আত্মত্যাগ
পাখির কিচিরমিচির ডাকে ঘুম ভেঙ্গে যায় শেফালির। ও একগাদা বিরক্তি নিয়ে কপাল কুঁচকে চোখ খুলে তাকায়। তাকিয়ে দেখে জানালার শিক গলে এক চিলতে সোনাঝরা রোদ এসে ভাসিয়ে দিচ্ছে ওর বিছানা। জানালার বাইরে বকুল গাছের ডালে দুইটা টুনটুনি পাখি লেজ নেড়ে নেড়ে কিচিরমিচির করেই যাচ্ছে। ওরা ঝগড়া করছে না প্রেমালাপ করছে কে জানে। একটু পরে দুজনেই উড়ে গিয়ে আবার ঘনিষ্ঠ হয়ে বসল একই ডালে। শেফালি ভাবল মনে হয় প্রেমই করছে, ঝগড়া করলে তো দুইজন দুই ডালে বসতো।
শেফালি অবাক হল এতো বেলা হয়ে গেছে তাও ওর মায়ের ডাকাডাকি এখনো শুরু হয়নি দেখে। সাধারত ফজরের সময়ই ওর মা ডাক দেয় নামাজ পড়ার জন্য। কোন রকমে নামাজ পড়ে আবার ঘুমাতে এলে মা চেঁচামেচি করে, ও এতবড় মেয়ে, মা এতো কষ্ট করে ঘরের সব কাজ করে আর মেয়ে কোন সাহায্য করে না, শুধু ঘুমায়। বিয়ে দিয়ে একে পরের বাড়ি পাঠাতে পারলেই তার শান্তি। মা আবার আশঙ্কা প্রকাশ করে এই বলে যে নিষ্কর্মা, অপদার্থ মেয়েটি স্বামীর সংসার করে খেতে পারবে না।
মা তার বক্তব্য শেষ করে এই বলে, 'বিয়া অইলে তোরে তো ফিরাইয়া দিয়া যাইবে'। মায়ের আর সব গালগালাজ সহ্য হলেও এই কথাটা শুনে শেফালির খুব মন খারাপ হয়, ও ভাবে একজন মা তার মেয়েকে এই রকম একটা খারাপ কথা বলে কেমন করে! শেফালি মনে মনে ভাবে বিয়ে হলে আর এ বাড়ি আসবে না।
এইসব ভাবনার মাঝেই মায়ের গলা শোনা যায়, তবে বরাবরের মত চিল চিৎকারে না। মা বলে, 'ও শেফালি উইঠা আমার লগে এট্টু রান্না ঘরে কাম কর'। শেফালির হঠাৎ মনে পড়ে বাড়িতে দুলাভাই আছে তাই মায়ের গলার স্বর এতো নিচু। নাহলে এতক্ষণ ঘুমানো যেতো না।
শেফালির বড় বোন ফরিদার বাচ্চা হবে বলে মাসখানেক ধরে বাবার বাড়িতে আছে। ফরিদার বর হাবিব কালই এসেছে স্ত্রীর খোঁজ খবর নিতে আর এবার বেশ কিছুদিন থাকারও ইচ্ছা। বাড়িতে কাজ কাম নাই। ওর ইচ্ছা বাচ্চা হলে একবারে বাচ্চা আর বউকে নিয়ে বাড়ি যাওয়ার।
শেফালি পুকুর থেকে হাত মুখ ধুয়ে রান্না ঘরে গিয়ে দেখে ওর বুবু একটা জলচৌকির উপরে বসে পিঁয়াজ কাটছে। ও বলে, 'বুবু আপনে দেন আমি কাটি'। শেফালির অনেক খিদা লেগেছে, কিন্তু এখন বললে মা আর এক প্রস্থ রাগ করবে তার চেয়ে রান্না বান্নায় সাহায্য করলে তাড়াতাড়ি খাওয়া যাবে। খালি চায়ের হাড়ি দেখে বুঝল সবাই চা মুড়ি খেয়েছে সকালে উঠেই। এক চুলায় ভাত ফুটছে, আর এক চুলায় ডাল চাপানো হয়েছে। ওর মা বলল, 'তুই কাইল রাইতের থালাবাটি, পাতিলগুলা আর চায়ের কাপ-পিরিচগুলা ধুইয়া আন'।
