মঙ্গলবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪

ডা. নুসরাত সুলতানা লীমার ছোটগল্প ‘আঁধার থেকে আলোয়’

মঙ্গলবার, ফেব্রুয়ারী ১, ২০২২
ডা. নুসরাত সুলতানা লীমার ছোটগল্প ‘আঁধার থেকে আলোয়’

সকালবেলা কলিংবেলের শব্দে 'এত সকালে আবার কে আসলো' ভাবতে ভাবতে ডোর হোল দিয়ে উঁকি দিতেই নবনীকে দেখলেন জাহানারা বেগম। ভীষন অবাক হলেন। কোন বিপদ হয়নিতো? কোন সমস্যা হলে ফোনই তো আছে। তবে আসলো কেন? তাও একা!
দরজা খুলতেই জিজ্ঞাসা করলেন,
- এত সকালে যে। বাসার সব ঠিক আছে তো?
- আরে, নিজের বাসায় আসতে গেলে আমার এপয়েন্টমেন্ট করে আসতে হয় নাকি? সৃজাকে স্কুলে দিয়ে ভাবলাম তোমাদের সাথে দেখা করে যাই।
- কতদিন আসিসনা। তোর চেহারা এমন মলিন কেনরে? চোখের নীচে কালি, রোগা হয়ে গেছিস। কোন অসুখ বিসুখ করেনিতো? দেরী না করে ডাক্তার দেখা মা। 
- না মা কিছুই হয়নি। মায়েদের কাছে সব সন্তানদের রোগা মনে হয়।
- চল চা খেতে খেতে গল্প করি। 
  মা নবনীর বাহুতে  হাত রাখতেই কঁকিয়ে উঠলো সে।
- কি হয়েছে মা? এমন চিৎকার করে উঠলি যে? ব্যাথা ট্যাথা পেয়েছিস নাকি? ছোটবেলা থেকেই  তোর আঘাত পাওয়ার  যথেষ্ট ইতিহাস আছে। একটু সাবধান হয়ে, দেখে শুনে চলিস। তা সৈকত কেমন আছে? তোর শাশুড়ি, শ্বশুর? তোর বাবা বলছিলেন উনাদের দেখতে যাবেন। অনেকদিন যাওয়া হয়না।
- ওরা সবাই ভালো আছে মা। 
- তোর কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে কেন? আজই তোকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো। 
- তুমি অযথা চিন্তা করোনা তো মা। 
ডাইনিং টেবিলে মা,মেয়ে চা খেতে খেতে অনেক গল্প করলেন। অতীতের কত শত স্মৃতিময় গল্প!
মা ও নবনী গেস্টরূমটায় গেলেন। এই রূমটা নবনীর খুব প্রিয়। এখানে গানের প্র‍্যাকটিস করতো, ছবি আঁকতো। এই ঘরেই তার আঁকা কত ছবি বাঁধানো আছে। কতগুলো বছর পার হয়ে গেছে, কিন্তু ছবিগুলো এখনো কি জীবন্ত!
- মা, আমি আর এই সংসার করতে চাইনা।
- কি বলিস, পাগল হয়েছিস নাকি? তোর শ্বশুরবাড়ির ফ্যামিলি কত ভালো, কত অভিজাত! এখন ফ্যামিলি খুবই বিরল। 
- আসলেই বিরল, মা, বলেই কামিজের পেছনটা উঁচু করে দেখালো মাকে।
মা আঁৎকে উঠলেন। 
- তোর গায়ে হাত তোলে সৈকত! 
মা কেঁদে উঠলেন, আমি ভাবতেই পারছিনা।
- মারের আঘাত, কথার আঘাত কিছুই বাদ নেই। এতদিন তোমাদের বলিনি তোমরা কষ্ট পাবে বলে। এখন আমার দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। মানুষ আর কত যন্ত্রনা সহ্য করতে পারে? রাস্তার কুকুরকেও মানুষ এত কষ্ট দেয়না মা। সৃজাও এখন কেমন যেনো হয়ে গেছে। একেবারে চুপচাপ। কোন উচ্ছলতা নেই, আবদার নেই। কোন গেস্ট আসলে সামনে যেতে চায়না। মাঝে মাঝে রাতে ঘুমের মাঝে ডুকরে কেঁদে ওঠে। ওর সাথে থাকলে আমার মেয়ে আস্বাভাবিক হয়ে যাবে। মাগো আমাকে বাঁচাও। 
