ড. আবুল হাসনাৎ মিল্টন :
বাংলাদেশে করোনা চিহ্নিতকরণের এক বছর হয়ে গেলো। শুরুর দিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং আইইডিসিআরের প্রস্তুতিহীনতা, সমস্যাকে গুরুত্ব না দেওয়া এবং সমন্বয়হীনতার কারণে করোনা নিয়ন্ত্রণে একটা হযবরল পরিস্থিতির সৃষ্টি হলেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে তিন মাসের মধ্যেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। করোনা নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ সরকারের সাফল্য আন্তর্জাতিকভাবেও স্বীকৃতি পায়।
তবে এই সাফল্যের কারনসমূহের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা খুঁজতে আমরা খুব একটা আগ্রহী ছিলাম না। করোনা নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে লোকালয়ে আমাদের প্রচুর পরিমানে এন্টিবডি পরীক্ষা করার প্রয়োজন ছিল। কী এক অজ্ঞাত কারণে আমরা তা করি নি।আইইডিএসআর একটি জরীপের অংশ হিসেবে করা কয়েক হাজার এন্টিবডি পরীক্ষার ফলাফল জানিয়ে যে ভাবে আমলাদের তোপের মুখে পড়েছিল, তারপরে মনে হয় না আর কেউ ও পথে পা বাড়ানোর সাহস দেখাতো। অথচ এই সাফল্যের কারণসমূহ গবেষণা করে লিপিবদ্ধ করলে সারা বিশ্ব উপকৃত হতো, বাংলাদেশেরও সম্মান বৃদ্ধি পেতো।
করোনারকালে আরেকটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ্য করেছি। দেশে ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে আমাদের বিশেষজ্ঞরা একেক-রকম মন্তব্য করতেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে যার কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি ছিল না। যেমন বর্ষা আসার আগে একজন শ্রদ্ধেয় বিশেষজ্ঞ বলেছিলেন, ‘বর্ষায় করোনা সব ধুয়ে মুছে যাবে’। আবার শীতের আগে অনেকেই বলেছিলেন, ‘ঠাণ্ডায় করোনার প্রকোপ বাড়বে’। অথচ বাস্তবে দেখা গেছে, বর্ষায় যেমন করোনা ধুয়ে-মুছে যায় নি, তেমনি শীতেও তেমন বাড়ে নি। করোনা সংক্রমণ কমা-বাড়ার সাথে আসলে বাহ্যিক তাপমাত্রার যে কোন সম্পর্ক নাই, এটা তো প্রমানিত সত্য। তারপরও তাদের এহেন উচ্চারণে আমরা বিস্মিত হয়েছি।
মোটা দাগে আমাদের সাফল্যের কারণগুলো বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, আমাদের সমগ্র জনসংখ্যার মাত্র পাঁচ-ছয় শতাংশের বয়স ৬৫ বছরের উপরে। যেহেতু করোনায় আক্রান্ত হয়ে বয়স্করা অধিক হারে মৃত্যবরণ করেন, সেহেতু আমাদের মৃত্যুর আনুপাতিক হারটা কম হবার কথা। আমাদের শহরের বস্তিবাসী দরিদ্র জনগোষ্ঠীর শরীরে করোনা প্রতিরোধ ক্ষমতা হয়তো বেশী। কারণ ঘনবসতিপূর্ণ জায়গায়, তুলনামূলকভাবে কম পরিচ্ছন্ন পরিবেশে বিভিন্ন রোগজীবানুর সংস্পর্শে থেকে তাদের শরীরে এসবের বিরূদ্ধে এক ধরণের প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে উঠেছে। এমনও হতে পারে, করোনাভাইরাসের যতগুলো স্ট্রেইন বাংলাদেশে পাওয়া গেছে, তাদের অধিকাংশই হয়তো অতটা প্রাণসংহারী নয়। আবার অনেক তরুণই হয়তো করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃদু উপসর্গে ভুগেছেন বা উপসর্গবিহীন ছিলেন। সুনির্দিষ্ট গবেষণাজাত ফলাফলের অনুপস্থিতিতে এগুলো অনেকটাই অনুমাননির্ভর কথা।
তবে এবার শীত গিয়ে বসন্তের এই পর্যায়ে কোন রকম পূর্ব সতর্কতা ছাড়াই হঠাৎ করে করোনার প্রকোপ বেড়েছে। এটাকে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ বলা চলে। ক্যানাডা, আফ্রিকা, ইউরোপের অনেক দেশেই করোনা বারবার হানা দিয়েছে। সেই হিসেবে বাংলাদেশে দ্বিতীয় ঢেউ আসাটা অস্বাভাবিক কিছু না। এ পর্যন্ত দেশ থেকে যা খবর পাচ্ছি, তাতে মনে হচ্ছে এবারের করোনাভাইরাসের প্রকৃতিটা বোধ হয় অধিক ক্ষতিকর এবং তরুণরা এবার বেশী আক্রান্ত হচ্ছে। করোনার বর্তমান ঢেউ মোকাবেলায় দেশে এখনো তেমন তৎপরতা চোখে পড়ছে না। শুধু গণহারে সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে বলা হচ্ছে।
লকডাউন শিথিল হবার পর থেকে দেশে সাধারণ মানুষের ভেতরে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলবার প্রবণতা বরাবরই কম ছিল। এখন পর্যন্ত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলবার হার তেমন বৃদ্ধি পায় নি। যদিও বর্তমানে করোনা বেড়ে যাওয়ায় অনেকেই স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চলাকে দায়ী করছেন। আসলেই কি তাই?
