মাসুদ মিয়াজী
যখন কোন পরিস্থিতি আপনি নতুন, তখন যা করতে হবে, হামাগুড়ি দিয়ে ক্রমেই এগিয়ে যাওয়া এবং ব্যাপারগুলো সমন্বয় করা। বাইডেন প্রশাসন নিয়ে একথা বলছিলেন, ক্রিস্টেন ফনটেনরস, যিনি ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনে নিরাপত্তা পরিষদের গালফ বিষয়ক দায়িত্বে ছিলেন। ফনটেনরস এ কথা বলছেন এমন এক সময়ে যখন বহুল প্রত্যাশিত নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট বাইডেনের কাজের সমালোচনা হচ্ছিল খোদ যুক্তরাষ্ট্রে।
যেসব পররাষ্ট্র নীতিকে প্রাধান্য দিয়ে নির্বাচনের আগে নজর কেড়েছেন বাইডেন, তাতে এখনই হিসাব মেলাতে পারছেন না মার্কিন নাগরিকরা। তবে কি বাকি সব প্রার্থীর মতো বাইডেনও কেবল বিজয়ী হতেই এমন সব পলিসি ঠিক করেছিলেন? সম্প্রতি ওয়াশিংটন পোস্ট আর নিউইয়র্ক টাইমসে মার্কিনীদের মতামত দেখে বুঝা যায় এমন প্রশ্ন নাগরিকদের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আরব নিয়ে কি ভাবছেন বাইডেন, সেসবই গত কয়েকদিন ধরে গুরুত্বপূর্ণ বিশ্লেষণ হয়ে এসেছিল গণমাধ্যমে।
মধ্যপ্রাচ্য সবসময়ই বিশ্ব রাজনীতির আলোচনার বিষয়। মার্কিন পররাষ্ট্র নীতিতেও এটি অন্যতম প্রধান। যে প্রেসিডেন্টই ক্ষমতায় থাকুক, তিনি মধ্যপ্রাচ্যে কি ঘটাতে চাচ্ছেন এর উপর তার মেয়াদের সফলতার হিসাবও কষা হয় দ্রুতই। ট্রাম্প তার বিদায়কালের শেষ ভাষণে বলেছেন, যা করতে এসেছিলাম তার সবটাই করেছি, বেশীও করেছি। এ বক্তব্য শোনার পর আপনি তাৎক্ষণিক ই মনে করার চেষ্টা করবেন ট্রাম্প বিশেষত কি কি কর্ম সম্পাদন করছেন তার আমলে। তখনই মস্তিষ্ক আপনাকে স্মরণ করিয়ে দিতে পারে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সেসব টুইট, যেথায় তিনি মধ্যপ্রাচ্যে নিয়ে অবাক করা খবরগুলো নিয়ে হাজির হতেন। তিনি দাম্ভিকতার সহিত বলে গেছেন কিভাবে ইসরায়েলের সাথে মধ্যপ্রাচ্যের আরবদেশগুলোর দারুণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত করেছেন নিজে যা একসময়ে কল্পনাতীত ছিল। যদি ট্রাম্প এমন কিছু কাজের এজেন্ডা নিয়ে ক্ষমতায় এসে থাকেন তবে তাকে সফল বলতে দেরী করা যায় না বোধদয়!