পুকুর পাড়টা শেফালির খুবই প্রিয় একটা জায়গা। বিনা কাজেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা এখানে বসে কাটিয়ে দিতে পারে। গাছপালা, পাখি, গুইসাপ, ব্যাঙ, আরজিনা আর কচ্ছপ দেখে। গরমকালে শিমুল গাছটায় লাল টুকটুকে ফুল ফোটে, দেখতে শেফালির খুব ভালো লাগে। সারাবছরই পুকুরপাড়ের কোন না কোন গাছে ফুল ফোটে। এখন যেমন শিউলি গাছটার তলা ছেয়ে আছে কমলা বোঁটার সাদা ফুলে। অসম্ভব সুন্দর ফুগুলো তুলে নিয়ে বুবুর জন্য একটা মালা গাথার খুব ইচ্ছা ওর, কিন্তু এখন ওসব করলে মা রাগ করবে। শেফালি ধীরে সুস্থে কুটার মধ্যে ছাই নিয়ে হাড়ি মাজতে থাকে। ও আস্তে ধীরেই কাজ করে, এগুলো ধুয়ে নিয়ে গেলে দেখা যাবে মা আর একটা কাজ ধরিয়ে দিয়েছে।
শেফালি পুকুর থেকে ফিরে এসে দেখে পাঁচ ফোড়ন দিয়ে মায়ের ডালে বাগার দেয়ার গন্ধে রান্না ঘর ম ম করছে। বুবু আলু ভর্তা মাখছে। মা ডিম গুলে নিয়ে ভাজার জন্য কড়াইয়ে তেল দিয়েছে। মা বলল, 'গামলায় ভাত বাড়'। শেফালি ভাত বাড়ল আর প্লেট গ্লাস নিয়ে গিয়ে সামনের বারান্দায় হোগলা বিছিয়ে ওর আব্বা, ভাই আর দুলাভাইয়ের খাওয়ার ব্যবস্থা করলো। খেতে বসে ওর আব্বা বলল, 'পটুয়াখালী শহরে মিলিটারি আইয়া পড়ছে, আমাগো বাড়ি আসা দুই একদিনের ব্যাপার। এদিকে গত হাটে কেরোসিন পাই নাই। আইজ গিয়া দেহি পাই কিনা। দামও তো বাইড়া গেছে অনেক। ওর মা বলল, 'নুন আর সরিষার তেল ও আইন্নেন একটু'।
- হ, পাইলে আনমু আনে।
জামাই হাবিব বলে, 'আব্বা সাবধানে থাইকেন। মিলিটারিরা হুনছি কোন বাছবিচার করে না, যারে খুশি তারেই মারে'। ছোট ছেলে ফারুক বায়না ধরে, 'আব্বা তোমার লগে আডে যামু'।
- না বাজান, আইজ না।
শেফালির মা বলে, 'জামাই শেফালির জন্য পোলা দেহো, ওর বিয়া দিমু'।
ওর আব্বা রেগে বলে, 'যুদ্ধের মধ্যে মাইয়ার বিয়া দিবা? তুমি দেহি '"ঘর পোড়ার মধ্যে আলু পোড়া" দেতে চাও'।
- মিলিটারির ডরেই তো তড়াতড়ি বিয়া দেতে চাই।
সবাই এক অনিশ্চয়তার আশঙ্কায় চুপ হয়ে যায়। মনে মনে সবাই ভয় পায়, একটা আস্থির সময় যাচ্ছে।
খেয়ে দেয়ে শেফালির আব্বা হাটে চলে গেলো। জামাই হাবিব বলে, 'আম্মা একটু হাওলাদার বাড়ি যাইয়া ঘুইরা আসি।
হাবিবের সাথে গ্রামের সমবয়সি অনেক যুবকের খাতির। ও আসলেই সবাই মিলে হাওলাদার বাড়ির কাছারিতে ক্যারাম খেলে আর গল্প করে।
এখন আর আগের মত খেলা, হাসাহাসি আর গল্প জমে না। সবখানেই মিলটারিদের অত্যাচার আর মুক্তিবাহিনীর বীরত্বের আলোচনা। আজ সবাই মিলে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের খবর শুনল। তারপরে শুরু হলো গান, "মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি"। সবার মন খুব খারাপ, সারা দেশে চলছে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তাণ্ডব। আর তাদের সাহায্য করছে রাজাকার, আলবদর বাহিনী। মুক্তিবাহিনী গেরিলা আক্রমণ চালাছে এখানে ওখানে। গ্রামের অনেক যুবকই মুক্তিযুদ্ধে চলে গেছে। এখনো অনেকে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এমনই একজন শফিক। শফিক হাবিবকে বলে, 'দুলাভাই, দুই একদিনেই মধ্যে আমরা কয়েকজন যুদ্ধে যামু। আপনে যাইবেন?
