আনোয়ারুল কাইয়ূম কাজল :
বিন্দু বিন্দু জলকনায় প্রবাহিত হয় মহাসিন্ধু। কনা কনা বালুয় গড়ে ওঠে দেশ-মহাদেশ। তেমনি প্রতিদিনের অল্প অল্প সঞ্চয়ে একসময় পরিণত হয় সম্পদের পাহাড়-পর্বত। পরিবার বা সমাজের সদস্যবৃন্দের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র টিলা-পাহাড়সম সঞ্চয় একত্রে সৃষ্টি করে বৃহৎ পর্বতমালা। দ্রæত বদলাচ্ছে সব কিছু, বদলাচ্ছে আমাদের রীতি-নীতি-প্রথা তথা সমাজব্যবস্থা। বিবর্তনের এ ধারাবাহিকতায় যুগে যুগে জন্মেছে নানাবিধ সামাজিক নিয়ম-প্রথা প্রতিষ্ঠান। সমাজ ব্যবস্থার বিবর্তনের সাথে সাথে বিবর্তন ঘটেছে সঞ্চয়ের ভঙ্গিমায়। আবহমান বাংলার ঐতিহ্যবাহী বাঙালি সামাজিক ও পারিবারিক জীবন ছিল বিভিন্ন নিয়ম,রীতি-নীতি,প্রথা,আচার,কৃষ্টি-কালচার ও নানা বৈচিত্রে ভরপুর। সেরকম এক বৈচিত্রময় বিশেষ প্রথা বা মহিমান্বিত উদ্যোগের নাম মুষ্টি চাল প্রথা।
বিশেষত গৃহিণীরা কোন মহৎ কাজের উদ্দেশ্য ভাত রান্নার চাল থেকে প্রতিদিন এক মুষ্টি বা একাদিক মুষ্টিচাল নিদিষ্ট পাত্রে জমা করতেন, সে জমাকৃত চালকে মুষ্টি চাল বলা হয়। তারা সাধারণত সেটা দিয়ে সপ্তাহের বিশেষ দিনে বাড়িতে আসা ভিক্ষুক অথবা গরিব দুঃখী মানুষের সাহায্য করা,পাড়া-মহল্লার মক্তব,স্কুুল,পাঠাগার,ক্লাব ইত্যাদি তৈরী, অভাবী-মেধাবীদের পড়াশোনার খরচ, খেলাধুলার সামগ্রী ক্রয়সহ সমাজের অন্যান্য মহৎ কাজের উদ্দেশ্য ব্যয় করতেন। সেই সঞ্চিত মুষ্টির চালের ছিল এক জাদুকরী ক্ষমতা। ’দশে মিলে করি কাজ হারি যেতে নাহি লাজ’ অথবা একজনের জন্য যা কষ্টকর দশ জনের জন্য তা সহজসাধ্য এমন সমবায়ী একতা মন্ত্রে দীক্ষিত বাণীর বাস্তব প্রতিফলনের নাম মুষ্টিচাল।
মুষ্টিচাল সমাজে পারস্পারিক সহযোগিতা,সহমর্মিতা-ভার্তৃত্ববোধ বৃদ্ধিতে সহায়ক ভ‚মিকাসহ মানবতার কল্যাণ ও সমাজ উন্নয়নে উজ্জ¦ল দৃষ্টান্ত সৃষ্টিতে যুগান্তকারী অবদান রাখতো। চিরায়ত বাংলা থেকে হারিয়ে যাওয়া বাঙলীর ঐতিহ্যবাহী এ প্রথা পাল্টে দিতো সমাজের চিত্র।
মুষ্টিচাল প্রথা ও প্রবর্তনের ইতিহাস
কিছুদিন আগেও দৈনিক ধান-চাল,গম,যব,ভুট্টা,ডাল অন্যান্য শস্য সঞ্চয়ের একটি প্রচলন ছিল । বাঙলী কৃষক পরিবারে তো বটেই মধ্যবৃত্ত নি¤œমধ্যবৃত্ত প্রায় সব পরিবারেই। স্থানীয় ভাবে এই সঞ্চয় ব্যবস্থার নাম ‘মুষ্টিচাল’ বলে অভিহিত করা হতো। সংসারে প্রতিদিনে গৃহিনীরা রান্নার জন্য বরাদ্দকৃত চাল থেকে এক মুঠো পরিমাণ চাল সরিয়ে সঞ্চয় হিসেবে আলাদা করে নির্দিষ্ট পাত্রে রাখতেন। যেকোন আকস্মিক প্রয়োজনে সঞ্চিত সেই চাল বা শস্য বিক্রি বা বিনিময়ের মাধ্যমে পরিস্থিতির সার্বিক চাপ কিছুটা হলেও কমানো চেষ্টা করতেন, কিংবা গৃহিণীরা কোন দান-দক্ষিণা অনুরূপ ভাবে ছাত্র ছাত্রীরাও পাড়া-মহল্লা