বুধবার, জানুয়ারী ১২, ২০২২
খোলসটা ছেড়ে। শেখ ফাহমিদা নাজনীন
ইদানিং মেয়েটা আমার স্বপ্নের ভেতর হানা দেয়,
গ্রীবা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে, প্রখর সূর্যের মুখোমুখি,
নাকফুল খুলে নেয়া নাকের ছিদ্রে লেগে সূর্যের তেজ্ব ঝলমল করে,
তার নিরাভরণ শরীরখানা বেতের চাবুক হয়ে যায়,
তেলহীন রুক্ষ চুলের গোছা,
মনে হয় একঝাঁক ফণা তোলা সাপ,
কাফনের মতো ঝকঝকে কাপড়খানা তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধতে থাকে,
টেনে নিয়ে যেতে চায় কবরের সূচিভেদ্য অন্ধকারে।
অথচ আমি দেখি একটা সারস যেন ডানা মেলে দিতে চায় অসীম আকাশে।
মেয়েটা হঠাৎ করে সারস হয়ে যায়
আর আমি তার ডানায় চেপে তারই সাথে উড়তে থাকি।
সারস কন্যা ছুটে চলে সূর্যের দিকে।
সূর্যের প্রবল তেজ্ব সহ্য করা সংসারী মানুষের কর্ম নয়,
তাই আমি ঝলসে যেতে থাকি, গলে যেতে থাকি,
তীব্র তেষ্টা নিয়ে ঘুম ভেঙে যায়।
ইদানিং প্রায়ই আমি স্বপ্নটা দেখি।
মেয়েটিকে আমি খুব ভালো করে চিনতাম,
মাত্র ক'টা বছর হলো স্বামীকে হারিয়েছে,
একটা অল্প বয়সী বিধবার বেঁচে থাকার যুদ্ধটা ছিলো যন্ত্রণাদায়ক।
সবাই যখন তাকে অকাল বিধবার তকমা লাগিয়ে দিলো,
তাকে ঠেলে দিলো পরাশ্রয়ী জীবনে,
সে তখন দাঁড়িয়ে ছিলো খাদের কিনারায়
সংসারী সমাজের মস্ত বোঝা হয়ে।
ঠিক তখনই সে ঘুরে দাঁড়ালো আত্মসম্মানের তীব্র অভিমানে,
হয়তো একটা সেলাই কল সম্বল করে।
মেয়েটিকে আমি প্রায়ই দেখতাম দ্রুত পায়ে বাজারের দিকে যেতে,
মনে হতো একটা ত্রস্ত হরিণী।
একটু পরেই ফিরে আসতো নতুন কাপড়ের বোঁচকা নিয়ে,
বোঝাই কাপড়ের ভারে কুঁজো হয়ে চলতো,
তবু তার চলায় ছিলো হরিণীর গতি।
কখনো তাকে সিংহী ভেবে ভুল করে বসতাম,
পাড়ার উটকো কেউ অহেতুক কটুক্তি করলেই গর্জে উঠতো,
যেন এক্ষুনি আঁচড়ে ফালাফালা করে দেবে ঢোঁড়াসাপগুলোকে।
অমিশুক মেয়েটি ছিলো সবার ধরা ছোঁয়ার বাইরে,
কারও সাতেপাঁচে নাক গলাতে দেখিনি কখনো।
সবাই বলতো, বেটি নির্বোধ!
আর আমার কাছে মনে হতো, ঘুমিয়ে থাকা এক ভিসুভিয়াস,
তার বোধের লাভার স্রোত সারাক্ষণ টগবগ করে ফুটছে।
আমি খুব সমীহ করতাম তাকে,
আমার এ অনুভূতি সেও বোধ হয় জানতো,
তাই আমার সাথে দেখা হলেই ম্লান হাসির রেখা ফুটে উঠতে দেখতাম তার মুখে।
মাঝে অনেক বছর কেটে গেছে,
সে শহর ছেড়ে এসেছি বহুদিন,
মেয়েটিও স্মৃতি থেকে লুপ্তপ্রায়,
হঠাৎই স্বপ্নগুলো স্মৃতির গহ্বরে যেন ধাক্কা দিয়ে গেলো।
আমি সেই মেয়েটিকে চিনতাম,
সে সূর্যের চেয়েও বেশি তেজস্বী ছিলো।
সবাই যখন ভেবে নিলো তার জীবনটা থেমে গেছে,
সে তখন বিধবার খোলস ছেড়ে বের হলো,
আর মানুষ হয়ে উঠলো।
সময় জার্নাল/আরইউ