ডা. আফতাব হোসেন :
মাত্র তিন সপ্তাহ আগে করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন সনাক্ত হয়েছিল সাউথ আফ্রিকা সহ আফ্রিকার কয়েকটি দেশে। তার মাত্র দুই দিনের মাথায় তড়িঘড়ি করে যুক্তরাজ্য দক্ষিণ আফ্রিকা সহ ছয়টি আফ্রিকান দেশকে লাল তালিকাভুক্ত করে এবং সেই সব দেশের সকল ফ্লাইট সাসপেন্ড করে দেয়। কিন্তু তাতে শেষ রক্ষা হয়নি। পরদিনই ইংল্যান্ডে প্রথম ওমিক্রন কেস সনাক্ত হয় এবং তারপর ওমিক্রন সংক্রামণ জ্যামিতিক হারে বাড়তে থাকে। ইতোমধ্যেই সে সংখ্যা পাঁচ হাজার ছাড়িয়ে গেছে।
১৪ ডিসেম্বর একদিনেই ৬৩৩ জন ওমিক্রনে আক্রান্ত হয়েছে। যুক্তরাজ্য যখন দেখল, অপেক্ষাকৃত গরীব দেশগুলোকে লাল তালিকাভুক্ত করে, সেই সব দেশের যাত্রীদের বাধ্যতামূলক হোটেল কোয়ারেন্টাইনে রেখে ওমিক্রনকে আটকানো যাচ্ছে না, মনের দুঃখেই কিনা জানি না, পুরা “লাল তালিকা”ই ঝেটিয়ে বিদেয় করে দিল! এখন আর কোনো দেশ থেকে যুক্তরাজ্যে এলে তিন লাখ টাকা খরচ করে দশ দিনের হোটেল কোয়ারেন্টাইন করতে হবে না। উল্টো আজ ১৩ টি দেশ খোদ যুক্তরাজ্যকেই লাল তালিকাভুক্ত করেছে! তাদের মধ্যে ভুটান, ইন্দোনেশিয়া, লায়োসের মতো গরীব দেশও আছে !
কিছুদিন আগে নাইজেরিয়া এই লাল হলুদ তালিকার জন্য যুক্তরাজ্যের বিরুদ্ধে বর্ণ বৈষম্যের অভিযোগও তুলেছিল। এ অভিযোগ আমারও আছে। কয়েক মাস আগে আমিও যুক্তরাজ্যে গিয়েছিলাম। গাঁটের তিন লাখ টাকা খরচ করে দশ রাত এগারো দিন একটা হোটেলের কামরায় বন্দি জীবন যাপন করতে হয়েছিল। নিজেকে তখন গুয়ান্তানামো বে এর কয়েদীর মতো মনে হয়েছিল। অথচ তখনও যুক্তরাজ্যে করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার বাংলাদেশের তুলনায় অনেক অনেক বেশি। শুধু তাই নয়, আমাদের বৃহৎ প্রতিবেশী দেশেও তখন করোনার সংক্রামণ ও মৃত্যু আমাদের তুলনায় বেশি ছিল। অথচ সে দেশকে অনেক আগেই লাল তালিকা থেকে মুক্তি দিয়েছিল যুক্তরাজ্য। তখন আমারও মনে হয়েছিল, গরীব ও ছোট দেশ থেকে গিয়েছিলাম বলেই হয়ত এই বৈষম্যের শিকার হয়েছিলাম।
সব চেয়ে মজার ব্যাপার হল, কয়েকদিন আগে খোদ ব্রিটিশরাই এই বাধ্যতামূলক হোটেল কোয়ারেন্টাইনকে অমানবিক ও ব্যক্তিস্বাধীনতার লঙ্ঘন বলে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে মামলা ঠুকেছিল। যদিও সে অভিযোগ হাইকোর্ট আমলে নেয়নি।
কিন্তু আমি ভাবছি অন্য কথা। আমার কেন জানি মনে হয়, করোনা কোনো এক বিশেষ মিশন নিয়ে এসেছে কিংবা কেউ তাদের পাঠিয়েছে। এই যে ধনী গরীব, আশরাফ আতরাফ, উন্নত বনাম অনুন্নত বিশ্বের বৈষম্য, কিংবা এই যে পৃথিবীকে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় বিশ্বে বিভাজন, এ সব নির্মূল করতেই করোনার আগমন। নইলে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী ও সম্পদশালী দেশ আমেরিকায় আট লক্ষ মানুষ কেন করোনায় মারা যাবে? কেন স্বাস্থ্য বিজ্ঞানের সূতিকাগার যুক্তরাজ্যে দেড় লক্ষ মানুষ করোনায় প্রাণ হারাবে ? সে তুলনায় এশিয়া ও আফ্রিকার গরীব দেশগুলো তো স্বর্গের কাছাকাছি আছে!
আমার কেবলই মনে হয়, একা ভালো থাকার দিন ফুরিয়ে এসেছে। ভালো থাকতে হলে, বেঁচে থাকতে হলে, সারা বিশ্বের সবাইকে নিয়ে ভালো থাকতে হবে। সবাইকে নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে। গরীব দেশের মানুষ এক ডোজ ভ্যাকসিনও পাবে না, অথচ নিজেরা ডাবল, ট্রিপল ডোজ ভ্যাকসিন নিয়ে ভাববেন পুলসিরাত পার হয়ে গেছেন, সে গুড়ে বালি। ওমিক্রন বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে তা দেখিয়ে দিচ্ছে। স্বাস্থ্য মানুষের মৌলিক অধিকারগুলোর মধ্যে অন্যতম। প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, যে বিশ্বেই বাস করুক না কেন, সে অধিকার সকল মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে হবে। নইলে যতই লাল, হলুদ, সবুজে ভাগ করুক পৃথিবী, কারও নিস্তার নেই। কবে বিশ্ব মোড়লদের এই বোধোদয় হবে, আমি সেই প্রতীক্ষায় আছি।