বুধবার, ফেব্রুয়ারী ২, ২০২২
ওয়াজেদুল হক, মেহেরপুর প্রতিনিধি: মেহেরপুর থেকে গ্রাহকের ৭ কোটি টাকা নিয়ে লাপাত্তা হয়েছেন স্বর্ণালী নামের একটি ক্ষুদ্র ঋণ প্রদান, সঞ্চয় ও সমবায় সমিতির পরিচালক। গত পাঁচদিন থেকে ঐ সমিতির পরিচালক মাহিরুল ইসলাম অফিসে না আসায় গ্রাহকদের মাঝে সন্দেহের সৃষ্টি হয়। জেলার গাংনী উপজেলার গাড়াবাড়িয়া গ্রামে অবস্থিত স্বর্ণালী ক্ষুদ্র ঋণ প্রদান, সঞ্চয় ও সমবায়ের আড়ালে এফ.ডি.আর সংগ্রহ করতো। লাখে দেড় হাজার, কখনও কখনও লাখে দুই হাজার টাকা সুদ দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে গ্রাহকদের কাছ থেকে ঐ অর্থ সংগ্রহ করেছেন।
জানুয়ারি মাসজুড়ে সদস্যদের ঋণ ও আমানতের সুদ প্রদান করার কথা থাকলেও বিভিন্ন অজুহাতে গ্রাহকদের ঘোরাতে থাকে। সর্বশেষ ফেব্রুয়ারীর এক ও দুই তারিখে সদস্যদের ঋণ ও আমানতের সুদ প্রদান করার সর্বশেষ সময় নির্ধারণ করে দিয়ে ফোন বন্ধ রেখে লাপাত্তা হয়েছেন মাহিরুল। সদস্যদের চাপে মঙ্গলবার সকাল থেকে অফিসে তালা ঝুলিয়ে অন্যান্য কর্মচারীরাও পালিয়ে গেছেন। ফলে গাংনীর কাথুলী ইউনিয়নের প্রায় এক হাজার সদস্য স্বার্ণালি সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতি থেকে টাকা ফেরত না পাওয়ার শঙ্কায় কান্নাকাটি আর হাহুতাশ শুরু করেছেন।
মাহিরুলের বাড়ি গাংনী উপজেলার মটমুড়া গ্রামে হলেও বছর দশেক আগে এলাকার কাথুলি গ্রামে সুরাফত আলীর মেয়ের সাথে বিয়ে করে বসবাস করতে শুরু করেন। ২০১৫ সালে সমবায় অফিস থেকে স্বার্ণালি সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতি নামে রেজিস্ট্রেশন নিয়ে সদস্য তৈরি করে আমানত গ্রহণ ও ঋণ প্রদান কার্যক্রম শুরু করেন। সমিতির রেজিস্ট্রেশন নং মেহের/০৩। প্রথমদিকে এক লাখ টাকায় ২ হাজার টাকা করে সুদ প্রদান করলেও সম্প্রতি করোনার কারনে তা কমিয়ে ১৬শ টাকা নির্ধারণ করে। গেল জানুয়ারী থেকে আমানতের বিপরীতে ওই সুদ প্রদান বন্ধ করে দেয়। বন্ধ করা হয় ঋণ প্রদান কার্যক্রমও। এরই মধ্যে লাপাত্তা হয়েছেন মাহিরুল ইসলাম। টাকা হারিয়ে সদস্যদের এখন পথে বসার উপক্রম হয়েছে।
বুধবার সকালে সরজমিনে গাড়াবাড়িয়া গ্রামে ঐ সমবায় সমিতির অফিসে গেলে শতাধিক গ্রাহককে হাহুতাশ করতে দেখা যায়। এদের মধ্যে গাড়াবাড়িয়া গ্রামের নাজিম উদ্দিন ১৪ লক্ষ টাকা, মিয়ারুল ইসলাম ১লক্ষ ৫০ হাজার টাকা, ফড়ি হক ৩ লক্ষ টাকা, মিলন হোসেন ১২ লক্ষ টাকা, ইলিযাস হোসেন ২লক্ষ টাকা, উজ্জল হোসেন ১লক্ষ ৫০ হাজার টাকা, জিল্লুর রহমান ৭ লক্ষ টাকা, আমির হোসেন ৫ লক্ষ টাকা, আযান আলী ১২ লক্ষ টাকা, বিল্লাল হোসেন ১ লক্ষ টাকা, মন্টু হক ৭ লক্ষ টাকা আমানত রেখেছেন বলে জানিয়েছেন। এভাবে কাথুলী ইউনিয়নের অন্তত এক হাজার সদস্যের কাছ থেকে কমপক্ষে ৭ কোটি টাকা নিয়ে মাহিরুল ইসলাম লাপত্তা হয়েছেন বলে অভিযোগ উপস্থিত সদস্যদের।
সদস্য ফড়ি হক জানান, তিনি দিন মজুরের কাজ করেন। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে উপার্জিত টাকা থেকে তিল তিল করে জমানো টাকা স্বর্ণালি সমিতিতে রেখেছিলেন। সমিতির পরিচালক মাহিরুল তাদের টাকা নিয়ে পালিয়ে গেছে। তাদের এখন পথে বসা ছাড়া কোন উপায় নেই। টাকা ফিরিয়ে আনতে প্রশাসনের সাহায্য কামনা করেন তিনি।
