মুখোশ
ডাহুক ডাকা সন্ধ্যার অন্ধকারে মাটির টিমটিমে পিদিমে
সাহস জাগানিয়া যে জীবনের শুরু,
তাকে বোশেখের চড়া রোদ্দুরে, মাঝ রাস্তায় দাঁড় করিয়ে,
হাতে কতগুলো শেয়াল, কুকুর আর হুতোমপেঁচার মুখোশ ধরিয়ে দিলে তুমি,
আর বললে, আজ পয়লা বৈশাখ, এরা তোমার সাহসের সঙ্গী,
রাজ্যের বাঘ, সিংহ আর ইঁদুর, বাদরের সাথে ঘোট পাকিয়ে
শুরু হোক নতুন বছরের শুভ যাত্রা।
আমার ভেতরে তখন মুখোশগুলো
ভয় জাগানিয়া নৃত্য শুরু করেছে।
কি করে এরা আমার আপনার হতে পারে বলো?
আমি যে মুখোশ ভারি ভয় পাই।
আমি টলটলে এক স্বচ্ছ নদীর ধার থেকে এসেছি,
যার পাড়েই আছে মস্ত এক কদম ফুলের গাছ।
সারাবছর কালো ঝিরিঝিরি ঢেউয়ের ওপর কদম গাছ
তার অবিকল ছায়া দেখতে পায়।
আমিও কতদিন যেন উঁকি দিয়ে দেখেছি,
আমার চুলের বিনুনি।
ঐ নদীটা ছিলো আমাদের ছেলেবেলার আয়না,
আমাকে চিরকাল পষ্ট ছবিটা দেখাতো।
তার আর আমার মাঝে তো মুখোশ ছিলো না কখনো।
পাড়াগাঁয়ে কদাচিত ভুমিকম্প হতো,
কখনো তালগাছ উপড়ে পড়া তুমুল ঝড়,
আমাদের ঘরে ঘরে আযানের সুর ছড়িয়ে যেতো,
সম্মিলিত আযানের সুর দুরন্ত ঝড়কে থামিয়ে দিতে,
কি বিপুল আবেদনে ঊর্ধমুখী হতো।
দূরের হিন্দুপাড়া থেকে ভেসে আসতো উলুধ্বনি আর কাঁসর ঘন্টা।
সবাই যে যার মতো করে সাহস জাগানিয়া সুর তুলতো,
আর আমাদের মস্তিষ্কে পৌঁছে যেতো সাহস জাগানিয়া বার্তা।
আমি জানতাম এ আযান, এ আমার পরিচয়,
এ আমার আজন্মলিপ্সা সাহসের সুর।
মাকে চিরকাল ঘোমটায় মুখ ঢেকে চলতে দেখেছি।
মা আর ঘোমটা, কি অপুর্ব সামঞ্জস্য!
আঁচলের আড়াল ছাড়া মা যেন মা হতেই পারে না।
অথচ আজ আমি যখন মা—
প্রচণ্ড হিমে ডোবা ডিসেম্বরের শেষ রাতে,
তুমি আমায় পশ্চিমা পোশাক দিয়ে বললে,
পরো আর বাইরে এসো,
চলো আতশবাজি পুড়িয়ে নববর্ষকে উদযাপন করি।
তা কি করে হয় বলো?
ঘোমটাহীন এ পোশাক আমি কেমন করে পরি?
এ যে আমার কাছে মস্ত বড়ো মুখোশ
আর আমি মুখোশ ভারি ভয় পাই।
শেখ ফাহমিদা নাজনীন
২৯ ডিসেম্বর ২০২১।