রহিমা আক্তার মৌ
দুদিন আগে হালকা গলা ব্যাথা বুঝতে পেরে নাপা খেয়ে নিই। পরদিনই স্বাভাবিক হয়ে যায় গলা। একদিন পর সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি বাপাশের চোখে আঠালো কিছু আর প্রচন্ড মাথা ব্যাথা। মাথা ব্যাথার জন্যে নাপা এক্সট্রা খেলাম, অভ্রকে নিয়ে হাসপাতাল গেলাম বোনের কাছে। কিন্তু মাথা ব্যাথা কমলো না। তখনিই মনের মাঝে একটা ধাক্কা, কারণ মাইগ্রেন এর ব্যাথা এমন নয়। সারাদিন পার করলাম, সন্ধ্যার পর থেকে ঝিমুনি ভাব। মাঝ রাতে দেখি সারা শরীর ব্যাথা করে জ্বর। সাথে সাথে উঠে আলাদা কাঁথা নিয়ে আহসানকে দিয়ে আমি খাটের অন্যপ্রান্তে চলে আসি।
ভোর পাঁচটা থেকে চোখে আর ঘুম নেই। গলা ব্যাথা, দুই চোখ, মাথা আর সারা শরীর ব্যাথা সাথে জ্বর ১০১। আমি পুরাই শিউর হয়ে যাই আমি হয়তো করোনা পজেটিভ এর দিকেই যাচ্ছি। যে রুমে আমি থাকতাম সে রুমে নিজেকে একা করে নিই। অভ্র নিজের রুমে আর আহসান রৌদ্রের রুমে। পরিবারের তিন সদস্য তিন রুমে। পারিবারিক ডাক্তার এর সাথে কথা হয়, সরকারি ভাবে করোনা পরীক্ষার জন্যে চেষ্টা করে ব্যার্থ হই। পরে প্রাইভেট ভাবে পরীক্ষা করিয়ে জানতে পারি আমি করোনা পজেটিভ। বুকে হালকা ব্যাথা ও চাপ অনুভব করায় আমাকে একটা সিটি স্ক্যান করতে বলে। নিজেকে সম্পূর্ণ সুরক্ষা চাদরে মুড়িয়ে নিয়ে বের হলাম নামকরা একটা হাসপাতালে। আমি সিএনজিতে আর আহসান অন্য এক রিকসায়। হাসপাতালে গিয়েও আমরা দুজন নিরাপদ দুরত্ব বজায় রেখে চলছি। গানের কথায় আছে, আমি জেনেশুনে বিষ করেছি প্রান......
গান আর বাস্তব এক নয়। আহসান জেনেশুনে আমার পাশাপাশি থেকে বিষ গ্রহন করতে চায় না।
টাকা জমা দিয়ে আমরা দুজন ৬ ফিট দুরত্বে বসে আছি। আমার সিটের একসিট দুরে বসা ৬০/৬৫ বছরের এক লোক। উনার হাতে কিছু ফাইল, বুঝেছি উনিও ডাক্তার দেখাতে এসেছেন।
-- আপনি কি সিটি স্ক্যান করাতে এসেছেন?
-- হ্যাঁ, করানো হয়েছে।
-- কি ভাবে করে?
-- আসলে আমি ভেতরে ঢুকে চোখ বন্ধ করে রেখেছিলাম, যখন বলল উঠেন কাজ শেষ তখন চোখ খুলেছি।
কথা শুনেই আমার ব্যাথা বুকে হাসি বেরিয়ে এলো। হাসি একজন রোগীর জন্যে অনেক পাওয়ারের এন্টিবায়োটিক এর কাজ করে। আহসান দুর থেকে দেখছে আমি উনার সাথে কথা বলছি, হাসছি, আবার ওর দিকেও তাকাচ্ছি। আমার হাসি দেখে উনি বললেন,
-- ভয়ের কিছু নেই, সাথে কারোই দরকার নেই। শুনেন, আমি জীবনে অনেক অনেক প্রিয় মানুষের অসুস্থ্যকালে রোগীর সহযোগী হয়ে ছিলাম অনেক হাসপাতালে। এই হাসপাতালে দুই মাস ভর্তি থেকে আমার স্ত্রী ও মারা যায়। এখন আমি একাই সব করি, একাই ডাক্তারের কাছে যাই, যা যা করতে বলে করি। আপনিই বলেন কাকে সাথে ডাকবো, বাস্তবতা হলো সবাই নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত। তাই কাউকে বিরক্ত করি না। নিজের মতো করে নিজেই চালিয়ে নিচ্ছি।
উনার কথায় সাহস পেলাম, বললাম,
-- মেশিনটা দেখতে হয়তো এম আর আই করার মেশিনের মতো।
-- আমি ঠিক জানিনা।
-- আমি দুবার এম আর আই করিয়েছি।
সিটি স্ক্যান করার রুম থেকে যখনি ডাকতে আসে, বুকটা থক করে উঠে। এই বুঝি ডাকলো....