বা স্কুল,কলেজ,বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক সামাজিক, সাহিত্য-সাংস্কৃতিক কিংবা দাতব্য সংগঠন-সংস্থার মাধ্যমে জনহিতকর কাজে ভূমিকা রাখার জন্য ও নিজবাড়ি,লজিংবাড়ি,ছাত্রাবাস ও হলগুলোতে মুষ্টির চাল সংগ্রহ করতেন। মুষ্টির চাল সংগ্রহ করে জনকল্যাণকর কাজ করে তারা পরম আনন্দ ও সুখানুভব করতেন। এটি মহৎপ্রাণ সহজ-সরল বাঙালি ঐতিহ্যের পরমপরা স্মারক। উপমহাদেশে সর্বপ্রথম মুষ্টিচাল প্রথা প্রবর্তনের ইতিহাস নির্দিষ্ট করে বলা মুশকিল, তবে, ইংরেজদের বিরুদ্ধে স্বদেশী আন্দোলনকারীদের সহায়তা করার জন্য অভিভক্ত ভারতবর্ষে গৃহিণীদের মাঝে মুষ্টিচাল সংরক্ষণের প্রচলন বেশ জনপ্রিয় হয়। পরে এটি সমাজের বিভিন্ন জনহিতকর কাজ-কর্ম সম্পাদনের জন্য ব্যবহৃত হয়।
হারিয়ে যাচ্ছে মুষ্টিচাল প্রথা
ব্যাংকে সঞ্চয় হিসাব খুলে, ইনস্যুরেন্স করিয়ে আর ঘরে মাটির ব্যাংকে মুদ্রা সঞ্চয় করার পর খাদ্যশস্য সঞ্চয়ের প্রয়োজন বা ফুসরৎ, কোনটাই হয়ে ওঠে না আমাদের। এমনকি এক মুঠ চালের জন্য গান গাওয়া ভিক্ষুকদের কাছেও খুঁজে পাওয়া যায় না । তাছাড়াও বর্তমান বাজার দরে, প্রায় মূল্যহীন ধানজাত শস্য হারিয়েছে সঞ্চিত হবার যোগ্যতা। মুষ্টিচাল প্রথা বিলুপ্ত প্রায় বললেই চলে। মুষ্টিচাল এখন শুধুই এক গল্প। একটা সময় ছিল, মাতৃভাষা দিবস, বিজয় দিবস, স্বাধীনতা, দিবস, শবেবরাত,শবেক্বদর,আশুরা,শীত মৌসুমে ধানকাটা শেষে বাড়ির আঙিনা বা ধান কেটে ন্ওেয়ার পর খালি ক্ষেতে এলাকার ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা টোপাপাতি-চড়–ইভাঁতি ও বনভোজনের জন্য ঘরে ঘরে গিয়ে চাল, ডাল, নুন ও তেল সংগ্রহ করে টাপাপাতি-চড়–ইভাঁতি,বনভোজন আযোজনে ক্ষীর, খিচুড়ি ইত্যাদি রান্না করতো। সে প্রচলনও এখন খুব একটা দেখা যায় না।
জনহিতকর কাজে মুষ্টিচাল
সেসময় মুষ্টিচাল সংগ্রহের মাধ্যমে সমাজের নানাবিধ সমস্যা নিরসন করা হতো। নারীদের মুষ্টিচালের অর্থে ও পুরুষদের বিনামূল্য শ্রমে গড়ে তুলতো রাস্তা-ঘাট, কাঠ-বাশেঁর সাঁকো। প্রান্তিক জনগোষ্ঠির নানাবিদ সমস্যা, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর অভাব-অনটন দূর্দিনের মোকাবিলা হতো মুষ্টিচাল দিয়ে।
কোথাও কোথাও সমবায় ভিত্তিতে মহিলারা মুষ্টি চাল সংগ্রহের জন্য তৈরি করতো মুষ্টি চাল সমিতি যার মাধ্যমে মুষ্টির চাল জমা করে তা বিক্রি করে বিক্রিত অর্থ দিয়ে আপদ-বিপদের বিপক্ষে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার সাহস জোগাত তাদের। অনুরুপ ভাবে শিক্ষার্থীরাও এক মুষ্টি চাল দিয়ে বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা তথা বিভিন্ন ছোট-খাটো জনকল্যাণমূলক কাজের ঊদ্যোগ গ্রহন করতো।
সহমর্মিতা ও ভার্তৃত্ববোধ বৃদ্ধি
