বৃহস্পতিবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪

হারিয়ে যাচ্ছে গরুদিয়ে হালচাষ-ফসল মাড়াই ও দৌড় প্রতিযোগিতা

সোমবার, ডিসেম্বর ১৩, ২০২১
হারিয়ে যাচ্ছে গরুদিয়ে হালচাষ-ফসল মাড়াই ও দৌড় প্রতিযোগিতা

আনোয়ারুল কাইয়ূম কাজল :

সুজলা-সুফলা শস্য শ্যমলা সোনালী ফসল ক্ষেতের আইল বেয়ে গড়ে উঠা রূপের রাণী আবহমান বাংলার গ্রামীণ জনপদ। সোনালী ফসলে দোল  খাওয়া দিগন্ত প্রসারী মাঠ, মাঝি-মাল্লার ভাটিয়ালী গান, রাখালের বাঁশি, কৃষাণের উদার জমিন, কৃষাণীর ধান ভানার উল্লাস, ছয় রূপের ছয়টি ঋতু সব মিলিয়ে এ যেন কোনো শিল্পীর নিপুণ হাতে রং তুলিতে আঁকা স্বপ্নের দেশ। এদেশে সন্ধ্যা-সকালে ঘুঘু,বক,সারস,ময়না,টিয়ে,ডাহুক, দোয়েল, কোয়েলের ডাকে ঘুম ভাঙত। কৃষিপ্রধান পল্লীবাংলায় কৃষি কাজই ছিল জীবন নির্বাহের অন্যতম প্রধান উপকরণ। এককালে চাষাবাদের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি ছিল গরু-লাঙল-জোয়ালের সমন্বয়ে তৈরি হালচাষ পদ্ধতি। এতে একদিকে যেমন পরিবেশ রক্ষা হয়, পাশাপাশি কৃষকের অর্থ ব্যয় হয় কম।
আবহমান বাংলার  জমি চাষ বা  হালচাষ পদ্ধতি আজকের দিনে প্রায় বিলুপ্ত। আধুনিকতার ছোঁয়ায় হারিয়ে যাচ্ছে  গরু দিয়ে হালচাষের গ্রামীণ এই ঐতিহ্য। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আধুনিক নতুন নতুন প্রযুক্তি নিয়ে এগিয়ে চলছে দেশের কৃষি নির্ভর অর্থনীতি। আর পরিবেশ বান্ধব ঐতিহ্যবাহী হালচাষ পদ্ধতি যেন যাদুঘরে স্থান করে নেওয়ার প্রহর গুণছে। এক সময় দেশের কৃষকরা কামারের তৈরি এক টুকরো লোহার ফাল দিয়ে কাঠমিস্ত্রির হাতে তৈরি কাঠের লাঙল, জোয়াল আর বাঁশের তৈরি মই ব্যবহার করে জমি চাষাবাদ করতেন। কৃষিকাজে এসব স্বল্প মূল্যের কৃষি উপকরণ এবং গরু দিয়ে হালচাষ করে তারা যুগের পর যুগ ধরে ফসল ফলিয়ে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করতেন। একইভাবে ধান, ঘম, যব, কলাই, আখ ইত্যাদি মাড়াই্ও  হতো হালের বলদ তথা গরু দিয়ে। গরু দিয়ে তেলেরঘাণি টানা হতো অর্থ্যাৎ কলুরবলদ হিসাবে তেল তৈরীতে গরুর ভূমিকা ছিল অনন্য। চাষ-বাস,মাড়াই ও ঘাণি টানা ছাড়াও গ্রামীণ জনপদের কৃষাণ-কৃষাণীর আনন্দ-বিনোদনের জন্য আয়োজন হতো গরু দৌড় প্রতিযোগিতা।