রীতি ভঙ্গ করে ট্রাম্প তার শাসনকালের প্রথম সফর শুরু করেছিলেন সৌদি আরব সফরের মাধ্যমে। এরপর তার গোটা মেয়াদে সময়ের পরিক্রমায় দারুণ মজবুত সম্পর্ক তৈরী হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র এবং সৌদির মধ্যে। সিনেটে যখন সৌদির কাছে অস্ত্র বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞার কথা বারবার আসে তখন শক্ত হাতে সেসব আওয়াজ বন্ধ করে দিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট। বরং ইয়েমেন ইস্যূতে সৌদি আরবের জন্য সহযোগিতা জোরদার করা হয়, অতিরিক্ত মার্কিন সৈন্য সৌদিতে পাঠানোর ব্যবস্থাও করা হয়। বাইডেন নির্বাচনী সমাবেশগুলোতে ঠিক এ ব্যাপারটাতেই আলেকপাত করেছিলেন। প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, ক্ষমতায় আসলে ইয়েমেনে সৌদি অভিযানে সহযোগিতা বন্ধ করবেন, পুনর্বিবেচনা করবেন সৌদি-মার্কিন সম্পর্ক, অগ্রাধিকার পাবে মানবাধিকার।
প্রতিশ্রুত পথে কতটুকু এগিয়েছেন বাইডেন? এ পূর্ণ উত্তর মেলাবার সময় এখনো শেষ হয়নি। তবুও একটা বার্তা দেয়া যে দরকার তা বাইডেন অনুভব করেছেন। ফলে তিনি প্রকাশ করলেন জামাল খাশোগী হত্যা বিষয়ে নতুন রিপোর্ট, যেখানে ঘটনার সাথে যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সংশ্লিষ্টতা তুলে ধরা হয়। কিন্তু কয়েকজন সৌদি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা ছাড়া কারো বিরুদ্ধে তেমন নতুন কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। ইয়েমেন ইস্যূতেও কোন পরিবর্তনে যায়নি যুক্তরাষ্ট্র। ফলে সমালোচনা হচ্ছে বাইডেন কেন নয়া কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না।
খাশোগী ইস্যূতে সৌদি শাসক বা দেশটির জন্য আদৌ কোন ব্যবস্থা নেয়া বাইডেন প্রশাসন তথা যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে সম্ভব কিনা তা এখন বিবেচ্য বিষয়। যুক্তরাষ্ট্র তার অন্যতম মিত্রকে হারানোর মতো কোন ঝুঁকি নিবে কি! এ সূত্র মেলাতে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট জানাচ্ছে, সৌদি আরবের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিংকেন আরও মজুবত করে বলেছেন, এ সম্পর্ক তাৎপর্যপূর্ণ, কিংডম রক্ষায় আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
প্রশ্ন, তাহলে নতুন করে এ রিপোর্ট প্রকাশেরই বা কি দরকার ছিল! উত্তর পাওয়া যায় হোয়াইট হাউজ সেক্রেটারী জেন সাকির কথায়। বলেন, এটি আমাদের উদ্দেশ্য ছিল; আমরা পরিষ্কার করতে চেয়েছি যে বিগত ৪ বছর ব্যাপারটা কেমন চলছিল আর এখন কিরূপ পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যাবে। কিন্তু আদতে কোন তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তনের সুযোগ যে নেই তা তো এন্টনি ব্লিংকেনের কথায় পরিষ্কার। প্রকৃতই যুক্তরাষ্ট্রের নীতির বিষয়ে তেমন কোন বদল হয়নি কখনো। ট্রাম্প প্রশাসন বা বাইডেন টিমের কাজের ধরনগত পরিবর্তন পরিলক্ষিত হলেও ফলাফল একই। যেটি ট্রাম্প প্রকাশ্যই করেছেন তা বাইডেন কূটনৈতিক বা কৌশল মেনে সম্পাদন করবেন।
সৌদি আরবের সহিত যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক ধরে রাখার প্রয়োজনীয়তা এখনও ব্যাপক।
