ডা. রাসেল চৌধুরী:
আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের হার্ট এটাক হয়েছিলো। সাথে সাথেই এদেশের চিকিৎসকরা জরুরিভিত্তিতে হার্টের রোগ নির্ণয় করেছিলেন। সফলভাবে স্টেন্টিং বা রিং পরানোও হয়েছিলো।
তারপরও দেবি শেঠিকে প্লেনে উড়িয়ে আনা হলো। তিনি এদেশের চিকিৎসকদের চিকিৎসা শতভাগ সঠিক হয়েছে বলে ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন।
আমরা চিকিৎসকরা খুব উৎসাহভরে আশা করেছিলাম যে, পরবর্তী চিকিৎসা বাইপাস অপারেশন এদেশেই হবে। কারণ এই অপারেশন এদেশের বিশেষজ্ঞ সার্জনদের হাতে হরহামেশা গত ২০ বছর ধরেই সফলভাবে হচ্ছে।
তারপরও এতো বড় ভিআইপির হার্টের অপারেশন দেশের হাসপাতালে হলে এদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে সাধারণ জনগণের মাঝে আস্থাহীনতার সংকট প্রবলভাবে কেটে যাবে। কথায় কথায় চিকিৎসার নামে নেতাদের বিদেশ যাত্রার অজুহাতে বৈদেশিক মুদ্রার অপব্যয় বন্ধ হবে। সুস্থ হয়ে ওবায়দুল কাদের যোগাযোগ ব্যবস্থার মতো স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নয়নেও সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন।
কিন্তু না, সেটা হয়নি। এদেশের দলমত নির্বিশেষে সকল রাজনৈতিক নেতৃত্ব জনগণের কল্যাণের জন্য রাজপথে সকাল বিকাল গ্যালন গ্যালন রক্ত ঢেলে দিতে প্রস্তত কিন্তু চিকিৎসকের ছুরি কাঁচির নিচে কয়েক ফোঁটা রক্ত দিতে হলেও সেটার জন্য তাঁরা আকাশে উড়াল দেন। আর এটা তো হার্টের অপারেশন।
সুতরাং ওবায়দুল কাদেরও উড়াল দিয়েছিলেন। আঠারো কোটি মানুষের দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে ব্রেক থ্রু কনফিডেন্স জাগানোর সুবর্ণ সুযোগ আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব নেয়নি।
এরকম উড়াল এদেশের সব দলের সব নেতারাই দেয়। এমনকি করোনাকালে মওদুদ আহমেদ দিয়েছিলেন। সাহেরা খাতুনও দিয়েছিলেন। বাদ যাননি সারেং বউ খ্যাত পরিচালক, অভিনেতা আমজাদ হোসেন। অথচ ফিরেছিলেন মৃত্যুকে সাথে নিয়ে। আমরা চিকিৎসকরা কিন্তু ঠিকই জানতাম, তাঁরা নাড়ির স্পন্দন নিয়ে আর এই ভূমিতে ফিরবেন না। কিন্তু তবুও দেশপ্রেমের ফেনা তোলা এই নেতা বা অভিনেতারা স্বদেশে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের ঝুঁকি নেননি।
ইয়াজউদ্দিন আহমেদ বিতর্কিত রাষ্ট্রপতি ছিলেন। তিনি বিদেশের মাটি সিংগাপুরে সরকারি খরচে নিয়মিত চিকিৎসা নিতেন। ভেবেছিলাম হাওরের রাষ্ট্রপতি মাটির মানুষ এডভোকেট আবদুল হামিদ এদেশে চিকিৎসা নিবেন। কিন্তু না, দেশের চিকিৎসা খরচ নিয়ে নিয়মিত সমালোচনা করলেও কয়েক গুন বেশি খরচে স্বাস্থ্য পরীক্ষার মতো সাধারণ চিকিৎসা সেবা নিতেও তিনি নিয়মিত উড়াল দেন সিংগাপুর, জার্মানিতে।
বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া দন্ডিত অবস্থায় বিদেশ যেতে পারেন কিনা সেই ব্যাখ্যায় যাচ্ছি না। কিন্তু তাঁর দলের নেতারা যেভাবে তাঁকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশ পাঠানোর জন্য হাপিত্যেশ করে মরছেন, একবার কি আয়নায় দেখে নিজেদের জিজ্ঞেস করেন, এদেশের অসংখ্য সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যসেবার দায়ভার শাসনকালে কতটুকু তাঁরা কাঁধে নিয়েছিলেন?
খালেদা জিয়ার জন্য প্রস্তাবিত যে লিভারের চিকিৎসা পাশের দেশ ইন্ডিয়াতেও আছে কয়েক দশক আগে থেকে, কেনো সেটা এদেশে নেই? সরকারের এতো টাকা খরচ করে তাঁরা বিদেশে চিকিৎসা নিয়েছিলেন, অথচ কেনো কয়েক কোটি টাকা খরচ করে এদেশে সেই চিকিৎসা দেয়ার জন্য দেশের চিকিৎসকদের ট্রেনিংয়ের জন্য বিদেশে পাঠানোর কথা কোনোদিন ভাবেননি?
দেশের চিকিৎসক নেতাদের নিয়েও আজ কেমন জানি করুণা হচ্ছে। একদল বলছেন খালেদা জিয়াকে বিদেশে না পাঠালে তিনি চিকিৎসাহীনতায় মারা যাবেন। আরেকদল বলছে বিদেশে পাঠালেও যে চিকিৎসা পাবেন, তাতে খুব একটা প্রাণে বাঁচার সম্ভাবনা নেই।
কারা সঠিক সেই বিতর্কে যাবো না। শুধু বলি খালেদা জিয়ার বেলায় যা বলছেন, দেশের সব রোগীর চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর উপদেশ দেবার বেলায় যেনো আমরা একই নীতি মেনে চলি।
সেক্ষেত্রে একদলের কথামতো এদেশের কয়েক লাখ রোগীকে বিদেশে পাঠিয়ে লিভারের চিকিৎসা নেয়ার সুযোগ দেয়া হোক। অথবা আরেক দলের কথা মতো দেশে এভেইলেবল এমন চিকিৎসা সেবা বা বিদেশের যে চিকিৎসা সেবায় খুব বেশি আরোগ্যের সম্ভাবনা নেই, সেই চিকিৎসা নেয়ার জন্য আর কাউকে কোনোদিন যেনো তাঁরা বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে বিদেশে পাঠানোর সুপারিশ না করেন।
মাহাথিরের মতো আমাদের নেতারাও যেদিন নিজের চিকিৎসা নিজের দেশে করার জন্য অবকাঠামো না গড়া পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন, চ্যালেঞ্জ না নিবেন, ততদিন পর্যন্ত আঠারো কোটি মানুষের অন্ন,বস্ত্র, বাসস্থান সংস্থানের সংগ্রাম বাদ দিয়ে বিদেশে চিকিৎসা নিয়ে শুরু হওয়া নেতাদের কদর্য রাজনীতি চলতেই থাকবে।
করোনাকালে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে সকলের শুভ বুদ্ধির উদয় হোক।