- জানোই তো তোমার বুবুর মাস খানেকের মধ্যেই বাচ্চা অইবে। এ অবস্থায় ওর কাছে আমার থাহা উচিত। আমি আবার চিন্তা করি যুদ্ধে যাইয়া যদি মইরা যাই, আমার বাচ্চাডা এতিম অইয়া যাইবে না! এতিম বচ্চাগো বড় কষ্ট অয়। আমি নিজে এতিম আছিলাম। চাচার বাড়িতে খাইয়া না খাইয়া অনেক অযত্ন আর অবহেলায় মানুষ অইছি।
হাবিবের জল ছলছল চোখের দিকে তাকিয়ে শফিক বলে, 'ঠিক আছে, দুলাভাই আমনের যাওয়া লাগবে না'।
শেফালিকে ভাত খাওয়ার পরে ওর মা বলে, 'ভাত কয়ডা খাইয়াই টইটই কইরা পাড়া বেড়াইতে যাইও না। ছাগডারে এত্তু ঘাসে বাইন্ধা আইয়ো।
হাওলাদার বাড়ির কাছারি ঘরে রেডিওতে গান শুনতে শুনতেই ওরা বাইরে হইচই শুনতে পেয়ে ঘর থেকে বের হয়ে এসে শুনল লোকজন বলছে যে গ্রামে মিলিটারি এসে পড়েছে। ওরা দেখার জন্য দৌড়ে বাড়ির সামনে এসে দেখে দূরে গ্রামের পুর্বদিকে কিছু বাড়িতে আগুন জ্বলছে। ওদিক থেকে চিৎকার চেঁচামেচি আর গুলির আওয়াজ ভেসে আসছে। হাবিব ছুটল বড় রাস্তার দিকে। পিছন থেকে শফিক বলল, 'দুলাভাই, এহন আমনেগো বাড়ির দিকে যাইয়েন না, বড় রাস্তায় মিলিটারির সামনে পড়বেন। চলেন আমরা ঘরের পিছন দিক দিয়া ওই দক্ষিনের জঙ্গলের মধ্যে পলাই গিয়া'।
হাবিব যেতে যেতে চিৎকার করে বলে, 'না আমাগো বাড়ি আম্মা, তোমার বুবু, শেফালি আর ফারুক রইছে, হ্যাগো কী অবস্থা আগে দেহি'।
হাবিব বড় রাস্তায় উঠে পুবের দিকে তাকিয়ে দেখতে পায় আগুণের উল্লাস। ভয়ে ওর অন্তর কেঁপে ওঠে। ও পশ্চিমে ওদের বাড়ির দিকে দৌড়াতে থাকে। ভাবে ওদের বাড়িতে আগুন দিলে না জানি ওর বউ ফরিদার কী অবস্থা। অত ভারি শরীর নিয়ে ও কী পালাতে পারবে? আর কিছুই ভাবতে পারে না হাবিব। আরো কিছুদূর গিয়ে ওদের বাড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে আগুন জ্বলছে না। কোন চিৎকার চেঁচামেচি কিছুই নেই, পুরা শুনশান। হাবিব একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সামনে আগায়। কিন্তু এ স্বস্তি বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। হাবিব সামনে তাকিয়ে দেখে দুইজন মিলিটারি ওর শালী শেফালির দুই হাত শক্ত করে ধরে আছে বাহু বরাবর, আর শেফালি ভয়ে কাঁদছে। মিলিটারি দুজন ওকে হাতের ইশারায় কাছে ডাকল। ও কাছে আসতেই বলে, 'ইস লারকি কো পাহারা দাও। হাম আভি আ জাউঙ্গে'।
- জী হা।
মিলিটারি দুইজন চলে গেলো পুবের দিকে আগুন, লুট আর হত্যার পৈশাচিক আনন্দে মাততে। মিলিটারি দুইজন চোখের আড়াল হতেই হাবিব বলল, 'তোমার বুবু, আম্মা এরা কই?
- মনে অয় বাড়ি আছে।
- মিলিটারি আমাগো বাড়ি যায় নাই?
-না।
- তোমারে পাইল কই?