কৃষিতে আধুনিকতার ছোঁয়া

কৃষিতে আধুনিক যন্ত্রপাতির প্রচলনে নেই পুরানো যন্ত্রপাতি ্ও পদ্ধতি নেই বললেই চলে। এখন উন্নত মানের পাওয়ার টিলারের সাহায্যে পাঁচ মিনিটেই জমি প্রস্তুত হয়ে যাচ্ছে জমি। আগের মত চাষাবাদে বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা না করে পাম্পের সাহায্যে সেচ কাজ করে পানির চাহিদা মিটানো হচ্ছে। প্রতিনিয়তই নিত্যনতুন সব কীটনাশক বাজারে আসছে। এখন আর কৃষককে রৌদ্র বৃষ্টিতে ভিজে ধানের বীজ তার শষ্যক্ষেতে ছিটিয়ে দিতে হয় না। জমিতে বীজ ছিটানোর জন্যে এখন আছে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি। ধানের পাতা পরীক্ষা করে এ জমির উপযোগী কীটনাশক ব্যবহার করা হচ্ছে। ধানের আগাছা পরিষ্কার করার জন্যেও ব্যবহার হচ্ছে এক ধরনের দাঁতালো যন্ত্র। ধান কাটার ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হচ্ছে ধান কাটার যন্ত্র। দিনব্যাপী চাষাকে আর গায়ের ঘাম ঝরিয়ে ধান কাটতে হচ্ছে না।

কৃষক, হালের গরু ও খামারের চিত্র

তাজা ঘাস আর ভাতের মাড়, খৈলের ভুসি ইত্যাদি খাইয়ে হৃষ্টপুষ্ট করে তোলা হালের জোড়া বলদ দিয়ে জমি চাষ করতেন কৃষক। ভোর হলেই গ্রামাঞ্চলের কৃষক অথবা কৃষিশ্রমিকরা কাঁধে লাঙ্গল-জোয়াল নিয়ে গরু মহিষ হাঁকিয়ে জমিতে হাল চাষের জন্য বেরিয়ে পড়তেন জমি চাষের জন্য। এক সময় এখানকার মাঠ, বিল, চর ও গ্রাম পলিবাহিত উর্বর এই জনপদের মানুষদের কাক ডাকা ভোরে ঘুম ভাঙ্গতো লাঙ্গল জোয়াল আর হালের গরুর মুখ দেখে। এখন যন্ত্রের আধিপত্যে সেই জনপদের মানুষদের ঘুম ভাঙ্গে ট্রাক্টরের শব্দে। বাংলাদেশের হাজার বছরের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে কৃষক, লাঙ্গল,জোয়াল, মই, কৃষিজমি আবাদের উপযোগী করার জন্য এক জোড়া গরু অথবা মহিষ। লাঙ্গল দিয়ে হালচাষ করতে কমপক্ষে একজন লোক, গরু আর মহিষ, লাঙল, জোয়াল ও বাঁশের মই ছাড়াও হালচাষিরা আরো যে দুটি জিনিস ব্যবহার করেন তা হলো গোমাই আর পান্টি (লাঠি)। জমিতে বীজ বপন অথবা চারা রোপণের জন্য জমির মাটি চাষার ক্ষেত্রে হাল ব্যবহার করে আর ওই মাটি মাড়িয়ে সমান করার জন্য মই ব্যবহার করা হতো। আগাছা ঘাস নিরানির ্ও বীজ বপনের জন্য কাঠের গোড়ালী ্ও বাশঁ দিয়ে তৈরী বিন্দা ব্যবহার হতো, যা কৃষিকাজের জন্য ব্যবহৃত অন্যতম পুরনো যন্ত্র।

অনেকের জীবনের সিংহভাগ সময় কেটেছে চাষের লাঙ্গল জোয়াল আর গরুর পালের সঙ্গে। গরু দিয়ে হালচাষ করলে জমিতে ঘাস কম হতো, হালচাষ করার সময় গরুর গোবর সেই জমিতেই পড়ত। এতে করে জমিতে অনেক জৈব সার হতো, এ জন্য ফসলও ভালো হতো।

 গত ১০/১২ বছর আগেও একজন কৃষক অথবা কৃষি শ্রমিক নিজ হাতে জোড়া গরুর দড়ি তুলে নিয়ে গরু অথবা মহিষের কাঁধে জোয়াল তুলে দিয়ে মাঝখানে লাঙ্গল ইস জোয়ালের মাঝে বেঁধে গরু অথবা মহিষের হালচাষের দৃশ্য প্রতিটি গ্রামে দেখা যেত। মাঠ হতে ফসল তুলার পর শুরু হতো হালদিয়ে জমি চাষের কাজ যা ছিল গার্মের কৃষি খামারের চিরায়ত চিত্র।  

