দুলাল বিশ্বাস, গোপালগঞ্জ প্রতিনিধি: বিকেল থেকেই মিষ্টির দোকানে লেগে থাকে ভিড়। কেউ বসে, কেউ দাঁড়িয়ে খাচ্ছেন, আবার কেউ কিনে নিচ্ছেন পরিবারের জন্য। তবে যারা খাচ্ছেন বা নিচ্ছেন, তারা ছোট মিষ্টি নয়, কিনছেন বড়টা। একেকটি মিষ্টির ওজন ১ থেকে ১০ কেজি পর্যন্ত। এলাকায় এটি বালিশ মিষ্টি হিসেবে পরিচিত। তৈরি করা দেখতে প্রতিনিয়ত ভিড় করছেন নানা বয়সের মানুষ।
এতক্ষণ বলছিলাম গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার ভেড়ার বাজার গ্রামের রনজিত কুমার সরকারের মিষ্টির কথা। যার তৈরি মিষ্টি এখন গোপালগঞ্জসহ আশপাশের জেলায় প্রসিদ্ধ। নেওয়া হয় বিদেশেও।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, গোপালগঞ্জ জেলা শহর থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থতি ঐতিহ্যবাহী ভেড়ার বাজার। ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য মধুমতি নদীর পাশে গড়ে ওঠা এ বাজারটি নদী বন্দর হিসেবেই পরিচিত। এখানে প্রায় ৮০ বছর আগে মিষ্টির দোকান নিয়ে বসেন রনজিত কুমার সরকারের বাবা উপেন্দ্রনাথ সরকার। তবে সে সময়ে তার তৈরি মিষ্টি এমন প্রসিদ্ধ ছিল না। এরপর উপেন্দ্রনাথ সরকার মারা গেলে তার ছেলে রনজিত কুমার সরকার মিষ্টির দোকানের দায়িত্ব নেন মাত্র ১৬ বছর বয়সে।
কারিগর রনজিত সরকার বলেন, আমার বালিশ মিষ্টির কথা চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে বাঁশ ও টিন দিয়ে দোকান ঘরটি ঠিক করি। মিষ্টির প্রধান উপাদান দুধ কিনে আনি জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে। পরে সেই দুধ দিয়ে ছানা তৈরি করি। ছানার সঙ্গে অন্যান্য উপকরণ দিয়ে এসব বালিশ মিষ্টি তৈরি করি। পরে সেটি রসে জ্বালিয়ে বিক্রির উপযোগী বানাই।
তিনি আরও বলেন, এ মিষ্টি তৈরিতে কোনো ধরনের ক্ষতিকারক উপাদান ব্যবহার করি না। ফলে মিষ্টির স্বাদ ও ঘ্রাণ থাকে অটুট। এক কেজি থেকে ৯ কেজি ওজনের মিস্টি কেজি প্রতি বিক্রি করি ৩০০ টাকা আর ১০ কেজি থেকে তার উপরের ওজনের মিষ্টি ৫০০ টাকা কেজি দরে বেচি। এই জেলা ছাড়া ঢাকা, খুলনা, বরিশাল, নড়াইল, বাগেরহাটসহ বিভিন্ন স্থানে থেকে এসে মিষ্টি কিনে নেন ক্রেতারা। এমনকি এই মিষ্টি ভারত, কুয়েতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নিয়ে যান এলাকাবাসী। তবে ১০ কেজি ওজনের মিষ্টি নিতে হলে আগে থেকেই অর্ডার করতে হয়।
এর আগে তিনি ১ মণ ওজনের মিষ্টি বানিয়েছেন। তবে প্রয়োজনীয় কড়াই ও চুলা না থাকায় তিনি এখন আর এত বেশি ওজনের মিষ্টি বানাচ্ছেন না।
মিষ্টি কিনতে আসা বেদগ্রাম এলাকার বাসিন্দা দুলাল মোল্যা বলেন, রনজিত সরকারের মিষ্টির কথা শুনে এখানে কিনতে এসেছি। ২ কেজি ওজনের দুটি মিষ্টি কিনে নিয়ে যাচ্ছি পারিবারের জন্য।
ঢাকা থেকে বেড়াতে আসা তাহেদুল ইসলাম বলেন, এখানে এসে রনজিত সরকারের মিষ্টির কথা শুনেছি। তাই তার দোকানে এসেছি। মিষ্টি খেয়ে দেখলাম অনেক সুস্বাদু। তাই পরিবারের জন্য কিনে ঢাকায় নিয়ে যাচ্ছি।
ক্রেতা ত্রিনাথ মজুমদার বলেন, আমার ভাই কুয়েত প্রবাসী। তার জন্য রনজিত সরকারের বালিশ মিষ্টি পাঠিয়েছিলাম। ভাই আবার তার বন্ধুর জন্য মিষ্টি পাঠাতে বলেছে। তাই এখানে এসে মিষ্টির অর্ডার দেওয়ার পাশাপশি পরিবারের জন্য কিনে নিলাম।
ভেড়ার বাজারের বাসিন্দা কাজী রহমান আলী বলেন, রনজিত সরকারের আগে তার বাবা উপেন্দ্রনাথ সরকার মিষ্টি তৈরি করতেন। এরপর রনজিত সরকার এ পেশায় যোগ দেন। তিনি প্রায় ৫০ বছর ধরে মিষ্টি বিক্রি করছেন। নির্ভেজাল ছানা দিয়ে মিষ্টি তৈরি করায় তার সুনান ছড়িয়ে পড়েছে। শুধু
জেলা নয়, বাইরের জেলা থেকে অনেকেই মিষ্টি কিনতে আসেন তার দোকানে।
মিষ্টি খেতে আসা শিশু আইরিন ফাতেমা ও তাফসিয়া ইসলাম মুন বলেন, এত বড় মিষ্টি আমি আগে দেখিনি। এবারই প্রথম দেখলাম আর খেলাম অনেক স্বাদ।
উলপুর ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত নারী সদস্য ফারজানা ইয়াছমিন বলেন, বাড়ির জন্য প্রায় এই দোকান থেকে মিষ্টি কিনে নিয়ে যাই। আজও এসেছি। এত বড় মিষ্টি আমি আগে কখনো দেখিনি। তবে খেতে অনেক সুস্বাদু।
হরিদাপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আজিজুর রহমান সরদার বলেন, রনজিত সরকারের বাবাও মিষ্টি তৈরি করতেন। তার কোনো সাহায্যকারী নেই। তিনি নিজেই মিষ্টি তৈরি করেন আর নিজেই বিক্রি করেন। তার মিষ্টি অনেক ভালো ও সুস্বাদু। মিষ্টির ধরনটা আমাদের কাছে খুই আশ্চর্যজনক। তিনি এক কেজি, দুই কেজি, ৫ কেজি ও ১০ কেজি ওজনের মিষ্টি তৈরি করেন। তিনি যে একজন দক্ষ কারিগর, এটি তার প্রকৃত উদাহরণ।
এমআই