- আমি ওই খেতে ছাগল বানতে আছিলাম। মিলিটারি দেইখা ভয়ে দৌড় দিছি। ওরাও দৌড় দিয়া আমারে ধরছে।
- ঠিক আছে এহন সোজা দৌড় দিয়ে ওই যে দূরে কাশবন আছে ওর মধ্যে ঢুইকা লুকাইয়া থাকবা। ওর পরে যে জংগল আছে
ওইদিকে যতদূর পারো যাও। মিলিটারি চইলা গেলে বাইর অইবা।
- আপনেও চলেন।
- না, ওরা আমাগো বাড়ি আগুন দেতে পারে, তোমার বুবু, আম্মা আর ভাইরে লইয়া আমি আইয়া পরমু তুমি দৌড় দেও।
শেফালি দৌড় চলে গেলো। ও কাশবনের ভিতরে পুরা অদৃশ্য হওয়ার আগ পর্যন্ত হাবিব তাকিয়ে থাকলো। এবার হাবিব ভাবছে ফরিদা কী হেঁটে হেঁটে অত দূরে যেতে পারবে, নাকি নদীর ওদিকে যেয়ে দেখবে কোন নৌকা পেলে কিছুক্ষণ নৌকায় লুকিয়ে থাকা যায় কী না। ও কী একটু বেশি সময় ধরেই ভাবছিল? হঠাৎ পুর্বদিকে তাকিয়ে দেখে সর্বনাশ যে মিলিটারি দুজন শেফালিকে ওর কাছে রেখে গিয়েছিল, সেই দুজনই এদিকে আসছে। হাবিব দৌড় দেয়ার কথা ভাবে একবার, আবার ভাবে দৌড় দিলে গুলি করবে। তাই ও দাঁড়িয়ে থাকে। ওরা এসে জানতে চায় মেয়েটা কোথায়? হাবিব আঙ্গুল তুলে পশ্চিমে নদীর দিকে দেখিয়ে দেয়, কিন্তু শেফালি গেছে দক্ষিণ দিকে। গ্রামের পশ্চিম দিকে পায়রা আর উত্তর দিকে লোহালিয়া নদী। মিলিটারিরা অসম্ভব রেগে যায়। তবুও ওর দেখিয়ে দেয়া পথে ওকে সাথে নিয়ে হাঁটতে থাকে। হাঁটতে হাঁটতে নদীর পাড়ে চলে আসে, কিন্তু ত্রিসীমানায় শেফালির কোন চিহ্ন নেই। ওরা পাগলা কুকুরের মত ক্ষিপ্ত হয়ে যায়। ক্ষুধার্ত বাঘের মুখের সামনে থেকে যদি কেউ তার শিকার ভীরু হরিণ শাবককে কেড়ে নিয়ে যায়, তাহলে বাঘ যেমন হিংস্র হয়ে যায়, তেমনই হিংস্র হয়ে উঠলো ওরা।
মিলিটারিরা বুঝতে পারলো হাবিব ইচ্ছা করেই শেফালিকে পালাতে দিয়েছে। হাবিবকে পিছন থেকে বুটজুতা পরা পায়ে জোরে লাঠি দিলো একজন। ও উপুড় হয়ে পড়ে গেলো নদীর পাড়ে অন্যজন বন্দুক উঁচু করে হাবিবের পিঠে এক ঝাঁক গুলি করে দিলো, ঠা ঠা ঠা ঠা। এই শব্দ ছাপিয়ে হাবিবের চিৎকার, আর্তনাদ বা উহ-আহ কোন শব্দই শোনা যায় না। তবে তীব্র ব্যথায় ওর শরীরটা কয়েকবার কেঁপে উঠে, তারপরে নিথর হয়ে যায়।
ওর না জন্মানো শিশুটি এতিম হয়ে যাওয়ার দুঃখে কী মৃত্যুর আগে দুচোখ বেয়ে দুফোঁটা জল গড়িয়ে পড়েছিল?
পায়রা নদীতে সেই শৈশব থেকে কতো ঝাপাঝাপি করেছে আর সাঁতার কেটেছে! কতবার ঝড়ের মুখে পড়ে নৌকা ডুবে মরতে বসেছে, আর কত যে মাছ ধরেছে! সেইসব কথা মনে করেই হয়তো নদীর ঢেউ এসে উপুড় হয়ে পড়ে থাকা হাবিবের চুলগুলোকে পরম যত্নে ছুঁয়ে দিয়ে যায়।
লেখক পরিচিতি :
জেসমিন আরা বেগম,
কেমিকৌশলী, ১৩ তম বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের সদস্য এবং বর্তমানে আমেরিকা প্রবাসী।
প্রাক্তন উপ-পরিচালক, বাংলাদেশ লোক প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, (বিপিএটিসি)।