দুঃখবিলাসী
বাতিকগ্রস্ত প্রাচীন বৃদ্ধের মতো খনখনে মেজাজ নিয়ে,
পুরোনোকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে ভালোবাসি।
ভরা চাঁদের আলোয় গা ডুবিয়ে বসে,
পেছনে ফেলে আসা সরু কাস্তের মতো একফালি চাঁদের জন্য
ভারি মাতম হয় মনের গোপনে।
ঝকঝকে জোৎস্নায় যখন উঠোন ধুয়ে যায়,
আমাদের পোড়া চোখ অমাবস্যার জন্য কাঁদে।
তবে কি আমরা নতুন নই?
না কি মসৃণ চামড়ার খোলসের ভেতর এক প্রাচীন বৃদ্ধের বাস?
আমরা পেছনের দিনগুলো নিয়ে বড্ড আফসোসে ভুগি।
আমাদের সুখের সময়গুলোর মাঝে যখনই কোনো বেদনার ছায়া পড়ে,
আমরা স্মৃতিকাতর হয়ে যাই।
টেবিল ভর্তি অজস্র সুখাদ্যের ম-ম গন্ধে
পথশিশুগুলি যখন চঞ্চল হয়ে ওঠে,
তখনও আমরা বিষন্নতায় ভুগি।
মাটির উনুনে রাঁধা মায়ের হাতের সাদা ভাতের ধোঁয়া,
আমাদের চিরকাল আচ্ছন্ন করে রাখে।
টেবিল ভর্তি সুখাদ্যগুলি বড়ো অবহেলায় গলধকরন করি।
হয়তো দেয়ালের ওপারে ফুটপাতে বসে আছে,
যে কাদামাখা শিশুটি তার সাথে ভাগ করে নিলে তৃপ্তিটা ফিরতো।
হয়তো তার ছোট্ট পেটটা ভরে গেলে,
মুখের ওপর যে আনন্দটুকু ঝিলমিলিয়ে উঠতো,
তখনই আমরা পেয়ে যেতাম মায়ের হাতের স্বাদ।
কিন্তু আমরা কখনোই এই চেষ্টাটা করিনি,
পরীক্ষামূলকভাবেও না।
আমরা বরং প্রতিদিন বিষন্ন হয়ে পড়েছি।
ঈদে-পার্বণে আমাদের আলমারিতে পোশাকের স্তুপ পড়ে যায়,
হয়তো তার কিছু কখনো ছোঁয়ায় হয়না।
পোশাক নিয়ে আদিখ্যেতার বয়সটাও তখন থাকেনা।
তবু গঞ্জের হাট থেকে আব্বার এনে দেয়া সস্তা দামের লীলেনের জামাটার জন্য এখনো মন কেমন করে।
দেয়ালের ওপারে ফুটপাতে যে শিশুটি খালি গায়ে বসে আছে,
আমাদের আলমারির স্তুপ থেকে দু'চারটে পোশাক যদি তার সাথে
বা তার মতো আরও কিছু খালি গায়ের সাথে একবার ভাগ করে নেয়া যেতো,
নতুন পোশাকে খালি গা'টা যখন ঝলমলিয়ে উঠতো,
তখনই আমরা পেয়ে যেতাম সস্তা দামের লীলেনের জামার মিষ্টি সুঘ্রাণ।
আমরা অতীত খুঁজতে গিয়ে অতীত থেকে ছিন্ন হয়েছি অনেক আগেই,
আমরা সুখ খুঁজতে গিয়ে দুঃখের আবর্তে জড়িয়ে গেছি অনেক আগেই।
তাই অতীতের আনন্দটুকু চিরকালের মতো হারিয়ে যাবার আগে,
আর একবার সুখ অন্বেষী উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে অতীতের মাধুর্যময় সরলতা দিয়ে ভরিয়ে তুলতে পারি।
আমাদের খনখনে মেজাজের বৃদ্ধ মনটাকে উদ্দীপ্ত করতে পারি তারুণ্যে ভরা সতেজতায়।
শেখ ফাহমিদা নাজনীন
৩০ ডিসেম্বর ২০২১।