ধান মাড়াই

আধুনিক যন্ত্রপাতির প্রচলনে ধান রোপণ, কাটার পর হালের গরু দিয়ে ধান মাড়াইয়ের দৃশ্য এখন আর চোখে পড়ে না। কৃষিতে আধুনিকাযনের ফলে বিলুপ্তির পথে গরু দিয়ে ধান মাড়াই। কৃষিক্ষেত্রে নতুন নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও প্রচলনে এখন ধান বপন, রোপণ, ধানকাটা, মাড়াই করা এমনকি ধান থেকে চাল করা নেওয়াসহ প্রত্যেকটা কাজই সম্পন্ন হচ্ছে বিজ্ঞানের নব  আবিষ্কারে কল্যাণের দ্বারা তৈরী  অত্যাধুনিক প্রযুক্তির যন্ত্রপাতি দিয়ে।  গরু আর লাঙ্গল টানা সেই জরাজীর্ণ কৃষককে এখন আর দেখা যায় না। এতে কৃষকরা হালের গরু ছেড়ে চাষাবাদসহ সকল কৃষিকাজে এখন সাহায্য নেয় ট্রাক্টরের পাশাপাশি সকল আধুনিক যন্ত্রের। সবুজের মহাসমারোহে  রং আর ঋতু বৈচিত্র্যের দেশ বাংলাদেশ। প্রকৃতির পালাবদলে ঋতু চক্রের ঘূর্ণায়মান রূপকালে যখন হেমন্তের আগমন ঘটতো তখন গ্রাম বাংলার কৃষকরা ধান কাটার উৎসবে মেতে উঠতো। 

কৃষকরা দিনে ধান কাটা ও বাড়িতে আনার পর সন্ধ্যার আধাঁরে মাড়াইয়ের কাজে ব্যস্ত হয়ে উঠতো। এতো কর্ম ব্যস্ততার মাঝেও কৃষক, কৃষানির মুখে হাসির বলিরেখা,ফুটে উঠত। ধান মাড়াইয়ের পর গ্রাম বাংলার প্রতিটি কৃষক পরিবার মেতে উঠতো নবান্ন উৎসবে। নতুন চালের ভাত, পিঠা-পুলি, আর পায়েসের গন্ধ ভেসে আসতো প্রায় প্রতিটি ঘর থেকে।

তবে আধুনিক সভ্যতার ভিড়ে পুরানো ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে অনেকটাই শখের বসে মাঝে মাঝে কেউ কেউ এখনো হালের গরু দিয়ে ধান মাড়াইয়ের কাজ করেন । 

গরুদৌড় প্রতিযোগিতা

অগ্রাহায়ন ও পৌষ মাসে ধান কাটার পর থেকে ফালগুন-চৈত্র মাস পর্যন্ত ফসল বিহীন চাষ করা (চাক্কা ক্ষেতে) জমিতে পল্লীর জনপদে আযোজন করা হতো গরুদৌড় বা মইদৌড় প্রতিযোগিতা। বিনোদন প্রিয় আবাল-বৃদ্ধ বনিতার জন্য  গ্রামের মড়ল,সরদার মুরুুিব্বরা গ্রামীণ এলাক বা সমাজ ভিতিÍক সমিতি-সংঘ কিংবা কোথাও যুব সমাজের উদ্যোগে ঐতিহ্যের এ চিরচেনা মইদৌড়ের  আয়োজন করা হতো। এ উপলক্ষে বাহারী আয়োজনে জমতো গ্রাম্য মেলা। উৎসবে আমেজ ছড়িয়ে পরতো গোটা এলাকায়। গরুদৌড় প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠানে হাজার হাজার নারী, শিশু ও পুরুষ দর্শক উপস্থিত থেকে প্রতিযোগিতা উপভোগ করেন। এ সময় সেখানে এক ধরণের উৎসবের আমেজ সৃষ্টি হতো। এ প্রতিযোগিতা সেখানে আনন্দমেলায় রূপ নিতো। প্রতিযোগিতার মাঠে ফসল বিহীন চাষ করা (চাক্কা ক্ষেতে) আশপাশে বিভিন্ন প্রকার খৈয়ের নাড়–,মুড়ি-মুড়কি,লাল গুড়ের জিলাপী,পিঠা-পায়েস,নানান স্বাদের মিষ্টিসহ রকমারী খাদ্য সামগ্রীর পসরা  বাড়তি আকর্ষণ সৃষ্টি করতো।