জাহানারা বেগমের চোখে পানি অঝোর ধারায় ঝরছে। 
- আগে কেন বলিসনি? এতটা কষ্ট একা সহ্য করেছিস। মা তো বন্ধুর মত হয়রে। মাকে কিছু লুকোতে আছে?
জাহানারা বেগমের এক মেয়ে, এক ছেলে। বড় মেয়ে নবনী আর ছোট ছেলে আসিফ। ইডেন কলেজে বাংলায় অনার্স শেষ হতেই নবনীর  বিয়ে হয়ে যায়। আসলে এত ভালো পাত্র হাতছাড়া করতে চাননি নবনীর পরিবার৷ পাত্র একমাত্র সন্তান, আইবিএ থেকে এমবিএ করেছে, সুদর্শন। অল্প বয়সেই হ্যান্ডসাম স্যালারির চাকরী করছে। এ পাত্র কীভাবে এড়ানো যায়? আর সৈকতের পরিবার খুব আগ্রহ করেই নবনীকে বরন করেছে। তবে নবনীর মাস্টার্সের আগে বিয়ে করার ইচ্ছা ছিলনা। কিন্তু সকলে বোঝালো যে বিয়ের পরেও সে পড়াশুনা করতে পারবে।
বিয়ের পরপরই নবনী কনসিভ করে। ফলে আর মাস্টার্সে ভর্তি হওয়া হয়নি। মেয়ের বয়স ৭ বছর শেষ হলো এই বছর। বহুবার নবনী ভর্তি হতে চেয়েছে। কিন্তু সৈকত আর তার পরিবারের যুক্তি, আর পড়াশুনার কি দরকার? তাদের কি টাকা পয়সার কোন অভাব আছে? তাছাড়া চাকরী করলে সৃজাকে সময় কোত্থেকে দিবে। শাশুড়ির বয়স হয়েছে। তারা চাননা সৃজা কাজের লোকের সাহচর্যে মানুষ হোক। 
বিয়ের পর প্রথম দুই বছর সবকিছু ভালো চলছিল। হঠাৎ করেই সৈকতের পরিবর্তন। বরাবরই জেদী স্বভাবের সে। তবে তা নবনী সহ্য করে নিতো। যতদিন যেতে থাকে সৈকতের ঔদ্ধত্য বাড়তে থাকে। আর তা সীমা ছাড়িয়ে যেতে থাকে খুব দ্রুত। নবনীর সব কিছুতেই দোষ ধরা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে যেন। নুন থেকে চুন খসলেই অকথ্য ভাষায় গালাগালি।
- সোহেলের বৌ দুইটা বাচ্চা নিয়ে সবকিছু কি সুন্দর মেইন্টেন করে। আর তুমি একটা বাচ্চা নিয়েই কেমন এলোমেলো হয়ে গেছো৷ না আছে সংসারের দিকে মন, না আছে বাচ্চার দিকে খেয়াল। প্রায় সময় সৃজার ঠান্ডা লেগে থাকে। কোনদিকে খেয়াল রাখতে পারোনা। চেহারাটা দেখেছো আয়নায়? তোমাকে স্ত্রী হিসেবে পরিচয় দিতেও তো লজ্জা লাগে? 
- সবার পরিস্থিতি কি এক সৈকত? সোহেল ভাইদের একান্নবর্তী পরিবার না। এটা তো বুঝতে হবে।
- কি তুমি চাইছো আমি আমার বাবা মায়ের কাছ থেকে আলাদা হয়ে যাই? তাহলে তো তুমি সুখী হও তাইনা? এজন্যই এত মুখ কালো করে ঘুরে বেড়াও? নিশ্চয়ই তোমার মা এই বুদ্ধি দিয়েছে। তোমার মা খুব চালাক। দেখলে বাবা বাবা করে। পেটে পেটে সব চালাকি। 
আমি সব বুঝি।
- ছিঃ কি বলছো এসব? এত শিক্ষিত হয়ে অসভ্যের মত আচরণ করছো তুমি?
- কি আমি অসভ্য!!