রহিমা আক্তার উপস্থিত আছেন..........।
দুজনের পর আমার ডাক আসে, হাতের ব্যাগটা আহসানের পাশের সিটে রেখে ভেতরে যাই। বিশাল বড় রুম, কয়েকটা বড় বড় মেশিন। একটা সূরঙ্গ পথের মতো মেশিন, তার সাথেই একটা লম্বা সিট। দুই হাত মাথার উপরের দিকে লম্বা করে দিয়ে আমাকে সেখানে শুয়ে পড়তে বলল। আমি শুয়েই চোখ বন্ধ করে দিই।
প্রথম অনুভূতিতে বুঝলাম আমার শুয়ে থাকা সিট উপরের দিকে উঠানো হলো। এরপর পায়ের দিকে কিছুদুর নিয়ে গেলো। আমি মুখে বার বার কালিমা পড়তে শুরু করি। কালিমা রেখে আসতাগফুরুল্লাহ পড়ি কিছুক্ষন। কয়েকবার আমাকে স্বাস বন্ধ ও ছাড়ার কথা বলে, আমি তাই করি। মনে হচ্ছে আমি শূন্যে উড়ছি। নব থিয়েটারে গিয়েছিলাম কয়েকবার। দর্শক সারিতে বসে যেমন আকাশে ঘুরার অনুভূতি হয়েছিল এখনও তাই হচ্ছে। মনে পড়লো অনিকের কথা, ও বলেছে সূরা ফাতিহা বেশি বেশি পড়তে। তাই পড়তে লাগলাম। অবশ্য বান্ধবী আইরিন আর জামাতাও সূরা ফাতিহা পড়ার কথা বলেছিল। কিন্তু তখন অনিককেই মনে পড়ল।
কারো সাড়া না পেয়ে ভাবছি ওরা মনে হয় আমার কথা ভূলেই গেছে। দেখি কতক্ষণ ভুলে থাকতে পারে। ডা. নীলাকে মনে পড়লো, ও বলেছে চার কুল সূরা পড়তে। তাই পড়া শুরু করলাম। অবশ্য অনেক সময় আমি চার কুল পড়ি। সকাল সন্ধ্যা পড়ি। হ্যাঁ আমি কারো সাড়া পাচ্ছি, হাতটা একটু টেনে নিয়ে কিছু দিয়ে বাঁধলেন। বললেন,
-- হাত কিন্তু টান দিবেন না।
মনে হল হাতের পিঠা চাকু দিয়ে একটা পোঁচ দিলো, উহ! করতেও পারলাম না। হাতে কিছু একটা পুশ করলো, সাথে সাথে পুরো শরীর গরম হয়ে গেলো। মনে হল হাত দিয়ে রক্ত ঝরে ঝরে পড়ছে আর সারা শরীর থেকে রক্ত গরম হয়ে হাতের দিকেই যাচ্ছে। আবার সেই আগের মতো কথা,
-- স্বাস বন্ধ করেন, স্বাস ছেড়ে দেন।
যা করতে বলে তাই করি আর মুখে তো দোয়া আছেই। হাতের বাঁধন খুলে দেয়া হলো। সেখানে কিছু দেয়ার পর ইস্কস্টেপ দিয়ে বন্ধ করে দেয়। উনি নিজেই হাতটা ধরে পেটের দিকে নিয়ে আসে। বলেন,
-- আস্তে আস্তে উঠেন।
উঠে বসলাম, চোখ খুললাম।
-- হাতটা চেপে ধরে বাইরে গিয়ে কিছু সময় রেস্ট নিন।
ব্যাথা শরীর যেন পুরাই চাকা হয়ে গেলো। কোন রকমে বের হয়ে একটা চেয়ারে বসলাম। কিছু সময় পর সেই আগের মতো আমি সিএনজিতে আর আহসান রিকসায় করে বাসায় ফিরলাম।
বাসায় এসে একটা পোস্ট দিলাম, "হাঁড়ের ব্যাথা হলে এম আর আই করে হাঁড়ের কলকব্জা দেখা হয়, বুকে বা শরীরে ব্যাথা হলে সিটি স্ক্যান করে শরীরের স্তববিন্যাস দেখা হয়। কিন্তু হৃদয়ের কষ্ট দেখার বা মাপার যন্ত্র আজো আবিস্কার হয়নি, হলে ভালো হতো।"
২৪ ঘন্টা পর সিটি স্ক্যান এর রিপোর্ট এলো, আলহামদুলিল্লাহ করোনা ভাইরাস আমার হৃদয়ের মাত্র ৫ অংশকে ক্ষত করতে পেরেছে। বাকী ৯৫ অংশ ঠিক আছে। ৪/৫ জন ডাক্তারকে দেখালাম, সবাই তাই বলল।
সবার কথা শুনে আমি চুপে চুপে হাসি, আজ যদি সিটি স্ক্যান না করিয়ে কষ্ট মাপার যন্ত্র দিয়ে আমার হৃদয়ের কষ্ট দেখা হতো, তাহলে রিপোর্ট আসতো, ৯৫ অংশ দখল করেছে কষ্ট আর ৫ অংশের দখলদারি পেয়েছে করোনা।
গত ৪/৫ দিন আগে লাগাতার কয়েকদিন অনেক কষ্টে ছিলাম, কষ্টের যন্ত্রণা সবাই বুঝবে না। তখন খুব ইচ্ছে করেছিল একা ঘর থেকে কোথাও চলে যাই।
কোথাও না পারি আমার প্রিয় সংসদ ভবনের দক্ষিন প্লাজায় গিয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকি। বিশাল আকাশ দেখি, আকাশের কাছে আমার কষ্টগুলো জমা রেখে আসি। কিন্তু যাওয়া হয়নি। এই যাত্রায় বেঁচে সুস্থ্য হলে রিপোর্ট নেগেটিভ এলে অবসর কাটিয়ে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে অভ্রকে জড়িয়ে ধরবো, বুকের সাথে আটকে রাখবো অনেকক্ষণ। সংসদ ভবনের দক্ষিন প্লাজায় গিয়ে বসে থাকবো। একদিনের জন্যে বই মেলায় যাবো, ঘুরবো। যার জীবনটাই একটা ভুলে ভরা স্ক্যানে বন্ধি, তার আবার সিটি স্ক্যান, হা হা হা........
লেখক : রহিমা আক্তার মৌ
সাহিত্যিক, কলামিস্ট ও প্রাবন্ধিক।
rbabygolpo710@gmail.com
সময় জার্নাল/ইম