গরুদৌড় প্রতিযোগিতা শুরুর আগ থেকে হাজার হাজার দর্শক মাঠে জড়ো হয়। সকাল থেকে শুর হয়ে এ খেলা চলে সন্ধ্যা পর্যন্ত  এলাকার রাস্তাগুলোতে নারী-পুরুষ ও শিশুদের ছিল উপচে পড়া ভিড়। এ প্রতিযোগিতাকে ঘিরে এলাকায় মেয়ে-জামাই ও দূর-দূরান্তের আত্মীয়রা এক-দুদিন আগেই চলে আসায় এলাকায় বাড়তি উৎসব বিরাজ করতো।

অত্যাধুনিক তথ্য ও প্রযুক্তির যুগে হালচাষ তথা কৃষিতে লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। হালচাষ, বীজরোপন, ধানের চারারোপন, বীজ ছিটানো, ধানকাটা, ধান মাড়াই, শষ্য পরিবহন, ধান সিদ্ধশুকনো ও ধানভাঙ্গাতে ব্যবহার হচ্ছে আধুনিক যন্ত্রপাতি। এমন কি জমির আগাছা মুক্ত করতেও ব্যবহার হচ্ছে যন্ত্রপাতি। কৃষি বিজ্ঞানীগণ কৃষি কাজে ব্যবহারের জন্য নতুন নতুন যন্ত্র আবিষ্কার করেছে। ফলে কৃষকদের জীবনেও এসেছে নানা পরিবর্তন। চাষবাদে সময় কমে এসেছে, যন্ত্রের ব্যবহারের ফলে উৎপাদন খরচ কমে এসেছে। সাশ্রয় হয়েছে কৃষকের শ্রম ঘন্টা। আগে শুধু দিনের বেলায় হালচাষ করা যেত। এখন যন্ত্রের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় রাতেও হালচাষ করা যায়। কৃষকের এখন দিনরাত্রি, বদলে গেছে জীবন-যাত্রার মান।

কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে গরু দিয়ে হাল চাষ। এই পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে সারা দেশের গ্রাম গঞ্জে। এখন আর কৃষকদের কাঁধে লাঙ্গল-জোয়াল ও হাতে জোড়া গরুর দড়ি দেখা যায় না। বিলুপ্ত হয়ে গেছে গরু ও মহিষ দিয়ে হালচাষের পদ্ধতি। ফসল মাড়াইয়েও লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। গরুদৌড় প্রতিযোগিতার দৃশ্য্ও চোখে পড়েনা।

বিজ্ঞানের নিত্যনতুন অবিষ্কার ও আধুনিক সভ্যতার প্রচলন এই দুইয়ের সমন্বয় কৃষিতে আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। বিজ্ঞানের এই নব নব আবিষ্কারের ভিড়ে আমরা হারাতে বসেছি আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতিকে, আমাদের স্বকীয়তা ও আমাদের সত্তাকে।  চাষাবাদ, ধান মাড়াইয়ে আধুনিক যন্ত্রপাতির পাশাপাশি এসব পুরানো ঐতিহ্য ও গরুদৌড় প্রতিযোগিতার মত গ্রামীণ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য্ও টিকিয়ে রাখার দরকার । 

লেখক : কবি, সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকর্মী। 



Somoy Journal is new coming online based newspaper in Bangladesh. It's growing as a most reading and popular Bangladeshi and Bengali website in the world.

উপদেষ্টা সম্পাদক: প্রফেসর সৈয়দ আহসানুল আলম পারভেজ

যোগাযোগ:
এহসান টাওয়ার, লেন-১৬/১৭, পূর্বাচল রোড, উত্তর বাড্ডা, ঢাকা-১২১২, বাংলাদেশ
কর্পোরেট অফিস: ২২৯/ক, প্রগতি সরণি, কুড়িল, ঢাকা-১২২৯
ইমেইল: somoyjournal@gmail.com
নিউজরুম ই-মেইল : sjnewsdesk@gmail.com

কপিরাইট স্বত্ব ২০১৯-২০২৪ সময় জার্নাল