ডাঃ মোঃ রাকিবুল হাসান :
দীর্ঘদিন গ্যাসের ওষুধ খেলে কেন হঠাৎ করে বন্ধ করা যায়না?
গ্যাসের ওষুধ /মূলত প্রোটোন পাম্প ইনহিবিটর (omeprazole, esomeprazole, pantoprazole, lansoprazole, rabeprazole, etc)- দীর্ঘদিন এই ওষুধ খেলে আমাদের শরীরে ২ টা পরিবর্তন হয় যা হঠাৎ করে গ্যাসের ওষুধ বন্ধ করতে বাঁধা দেই।
১। আমাদের পাকস্থলীর Enterochromaffin-like (ECL) cell/ কোষ হাইপারপ্লাসিয়া বা সাইজে অনেক বড় হয়ে যায়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এটা ক্যান্সারেও পরিনত হতে পারে।
২। দীর্ঘদিন গ্যাসের ওষুধ সেবনের কারনে আমাদের রক্তে গ্যাস্ট্রিন নামের একটি হরমোন অনেকগুনে বেড়ে যায় (হাইপার-গ্যাস্ট্রিনেমিয়া)। এটি আবার পাকস্থলী থেকে বেশি বেশি গ্যাস্ট্রিক এসিড তৈরীতে সাহায্য করে।
এই দুটি পরিবর্তনের কারনে আপনি দীর্ঘদিন গ্যাসের ওষুধ খাওয়ার পর বন্ধ করলে পাকস্থলীর কোষগুলো আরও অনেক বেশি বেশি করে এসিড তৈরী করা শুরু করে সাথে রক্তে আগে থেকেই অপেক্ষা করছে উচ্চমাত্রার গ্যাস্ট্রিন হরমোন যা এসিড তৈরীর মাত্রাকে আরও বহুগুনে বাড়িয়ে দেয়। এ যেন আগুনে কেরসিন তেল ঢালার মত অবস্থা। এসিডিটির পরিমাণ এতটা বেশি হতে পারে মনে হবে গ্যাসের ওষুধ শুরু করার পুর্বে গ্যাসের যে সমস্যা ছিল এটা তার চেয়েও বেশি। ফলে গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ বন্ধ করার পরিকল্পনা থেকে আপনি নিজ থেকেই বেরিয়ে আসবেন, আবার নতুন উদ্দমে গ্যাসের ওষুধ খাওয়া শুরু করবেন, ভাববেন এটা আমার পক্ষে বন্ধ করা সম্ভব নয়।
তাহলে কিভাবে গ্যাসের ওষুধ বন্ধ করবেন?
----------------------------------
গ্যাসের ওষুধ বিশ্বে সবচেয়ে বেশি প্রেসক্রাইব করা ওষুধের মধ্যে একটি। একটি জরিপে দেখা যায় যাদের গ্যাসের ওষুধ লিখা হয় তার মধ্যে শতকরা ৩০-৭০ ভাগ মানুষের ক্ষেত্রে তা খাওয়ার যথার্থ মেডিকেল কারন নাই। বন্ধ করলে কিছু সমস্যা হয় তাই বছরের পর বছর খেয়ে যাচ্ছেন সবাই। যারা বছরের পর বছর গ্যাসের ওষুধ খাচ্ছেন তাদের এই ওষুধ বন্ধ করতে কিছুটা সময় লাগতে পারে।
গ্যাসের ওষুধ বন্ধ করার জন্য কোন Gold Standard প্রটোকল নাই যেটা অনুসরণ করে এটা বন্ধ করা যায়। কতটা সফল ভাবে এই ওষুধ বন্ধ করতে পারবেন তা নির্ভর করে মূলত রোগী কতটা স্বাস্থ্যকর জীবন যাপন পদ্ধতি মেনে চলতে পারে, এসিডিটি হয় এমন রিস্ক ফ্যাক্টরগুলো থেকে কতটা নিজেকে মুক্ত রাখতে পারে,এসিড তৈরী হয় এমন দীর্ঘ মেয়াদী চিকিৎসা যোগ্য কারন আছে কিনা এই বিষয়গুলোর উপর।
গ্যাসের ওষুধ বন্ধ করার ধারাবাহিক পদক্ষেপঃ
--------------------------------------
প্রথমে জেনে নিন গ্যাসের ওষুধ দীর্ঘ মেয়াদী খেতে হবে এমন কোন রোগ আপনার মাঝে আছে কিনা? যদি থাকে তাহলে গ্যাসের ওষুধ বন্ধ না করে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী গ্যাসের ওষুধ খেতে থাকুন।কিন্তু যদি দেখেন দীর্ঘ মেয়াদী গ্যাসের ওষুধ খাওয়ার মত কোন কারন আপনার মাঝে নেই তার পরেও আপনি খাচ্ছেন বা চিকিৎসক আপনাকে ১ মাসের জন্য দিয়েছিলেন কিন্তু আপনি মাস – বছর পার হয়েছে কিন্তু এখন খেয়ে যাচ্ছেন তাহলে আপনি গ্যাসের ওষুধ বন্ধ করার জন্য নিচের ধাপগুলো অনুসরণ করতে পারেনঃ