সিরিয়া, ইরাকে মার্কিন অবস্থান নিরাপদ রাখতে সৌদির সহযোগিতা দরকার। মধ্যপ্রাচ্য ইরানের মত শক্তি মোকাবেলায় সৌদিকে হাতছাড়া করার সুযোগ নেই। এদিকে তুরস্কের সহিত সৌদির সম্পর্কন্নোয়ন ভাবনা এগিয়ে গেলে তা যুবরাজকে কিছুটা সুবিধা দিবে। এছাড়া সৌদি আরবের ভৌগলিক অবস্থানটাও দেশটিকে বিশেষ গুরুত্ব এনে দিয়েছে। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম তেল রিজার্ভের দেশ সৌদির অন্যতম ক্রেতা যুক্তরাষ্ট্র, সম্পর্ক বিরূপ হলে এ তেল ক্রমেই চীন, জাপান, ভারতের দিকে পুরোদমে চলে যাবে তা ইতিমধ্যেই বুঝা যাচ্ছে। আর যুক্তরাষ্ট্র তার সেরা অস্ত্র ক্রেতাকে কোন ভাবেই মিস করতেও নিশ্চয়ই চাইবে না।
বাইডেন এও জানে যে আজকের যুবরাজ আগামীর রাজা। তবে কেন এমবিএসের বিরুদ্ধাচারণ করতে গিয়ে এমন ঝুঁকি নিবে! আবার কৌশলগত উপায় কার্যকর করতে চায় বাইডেন, দেখাতে চায় কূটনৈতিক শক্তিমত্তা। সৌদি প্রশাসনকে তাই জানিয়ে রেখেছে ভবিষ্যতে যেন এমন কিছু আর না ঘটে।
তেল নির্ভরতা কমিয়ে পশ্চিমা বিনিয়োগ পেতে সৌদিকেও পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। মানবাধিকার ইস্যূকে সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্র যে কর্মকৌশল সাজায় তা মোকাবেলার জন্য কিছু জায়গায় উদারও হচ্ছে সৌদি প্রশাসন, নারীদের সুযোগ করে দেয়া হচ্ছে কিছু কিছু ক্ষেত্রে। ভিশন ২০৩০ সামনে রেখে নতুন পরিকল্পনায় কাজ করে যাচ্ছে যুবরাজ সরকার। দেশটির ৬৭ শতাংশ নাগরিক ৩২ বা তার কম বয়সী, এ বিপুল সংখ্যক তারুণ্যের কর্মক্ষেত্র বিস্তৃত করতে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
নিরাপত্তা নিয়ে সৌদির শঙ্কা সাম্প্রতিক কালে আরও তীব্র হয়েছে। ইয়েমেনে দীর্ঘ সময় ধরে অভিযান চালানোয় ব্যয় যেমন বেড়েছে তেমনি দুর্নামও বাড়ছে। ইয়েমেন থেকে যে হামলাগুলো এখন সৌদির তেল ক্ষেত্র ও গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে করা হচ্ছে তা দেশটির নিরাপত্তা শঙ্কাকে বাড়িয়েছে আরও। ফলে নিরাপত্তা ইস্যূতে মার্কিন নির্ভরতা বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্র ইরানের সাথে পরিমাণু চুক্তিতে ফিরলে ইরানের নিষেধাজ্ঞাগুলো উঠে যাবে, তখন বাণিজ্য, অস্ত্র কেনা ইরানের জন্য সহজ হবে। ফলে সৌদি চাইবে না যুক্তরাষ্ট্র চুক্তিতে ফিরুক।
কার্যত যুক্তরাষ্ট্র এবং সৌদি আরব দু'পক্ষের জন্যই সম্পর্ক ধরে রাখার প্রয়োজনীয়তা কমেনি। অস্থিতিশীল মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্র তার চলমান যুদ্ধগুলো শেষ করতে পারেনি। সিরিয়া, ইরাকে বারংবার হামলার স্বীকার হচ্ছে মার্কিন সেনারা। কাশেম সোলায়মানী হত্যার পর ইরানের সাথে বৈরীতা ক্রমেই বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে থেকে গুটিয়ে গেলে তা চীনকে এখানে প্রবেশ করতে সহজ করে দিবে। ফলে এসব ফ্রন্টে চোখ রাখলে বুঝা যায়, সৌদিতে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ কমে গেছে বলে যে আওয়াজ রয়েছে তা বলার সময় এখনই নয়। তবে এটি সত্য যে, রাষ্ট্রের অন্যসব প্রতিষ্ঠানকে সক্ষম আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন করতে না পারলে কেবল তেল সম্পদ নির্ভর সৌদির ভবিষ্যৎ অনিরাপদ, তখন হাতছাড়া হতে পারে আঞ্চলিক নেতৃত্বের জায়গাটাও।
লেখক : আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক
masud.meazi44@yahoo.com