বলেই গালে ভীষন জোরে চড় মারলো। সেদিন থেকেই গায়ে হাত তোলা শুরু। চার বছরের সৃজা ভয়ে কাঁপছিল। গভীর রাতে কয়েকবার চিৎকার দিয়ে উঠছিল।

এরপর প্রায়ই এমন ঘটনা ঘটতে থাকে৷ 

কিভাবে নবনী সুন্দর থাকবে? সৃজার এজমার সমস্যা। প্রায় সময়েই ঠান্ডা লেগেই থাকে। শ্বশুরের গ্যাস্ট্রিক আলসার, মসলা জাতীয় খাবার খেতে মানা। সৈকতের স্পাইসি খাবার পছন্দ৷ এরা আবার কাজের লোকের হাতের রান্নাও খাবেনা। শাশুড়ীর বাতের ব্যাথা। তাছাড়া রান্নাঘরের গরম সহ্য করতে পারেননা। শ্বশুর আবার এবেলার খাবার ওবেলা খেতে চাননা৷ এদিকে ঘরে প্রায়ই মেহমান আসেন। তাদেরকে পরিবারের ঐতিহ্য অনুযায়ী হাতে তৈরি নাস্তা খাওয়াতে হয়। সারাক্ষন তো হেঁসেলেই কাটে। নবনীর আয়না দেখার সময় কোথায়? নিজের জন্য একটু সময় কোথায়? নবনী একেবারে হারিয়ে ফেলেছে নিজেকে।


ঘুম থেকে উঠে রহমান সাহেব জাহানারা বেগমকে খুঁজতে খুঁজতে চলে এলেন গেস্ট রূমে। 

- মামনি, তুই কখন এলি?

- এইতো বাবা, সৃজাকে স্কুলে দিয়ে এসেছি।

- আজ এখানে থাক। রাতে সৈকতকে আসতে বলে দেই। আমি নানাভাইকে স্কুল থেকে নিয়ে আসি।

- না, বাবা আজ থাক। 

আসিফ, আসিফের বউ তুলিও ঘুম থেকে উঠে  কথার আওয়াজ শুনে গেস্ট রূমে এল। নবনীকে দেখে উচ্ছ্বসিত হয়ে গেল।
নাস্তার টেবিলে সকলে বসলে জাহানারা বেগম সংক্ষিপ্ত আকারে নবনীর ব্যপারটা বললেন।

বাবা বললেন,

- নবনী ভেবে চিন্তে  সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এ বিষয়ে আমার কোন মন্তব্য নেই। মেয়েকে রাখার সামর্থ্য এখনও তার বাবার আছে?

আসিফ বলল,

- আমাদের মান সম্মানের ব্যপার দেখবেনা? আমাদের ফ্যামিলিতে এমন কোন হিস্ট্রি নেই। এক হাতে তালি বাজেনা বাবা। নিশ্চয়ই নবনীর দোষ আছে। শুধু শুধু ওর গায়ে হাত তুলবে কেন?

মা বললেন,

- তা বলে গায়ে হাত তুলবে? তাও এমন নির্মমভাবে? না আমি আমার মেয়েকে ওই ঘরে আর যেতে দেবোনা। ওর কি আত্মসম্মান নেই? ও কি জলে ভেসে এসেছে?

আসিফ বলল,

- আপু এই বাড়িতে আসলে আমি আর তুলি বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো। 

নবনী বলল,

- আমার জন্য কারো ভাবতে হবেনা। বলেই কাঁদতে কাঁদতে বাসা ছেড়ে বের হয়ে গেলো।

সৃজার স্কুল ছুটি হতে আরো ১ ঘন্টা মত বাকী। স্কুলের পাশে পার্কে বসে থাকলো। তারপর মেয়েকে নিয়ে বাসায় গেল।
শাশুড়ি দরজা খুলেই বললেন,

- কি ব্যাপার স্কুল থেকে কোথায় গিয়েছিলে? বাসায় এলেনা যে। এদিকে সৈকত রাগারাগি করে বাসা থেকে বের হয়ে গেল। রান্নার কোন আয়োজন শুরু হয়নি। আজ খেতে খেতে বিকেল হবে। তোমার শ্বশুর যে অসুস্থ তার কথা তো অন্তত ভাববে? আমার কথা না হয় বাদই দিলাম। 

নবনী কিছু না বলে সৃজাকে গোসল করিয়ে দুধ কর্নফ্লেক্স খাওয়ালো। তারপর রান্নাঘরে গিয়ে একে একে সব কাজ শেষ করলো। 
বিকেলে সৃজাকে নিয়ে বের হওয়ার প্ল্যান করলো। মেয়েটার কোথাও ঘুরতে যাওয়া হয়না। শাশুড়ি বললেন,

- কোথায় যাচ্ছো?

- সৃজাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাচ্ছি।

প্রথমে দুজন গেল পিজা হাটে। ওখান থেকে চলে গেল কলা ভবনে, তার অতি সুখের দিন কেটেছে যে ক্যাম্পাসে। আহ সোনালী দিনগুলোকে যদি আর খুঁজে পাওয়া যেতো। তারপর গেলো গুলশানের একটা দামী রেস্টুরেন্টে। বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত ১০ টা।
দরজা খুলল সৈকত। 

-ডাক্তার দেখাতে এত সময় লাগে? ফোন ধরনি কেন? একা একা জাহান্নামে যেতে। মেয়েকে নিয়েছো কেন? 

- আমার ইচ্ছা। খুব টায়ার্ড লাগছে। ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়বো।

সৈকত মারার জন্য হাত তুলতে গেলে খপ করে হাতটি ধরে ফেলল নবনী। 

এর পর সৃজাকে  নিয়ে রূমে গিয়ে  দড়াম করে দরজা বন্ধ  করে দিলো। রাতে সৃজা এক গ্লাস দুধ খেয়ে ঘুমায়। নবনী দুধ বানিয়ে দিলো সৃজাকে। কিছুক্ষন পরেই সৃজার প্রচন্ড শ্বাসকষ্ট হতে থাকে, মুখ থেকে গাঁজলা বের হতে থাকে। কি করল নবনী এটা? নিজ হাতে মেয়েকে খুন করলো? ইঁদুরের বিষ মিশিয়ে দিলো দুধে? কি করবে এখন? কি করে বাঁচাবে?

গলায় আঙ্গুল দিয়ে বমি করানোর চেষ্টা করলো। না কোন লাভ হলোনা। মেয়ের চোখ উলটে যাচ্ছে। ঘামে শপশপে হয়ে ভিজে গেছে জামা। এরপর নিথর শরীর পড়ে রইল নবনীর বুকে। নবনী মেয়েটাকে শুইয়ে দিয়ে।  বাকী বিষটুকু নিজে খেয়ে নিল। মেয়ের সাথে অনন্তযাত্রায় সঙ্গী হলো।
কি সব আজেবাজে চিন্তা করছে নবনী। একটা মন্দ মানুষের জন্য সে কেন আত্মাহুতি দিবে? সে না থাকলে কার কি কিছু আসবে যাবে? 

কিছুদিন আগেই পত্রিকায় একটি বিজ্ঞাপন দেখেছে, একজন প্যারালাইজড বয়স্ক মহিলাকে দেখাশুনা করার জন্য একজন মহিলা আবশ্যক। অসুস্থ মহিলা আর তার হাজব্যান্ড বাংলাদেশে থকেন। ছেলেমেয়েরা সবাই বিদেশে। নবনী যোগাযোগ করেছিল। তাদের সব শর্তে নবনী রাজী। আর নবনীর শর্ত ছিল, তার সাথে তার মেয়েটি থাকবে এবং থাকার জন্য একটা ঘর দিতে হবে। এই ধরনের রোগী দেখার জন্য কোন মানুষ পাওয়া যায়না। নবনীর মত শিক্ষিত মেয়ে রাজী হওয়ায় তারাও তার শর্তগুলো মেনে নিয়েছে।
নবনী হেরে যাবেনা। সৃজাকেও হারতে দেবেনা।

# আঁধার থেকে আলোয় 

নুসরাত লীমা


Somoy Journal is new coming online based newspaper in Bangladesh. It's growing as a most reading and popular Bangladeshi and Bengali website in the world.

উপদেষ্টা সম্পাদক: প্রফেসর সৈয়দ আহসানুল আলম পারভেজ

যোগাযোগ:
এহসান টাওয়ার, লেন-১৬/১৭, পূর্বাচল রোড, উত্তর বাড্ডা, ঢাকা-১২১২, বাংলাদেশ
কর্পোরেট অফিস: ২২৯/ক, প্রগতি সরণি, কুড়িল, ঢাকা-১২২৯
ইমেইল: somoyjournal@gmail.com
নিউজরুম ই-মেইল : sjnewsdesk@gmail.com

কপিরাইট স্বত্ব ২০১৯-২০২৪ সময় জার্নাল