পরশু দিন ঢাকা থেকে এক অনুজসম ডাক্তার ফোন করেছিলেন। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘দেশে তো অনেকদিন ধরেই মানুষজন স্বাস্থ্যবিধি তেমন মেনে চলে না। তারপরও এখন হঠাৎ করোনা সংক্রমণ বাড়লো কেন?’ এই প্রশ্নের উত্তর বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্যসহ অন্যান্যা বিশেষজ্ঞরা দিতে পারবেন। তবে বিভিন্ন সুত্রে যতটুকু ধারণা করতে পারছি, তাতে মনে হচ্ছে দেশে করোনাভাইরাসের নতুন এক বা একাধিক পরিবর্তিত রূপ পাওয়া যাচ্ছে। বর্তমানে অনেক তরুণেরা আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছে, কারো কারো অবস্থা বেশ আশঙ্কাজনক হয়ে উঠছে। তুলনামূলকভাবে নতুন রূপের এই করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ও মৃত্যুর হারও বাড়ছে।
ভাইরাসের এই নতুন পরিবর্তিত রূপ আমরা সম্ভবত বিদেশ থেকে আকাশ কিংবা স্থল পথে আমদানী করেছি। পৃথিবীর দেশে দেশে করোনাভাইরাসের নতুন নতুন রূপ দেখা যাচ্ছে। এই ভাইরাস এক দেশ থেকে যেন আরেক দেশে না যেতে পারে, সেই জন্য অনেক দেশেই ঢোকা মাত্র চৌদ্দদিন বাধ্যতামূলকভাবে কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হয়। করোনার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে এটি একটি কার্যকরী পদ্ধতি। অথচ করোনার শুরু থেকেই আমরা বাংলাদেশে কোয়ারেন্টাইনের নামে বিভিন্ন রকমের টালবাহানা দেখেছি। বর্তমানেও এই অবস্থা বিদ্যমান। কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি ছাড়াই চৌদ্দদিনের কোয়ারেন্টাইন এখন পাঁচ-সাতদিনে এসে ঠেকেছে। আর, সামগ্রিকভাবে এর মাশুল দিচ্ছে সারাদেশ। যে কোন জনস্বাস্থ্য সমস্যাকে বিজ্ঞান দিয়ে মোকাবেলা করতে হয়, আমলাতন্ত্র বা চাপাবাজি দিয়ে নয়- এটা কে কাকে বোঝাবে?
আগে বহুবার বলা হলেও এবার সত্যি সত্যিই বাংলাদেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ পরিলক্ষিত হচ্ছে। এটি মোকাবেলায় শুধু মুখে মুখে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কথা বললে হবে না। বরং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব , সরকারকে দেশব্যাপী কঠোর কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। করোনার দ্বিতীয় ঢেউকে অবহেলা করার কোন সুযোগ নেই। এটি আগের যে কোন করোনাভাইরাসের চেয়ে ক্ষতিকর।
স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন, নিজে বাঁচুন এবং অন্যকে বাঁচতে দিন। সবার জন্য শুভ কামনা রইল।
সময় জার্নাল/ইএইচ