সদস্য নাজিমউদ্দিন বলেন, তিনি ব্যবসায়ী মানুষ। কোন ব্যবসায় লাভবান না হতে না পেরে পুঁজি শেষ হয়ে যাচ্ছিল। ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে তিনি তার ১৪ লক্ষ টাকা স্বর্ণালি সমিতিতে জমা রেখেছিলেন। মাসে যে টাকা লাভ পেতেন তা দিয়ে সংসার চলতেন। এখন লাভ-আসল লাভ সবই হারালেন। বাঁকি জীবন কিভাবে কাটাবে আর কিভাবে সংসার চালাবেন তা নিয়ে হতাশ হয়ে পড়েছেন। কৃষক আযান আলী বলেন, ঠিকমত কৃষি কাজ করতে না পারায় চাষের দুই বিঘা জমি বিক্রি করে ১২ লক্ষ টাকা স্বর্ণালি সমিতিতে জমা রাখেন। যা লভ্যাংশ পেতেন তা দিয়ে সংসার চলতো। এখন সব হারিয়ে পথে বসলেন।
মাহিরুলের অফিসের ঋণ আদায়কারী ছিলেন মেহের আলী, বায়েজিদ হোসেন, বিল্লাল হোসেন ও সাহারুল ইসলাম। এদের মধ্যে মেহের আলী বলেন, তারা মনে করেছিলেন সমিতির পরিচালক অফিসের কাজে হয়তো কোথাও গেছেন। তবে তিন চারদিন যাবৎ অফিস করছেন না, ফোনও বন্ধ। এখন মনে হচ্ছে টাকা নিয়ে পালিয়ে গেছেন। তারা অফিসের কর্মচারী তাদের কিছু করার নেই। তার পরেও গ্রহাকরা তাদের উপর চড়াও হচ্ছেন। বাধ্য হয়ে তারাও পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
বিল্লাল হোসেন বলেন, সরাকারী নিবন্ধন ভূক্ত এনজিওতে চাকুরি করছি। তাদের কাছ থেকেও এক লাখ টাকার জামানত নিয়েছেন। সাথে নিয়েছেন ফাকা চেক। তাদের কাজ ছিলো মানুষকে ঋণ দেওয়া ও আদায় করা। এখন মালিক পলাতক থাকায় তারাও বিপাকে পড়েছেন। মুঠোফোনে তার সাথে যোগাযোগও করতে পারছেননা। এখন গ্রাহকদের ভয়ে মাঠে মাঠে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। তারাতো কারো কছে থেকে এফ.ডি.আর সংগ্রহ করেননি। মালিক মাসে বেতন দিতেন ৯ হাজার টাকা করে। এখন ছেলে-মেয়ে, স্ত্রী, ও বাবা-মাদের কি হবে?
মাহিরুলের শশুর সারাফত মন্ডল বলেন, জামায়কে বার বার নিষেধ করা সত্বেও তার কথা শোনেনি। উল্টো জামাই বলেছেন আমি নাকি অশিক্ষিত। এসবের কিছুই বুঝিনা। রবিবার রাতে বাড়ি থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে বের হয়ে আর কারো ফোন ধরছেনা। এখন নিজেই বিপদে পড়েছেন। গ্রাহকরা মামলা করলে তার ও তার মেয়ের নামেও করতে পারে। কারণ তার মেয়েও ওই সমিতির নির্বাহী কমিটির সদস্য। এখন আতঙ্কের মধ্যে দিন যাপন করছেন তারা। সমিতি করে তার এত বড় সর্বনাশ হবে ভাবতেও পারেননি তিনি।
কাথুলী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান রানা জানান, তার ইউনিয়নে এত বড় একটি ঘটনা ঘটেছে তারপরেও বিষয়টি তিনি জানতে পারেননি। তিনি বিস্তারিত জেনে কি করা যায় ভেবে দেখবেন।
জেলা সময়বায় অফিসার প্রভাষ চন্দ্র বালা বলেন, সমবায় আইনে কোন সংস্থা এফডিআর করতে পারেনা। বিষয়টি তিনি শুনেছেন। ঘটনা তদন্ত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ঘটনা আরো কোন প্রতিষ্ঠান করলে তাদের সমবায় লাইসেন্স বাতিল করা হবে।
গাংনী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মৌসুমী খানম বলেন, গ্রাহকরা লিখিত অভিযোগ করলে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালকের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এমআই