১। এসিডিটির কিছু রিস্ক ফ্যাক্টর থাকে- প্রত্যেকটা রিস্ক ফ্যাক্টর পরিহার করে চলুন। (পেপটিক আলসার/ গ্যাস্ট্রিক আলসার এর রিস্ক ফ্যাক্টর গুগলে সার্স দিলেই পাবেন, জেনে নিন কোন নির্ভরযোগ্য সুত্র থেকে)
২। গ্যাসের ওষুধ এর পরিমাণ/ ডোজ ধীরে ধীরে কমাতে থাকুন- যেমন, ৪০ মিলিগ্রাম ২ বেলা খেলে, ২০ মিলিগ্রাম ২ বেলা খেতে পারেন। ২০ মিলিগ্রাম ২ বেলা খেলে একদিন ২ বেলা পরের দিন ১ বেলা খান, পরে আস্তে আস্তে ১ বেলা করে প্রতিদিন খেতে পারেন, পর্যায়ক্রমে ১ দিন পর পর/ ২ দিন পর পর ১টি করে খেতে পারেন। এভাবে একসময় সপ্তাহে ১-২ বার ২০ মিলিগ্রাম করে খেতে পারেন। এভাবে চলতে থাকলে এমন সময় আসবে যখন ১টি ২০ মিলিগ্রাম ওষুধ শুধুমাত্র অতিপ্রয়োজনে মাসে ১-২ গ্রহণ করলেই হবে। এভাবে সাধারনত ১ মাস বা ক্ষেত্রবিশেষে সর্বোচ্চ ৩ মাস পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। আসলে বলা যতটা সহজ বাস্তবতা অনেকের ক্ষেত্রে ততটা সহজ নাও হতে পারে।
এভাবে ওষুধের মাত্রা কমালে আপনি যে সমস্যার সম্মুখীন হবেন এবং তা প্রতিরোধের উপায়ঃ
-----------------------------------------------
গ্যাসের ওষুধ হঠাৎ করে বন্ধ করলে বা ডোজ কমালে প্রথম কয়েক সপ্তাহ অতি গুরুত্বপুর্ণ কারন এই সময়ে আপনার এসিডি বা গ্যাসের মাত্রা অনেকগুন বেড়ে যেতে পারে। গবেষণায় দেখা যায় রক্তের গ্যাস্ট্রিন হরমোনের মাত্রা প্রথমদিকে বেশি থাকলেও গ্যাসের ওষুধ বন্ধ করার ১ মাসের মধ্যেই স্বাভাবিক লেভেল/ মাত্রায় চলে আসে। গ্যাসের ওষুধের ডোজ কমানোর সময় যদি গ্যাসের মাত্রা বেড়ে যায় তাহলে পিপিআই গ্রুপ বাদে গ্যাসের জন্য ব্যবহৃত অন্যান্য ওষুধ যেমন এন্টাসিড, এইচ-২ ব্লকার (ফেমোটিডিন) অতি প্রয়োজনে মাঝে মাঝে খেতে পারেন। আস্তে আস্তে ৪-৬ সপ্তাহের মধ্যে এই সবগুলো ওষুধ বন্ধ করতে পারবেন। এভাবে চেষ্টা করলে আশা করা যায় দীর্ঘমেয়াদী গ্যাসের ওষুধ খাওয়ার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে পারবেন।
নোটঃ
-----
১। এখানে গ্যাস ও এসিডিটি কাছাকাছি শব্দ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে মানুষের কাছে গ্যাস শব্দটা বেশি পরিচিত হওয়ার জন্য, যদিও শব্দ দুটির অর্থ চিকিৎসা বিজ্ঞানে আলাদা।
২। যাদের এসিডিটি হওয়ার দীর্ঘমেয়াদী কারন আছে বা চিকিৎসার প্রয়োজনে এই ওষুধ খেতে হয় তারা চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া গ্যাসের ওষুধ বন্ধ করবেন না।
৩। যারা যথাযথ মেডিকেল কারন ছাড়া গ্যাসের ওষুধ খাচ্ছেন এই লিখা মূলত তাদের জন্য।
৪। গ্যাসের ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া মূলত- প্রোটোন পাম্প ইনহিবিটর (omeprazole, esomeprazole, pantoprazole, lansoprazole, rabeprazole, etc) জাতীয় গ্যাসের ওষুধে বেশি হয়।
লেখকঃ ডাঃ মোঃ রাকিবুল হাসান, এমডি ( এন্ডোক্রাইনোলজি