বাংলাদেশের গ্রামে এখনো কোথাও কোথাও মুষ্টিচাল সংগ্রহ পরিলক্ষিত হয়ে থাকে, তবে তা নিতান্ত উপলক্ষ-কেন্দ্রিক এবং অনিয়মিত। দুস্থ কোন পরিবারের কেউ আকস্মিক মৃত্যুর শিকার হলে গ্রামবাসী তৎক্ষণাৎ মুষ্টিচাল সংগ্রহ করে তার সৎকারের ব্যবস্থা নেয়। এই ব্যবস্থা ‘একের বোঝা’ কে ‘দশের লাঠি’তে রুপান্তর করে। এছাড়াও বিশেষ ধর্মীয় দিনগুলোতে মসজিদের নানান আয়োজনে প্রতি ঘর থেকে মুষ্টিচাল সংগ্রহ করে মসজিদ কর্তৃপক্ষকে দেয়া হয়। সমাজের সকলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে সহমর্মিতা ও ভার্তৃত্ববোধ বৃদ্ধির এক অভিনব পন্থা মুষ্টিচাল প্রথা।
পাল্টে দিতে পারে সমাজের চিত্র
একসময় প্রতিটি বাড়িতে থাকত বিশেষ একটি ঘটি। রান্নার সময় দৈনন্দিন চাহিদার অংশ থেকে তাতে এক বা দুই মুষ্টি চাল রাখা হতো। গৃহিণীরা পছন্দমতো ঘটি বা পাত্রে মুষ্টির চাল জমা করতেন। সংগৃহীত এসব চাল একসঙ্গে বিক্রি করে বিক্রয়লব্ধ অর্থে সংসারের দু:খ ও দুদশা ঘোচানোর জন্য সামাজিক বিভিন্ন কাজে ব্যবহার হতো। এতে একদিকে যেমন দুর্দিন দূও হতো তাদের মধ্যে সঞ্চয়ী মনোভাব গড়ে উঠতো। অন্যদিকে সামাজিক বন্ধন আরও দৃঢ় হতো। কোথাও কোথাও সংগৃহীত মুষ্টির চালে গড়ে উঠতো মুষ্টির চাল সংগ্রহ সমিতি। সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বও পালন করতো এই মুষ্টির চাল সমিতি। গ্রামের কেউ মারা গেলে, ছেলে-মেয়ের বিবাহে, পরীক্ষার ফরম ফিলাপে ও খাতা কলম ক্রয় করে দিতেন চাল সমিতির সদস্যরা। যার মাধ্যমে উপকৃত হতো সমিতির সদস্যসহ-গ্রামবাসী। এভাবে এক মুঠো চালে পাল্টে দিতে পারে সমাজের চিত্র।
আমাদের দাদী-নানীরা এবং তাঁর পূর্বসূরী গৃহিনীরা ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা প্রতিদিন স্বতঃপ্রণোদিতভাবে বংশ পরম্পরায় তিনবেলা ভাত রান্নার জন্য হাঁড়িতে চাল ভেজানোর আগে সেখান থেকে মাটির পাতিলে এক মুষ্টি চাল জমিয়ে রেখে সংসার পরিবার-পরিজনের অভাব-অনটনে কাজে লাগাতেন ।
অন্যদিকে সম্মিলিতভাবে মুষ্টির চাল সংগ্রহের মাধ্যমে এলাকায় উন্নয়ন, মানবিক-জনহিতকর কর্মকান্ড,কবরস্থান, মসজিদ, মাদ্রাসা, স্কুল, কলেজ তৈরি ও উন্নয়নের মতো যুগান্তকারী অনুকরণীয় কাজ পরিচালনা করতেন। এটি ছিলো আবহমান বাংলার বাঙলী সমাজ জীবনে প্রাত্যহিক চালচিত্র। শত-শত বছরের চর্চিত ঐতিহ্যবাহী এ প্রথা বা রীতি আজ হারিয়ে যাচ্ছে অতলান্তের গহীনে; রেখে যাচ্ছে স্মৃতির মিনার। যাদুকরী শক্তিধর বিলুপ্ত প্রায় 'মুষ্টিচাল’ প্রথা নতুন ভাবে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরে প্রসার ঘটাতে পারলে পরিবার সমাজ দেশের উন্নয়নে রাখা যেতে জনকল্যাণমূলক ভূমিকা ।
লেখক : কবি, গবেষক ও গণমাধ্যমকর্মী।