মানুষ বদলায়
একটু একটু করে বেড়ে উঠতে দেখেছি ছেলেটাকে,
বাগানের এককোণে কাঠগোলাপ গাছটির বেড়ে ওঠার মতো করে।
যে বছর ছেলেটা এলো ওর মায়ের কোল জুড়ে,
সে বছরই কাঠগোলাপের ছোট্ট চারাটা পুঁতে দেয়া হলো বাগানের এককোণে।
একটা গাছ, একটা মানবশিশু,
একসাথে বাড়তে থাকে, একসাথে বিস্তৃত হয় তাদের আধিপত্য।
ছেলেটার সবে ডানা মেলবার সময়,
মায়ের আঁচল ছায়ায়, বাবার আদোরে, মায়ায়,
আত্মীয়-পরিজনের সমস্ত শুভাশিষ নিয়ে,
সে তখন প্রজাতির হবার পথে।
কাঠগোলাপের চারাটিও তখন বেশ পরিপুষ্ট,
নরম রোদের ছোঁয়ায় একটা দুটো করে অসংখ্য কচিপাতা মেলে দিয়েছে।
সেও বোধ করি প্রজাপতি হবার পথে।
একটা গাছ, একটা মানবশিশু,
একসাথে বাড়তে থাকে, একসাথে বিস্তৃত হয় তাদের আধিপত্য।
ছেলেটার জীবনে উঁকি দিচ্ছে একজন, দুজন করে একঝাঁক বন্ধু।
তাদের নানান অভ্যাস,
কিছু ভালো, কিছু আবার ভারি মন্দ,
ছেলেটা প্রভাবিত হতে থাকে।
খুলে যেতে থাকে মায়ের আঁচলের বাঁধন,
বাবাকে দেখলেই লুকানোর পায়তারা,
আত্মীয়-পরিজন তার টিকিটিও দেখতে পায় না,
সে ক্রমশ জড়িয়ে যায় কিছু মন্দ স্বভাবের জালে।
কাঠগোলাপ তখনও ঠাঁই দাঁড়িয়ে,
তার চারপাশে বেশকিছু আগাছার ঝোপ গজিয়ে গেছে,
কাঠগোলাপ তবুও মাথা উঁচু করে আছে।
আগাছার ঝোপ তাকে পরাস্ত করতে পারেনি।
একটা গাছ, একটা মানবশিশু,
একসাথে বাড়তে থাকে, একসাথে বিস্তৃত হয় তাদের আধিপত্য।
ছেলেটা এখন টগবগে এক নওজোয়ান,
বাইক হাঁকিয়ে, শীষ বাজিয়ে চষে বেড়ায় গোটা তল্লাট।
তাকে দেখলে হাসিখুশি মেয়েগুলো সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে, বয়সীরা নাক কুঁচকায়,
তাকে দেখলে মা অস্থির হয়ে যায়, কান্না চাপতে আঁচলে মুখ লুকায়,
বাবা হয়ে যায় গম্ভীর যেন পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়া উল্কাপিণ্ড,
ছেলেটাকে দেখলেই আত্মীয়-পরিজন উল্টো পথে হাঁটে, পাছে পরিচয় প্রকাশ পায়।
তার সঙ্গী এখন কিছু উদভ্রান্ত, ছন্নছাড়া, বাউণ্ডুলে ছেলে।
ছেলেটা প্রজাপতি ছিলো,
কিছু সঙ্গ, কিছু অভ্যাস তাকে করে দিয়েছে বিষাক্ত সিসি মাছি।
কাঠগোলাপের গাছটাও এখন টগবগে নওজোয়ান,
ডালগুলো হালকা হলুদ আর সাদার মিশেলে কুসুমিত হয়ে আছে,
বহুদূর থেকে দেখা যায় সবুজ পাতার ফাঁকে রাশি রাশি তারা যেন হাসছে,
গাছটা ভীষণ উল্লাসে যেন ঊর্ধমুখী,
বাতাসের সাথে কি যে আহ্লাদী বোঝাপড়া,
সারাক্ষণ সৌরভ ছড়িয়ে চলেছে চঞ্চল বাতাসের গায়ে।
ছেলেবেলার আগাছার ঝোপ —
এখনো পড়ে আছে পায়ের নীচে।
একটা গাছ, একটা মানবশিশু,
একসাথে বাড়তে থাকে, একসাথে বিস্তৃত হয় তাদের আধিপত্য।
অথচ আজ কতো বৈপরীত্য!
মনে হয় যেন কখনোই তাদের মাঝে কোনো সাদৃশ্য ছিলো না।
গাছগুলো আপন স্বভাবেই বেড়ে ওঠে,
শুধু মানুষের স্বভাবটা বদলায়।
শেখ ফাহমিদা নাজনীন
৩১ ডিসেম্বর ২০২১।