি এলাকা ছাড়া হয়েছিলেন। সত্য-মিথ্যা জানার মতো তখনো আমার বয়স হয়নি। জানিনা তিনি বেচেঁ আছেন কিনা? নাকি কোনো মিথ্যা অভিযোগ নিয়ে গ্রাম ছাড়া লোকটি পৃথিবী ছাড়তে হয়েছিলো! অথচ যৎসামান্য বিদ্যা নিয়ে গ্রাম বাংলার অসহায় মানুষকে এক সময় চিকিৎসা সেবা দিয়েছিলেন এবং বেশ নাম-খ্যাতি কুড়িয়েছিলেন।

ষোল. মরকটা গ্রামে একজন হিন্দু কবিরাজ ছিলেন। মসজিদের সামনের দিকটায় বসে বিকেলে বড়ি বিক্রি করতে এসে চুপচাপ দাঁড়িয়ে-বসে থাকতেন। আমরা তখন মাদ্রাসার দক্ষিণ দিকটায় অফিসের পাশে পোস্ট অফিস সংলগ্ন কর্ণারের কক্ষটায় থাকতাম। সন্ধ্যার পর মাঝে মাঝে কবিরাজ আব্বার কাছে পানি পড়ার জন্য আসতেন। আমরা ওনার ঔষধ বানানোর বনেজি গাছটির নাম জিজ্ঞেস করলে একটা মুচকি হাাসি দিতেন। কিন্তু কখনো গাছের নাম বলতেন না! চিকন-পাতলা লম্বা গঠনের লোকটার চেহারাটা আমার এখনো আবছা আবছা মনে আছে। কী আর এমন বিদ্যা-বুদ্ধি ছিলো! অথচ একটু সেবা দেয়ার জন্য কতো বিকেল লাঠি ভর করে দাড়িয়ে থাকতো বাজারের বট গাছটির তলায়!

সতের. ১৯৯৮ সনের ১০ অক্টোবর। তারিখটা আমার বড় বোন আমার কক্ষে ঝুলানো বাংলাদেশের একটি মানচিত্রের গায়ে লিখে রেখেছিলেন। বিশ বছর আগে এ দিন দু’ভাই গ্রামের বাড়ি ছাড়ার পর বড় ভাই পড়া শেষে বাড়ি ফিরলেও আমার আর ফেরা হয়নি। নোয়াখালিস্থ চন্দ্রগন্জ কারামতিয়া কামিল মাদ্রাসায় প্রায় আড়াই বছর পড়লাম। বাড়ি থেকে দূরে এ মাদ্রাসায় পড়াকালীন বিকেলে ঘুরতে বের হতাম। প্রায় চন্দ্রগন্জ পশ্চিম বাজার ‘ক্যাফে মিলন’-এ মোঘলাই খেতে যেতাম। পশ্চিমবাজার দুইটি মসজিদ ছিল। একটি মসজিদের চাটখিল আলিয়ার মুহাদ্দিস মাওলানা আহমাদুল্লাহ সাহেব খোতবা দিতেন। বেঁচে আছেন কীনা জানিনা। আল্লাহ তায়ালা তাঁর প্রতি রহম করুন। নামাজের আগে খুব সুন্দরভাবে আরবী থেকে অনুবাদ করে তাফসীর শুনাতেন। বিশেষভাবে তৈরি লাঠির ওপর তাফসির গ্ৰন্থ রেখে পাগড়ি পরা এ আলেমের জ্ঞানগর্ভ আলোচনা আমাকে মুগ্ধ করতো। সে জন্য সুযোগ পেলে সেখানে নামাজ পড়তে যেতাম। বাজারটাতে অনেক হিন্দু দোকানদার ছিলো। মাগরিবের আজানের সাথে সাথে বাজার ধুপময় হয়ে উঠতো। তখন আমি ধুপের গন্ধ সহ্য করতে পারতাম না! তাই কেনাকাটা তাড়াতাড়ি শেষ করে বাজার থেকে ফিরতাম। বিশেষ করে আজানের আগে আগে হিন্দু দোকান ত্যাগ করতাম। হিন্দুরা ধুপ কেন জ্বালায়? এটা কী সংস্কৃতি না ধর্মচর্চার অংশ এ নিয়ে সে সময় আমার খুব জিজ্ঞাসা ছিলো। মুসলিম দোকানে লোবান জ্বালাতো। সন্ধ্যাবেলা ধুপ-লোবানের ঘ্রাণ মশার উপদ্রব থেকে সুরক্ষা দিতে হয়তো ব্যবহৃত হয়ে থাকবে। হয়তো ধুপ জ্বালানো সংস্কৃতি, হয়তো লোবান জ্বালানোও। এইতো বাঙ্গালী হিন্দু, এইতো বাঙ্গালী মুসলিম। আমরা আমরাইতো।

চলবে...................

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

সময় জার্নাল।আরইউ


Somoy Journal is new coming online based newspaper in Bangladesh. It's growing as a most reading and popular Bangladeshi and Bengali website in the world.

উপদেষ্টা সম্পাদক: প্রফেসর সৈয়দ আহসানুল আলম পারভেজ

যোগাযোগ:
এহসান টাওয়ার, লেন-১৬/১৭, পূর্বাচল রোড, উত্তর বাড্ডা, ঢাকা-১২১২, বাংলাদেশ
কর্পোরেট অফিস: ২২৯/ক, প্রগতি সরণি, কুড়িল, ঢাকা-১২২৯
ইমেইল: somoyjournal@gmail.com
নিউজরুম ই-মেইল : sjnewsdesk@gmail.com

কপিরাইট স্বত্ব ২০১৯-২০২৪ সময় জার্নাল