সোপান। শেখ ফাহমিদা নাজনীন
কতো সুনিপুণ কৌশলে গড়ে ওঠে ঘরগুলো,
সবুজ পেঁপের পাতা ভেদ করে, লম্বাটে নারকেল গাছের নীচে,
ধুসর কাদামাটির ঠাঁসা বুননে গাঁথা হয়,
গৃহী আর গৃহিণীর কাদা মাখামাখি হাতে।
খেজুর পাতার বিনুনি বাঁধা মাদুরে ক'টা মুড়ি-খই ছড়ানো থাকে,
ছোট্ট শিশুটা ব্যাস্ত থাকে সেখানে,
কখনো খানিকটা কাঁদে, কখনো আত্মভোলা, খেলায় মগ্ন।
চড়া রোদে মাটি ফাঁটা উত্তাপ,
তবু তারা ঘর বাঁধে।
ভোরবেলা দুটো ভাত নাকে মুখে গুঁজে,
দুজন মানুষ দেয়াল গাঁথতে থাকে,
খড়ের ছাউনি দিলে হয়ে যায় মাথা গোঁজার ঠাঁই।
ঘরগুলো কখনো হয় পোড়ামাটির,
ধোঁয়ার গন্ধ লেগে থাকে তার দেয়ালে দেয়ালে।
কেউ হয়তো শখ করে একটা রঙিন পোস্টার সেঁটে দেয় দরজার পাশে।
পশ্চিম দেয়ালের কুলুঙ্গিতে সযত্নে ভাঁজ করা থাকে জায়নামাজ,
একপাশে কাঠের তাক, থরে থরে সাজানো জ্ঞানের বার্তা,
পাক কুরআনের পাশে, নবীজীর বাণী।
ঘরের বাসিন্দারা সম্ভ্রমে সে দেয়াল ছোঁয়,
পশ্চিম দেয়ালটা সে ঘরের গহনার মতো।
ঘরদোর, বারান্দা ঝকমক করে,
নিকানো উঠোনের একপাশে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকে
টমেটো, পালংশাক, দু'চারটে বেলফুল, গাঁদা,
টিনের চালের পরে ঝাঁকে ঝাঁকে শিম আর লাউয়ের ডগা।
সে ঘরের ক্ষুদেগুলো রোজ ভোরে আমপারা পড়ে,
মেহমানদারিতে ভরে দেয় পানির গেলাস।
ব্যাস্ত শহর মাঝে মস্ত অট্টালিকা,
তারও কাছে ঘর বাঁধা আছে।
সে ঘরে নিয়নবাতি, আয়েশি নকল হাওয়া,
সেখানে জানালা থাকে কাঁচ দিয়ে ঢাকা,
বাইরের আলো-হাওয়া, পাখির তিড়িং নাচ, বনের জংলী ঘ্রাণ, ডুমুরেরফুল।
সেখানে সদাই শীত কিংবা বসন্ত,
যেমন চাইবে, ঘর তেমনই সাজে।
মস্ত সে ঘরগুলো আরোপিত রঙে মাখা,
তবু্ও সেখানে থাকে মানুষের বাস।
সে ঘরের বারান্দা আকাশের কাছাকাছি,
মাটির টবে ঝুলে থাকে বেগুনি অর্কিড আর পাতাবাহারের ঝাড়।
দলছুট সারস হয়তো তার পাশ দিয়ে উড়ে যায়,
চেনা চেনা আপনের মতো।
সে ঘরেও সুখ আসে, শান্তি সন্ধ্যা আসে,
কাজ শেষে ঘরবাসী ঘরটাতে এলে।
সে ঘরেও শিশু থাকে বাবা-মার পথ চেয়ে,
ঘরে ফিরলেই হয় সালাম সম্ভাষণ।
ঘর যেন ঘর নয়, মস্ত পাঠশালা,
এখানেই শেখা শুরু মনুষ্য রীতি,
এখানেই চলা শুরু মানুষ হবার পথে,
জান্নাতে পা রাখার প্রথম সোপান।
সময় জার্নাল/আরইউ