সর্বশেষ সংবাদ
মজিদ মাহমুদ
*
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রথমদিকে উল্লেখযোগ্য ছোট গল্পটি লিখেছিলেন প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার ও সাহিত্যিক শহীদ বুদ্ধিজীবী জহির রায়হান। মুক্তিযুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয়ের প্রাক্কালে তাঁর নিহত হওয়ার ঘটনা এই গল্পের অকাট্য সময়ের দাবি প্রমাণ করে। তবে এটি প্রথম গল্প কিনা তা নিশ্চয় করে বলতে পারব না। জহির রায়হানের গল্পটির নাম ‘সময়ের প্রয়োজনে’। চলচ্চিত্রকার ও সাংবাদিক এই লেখকের নিজস্ব ঢঙের সঙ্গে গল্পের আঙ্গিকের মিল রয়েছে সর্বাঙ্গে। উত্তম পুরুষে গল্পটি বর্ণিত হলেও কেন্দ্রীয় চরিত্রের একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা। লেখক মুক্তিযুদ্ধের একটি ক্যাম্পে যুদ্ধের সংবাদ সংগ্রহ করতে গেলে কমান্ডার তাকে একটি ডায়েরি দেন। ডায়েরির পাঠ্য-বিষয় লেখক এখানে তুলে ধরেন। ছোট গল্পের সাধারণ কাঠামো এখানে রক্ষিত হয়নি। ভালেরি ওসিপভের না ‘পাঠানো চিঠি’র ঢঙে গল্পটি লিখিত। এই গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র মুক্তিযুদ্ধ। যুদ্ধ কিভাবে মানুষকে দ্রুত পাল্টে দিচ্ছে। যুদ্ধক্ষেত্রে মানুষের অনুভূতি, জীবন-মরণ বোধ এক নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হচ্ছে। প্রতিদিনই মুক্তিযোদ্ধারা সম্মুখসমরে তাঁর সঙ্গীদের হারাচ্ছেন। আবার নতুন সহযোদ্ধা এসে যোগ দিচ্ছেন। গত দিন যে বন্ধু ছিল আজ সে শত্রুতে পরিণত হচ্ছে। এসবই জহির রায়হানের গল্পের বিষয়। তবু এই গল্পের মধ্যে লেখক দর্শনের গভীর সমাধান খুঁজতে চেষ্টা করেছেন। তিনি সবচেয়ে গভীর কথাটি বলেছেন, কেন এই যুদ্ধে লড়তে হচ্ছে তাদের। ‘দেশ তো ভূগোলের ব্যাপার। হাজার বছরে যার হাজারবার সীমারেখা পাল্টায়। পাল্টাচ্ছে। ভবিষ্যতেও পাল্টাবে। তাহলে কিসের জন্য লড়ছি আমরা? বন্ধুরা নানাজনে নানারকম উক্তি করেছিল। কেউ বলেছিল আমরা প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য লড়ছি। ওরা আমাদের মা-বোনদের কুকুর বেড়ালের মতো মেরেছে তাই। তার প্রতিশোধ নিতে চাই। কেউ বলেছিল, আমরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়ছি। ওই শালারা বহু অত্যাচার করেছে আমাদের ওপর। শোষণ করেছে। তাই ওদের তাড়াবার জন্যই লড়ছি। কেউ বলেছিল অতশত বুঝি না মিয়ারা। আমি শেখ সাহেবের জন্য লড়ছি। কেউ বলেছিল, কেন লড়ছি জানো? দেশের মধ্যে যত গুণ্ডা বদমাশ, ঠগ দালাল ইতর, মহাজন আর ধর্মব্যবসায়ী আছে তাদের পাছায় লাথি মারতে। আমি ওদের কথাগুলো শুনছিলাম। ভাবছিলাম। মাঝে মাঝে আলোচনায় অংশ নিতে গিয়ে তর্ক করেছিলাম। কিন্তু মন ভরছিল না। কিসের জন্য লড়ছি আমরা? এত প্রাণ দিচ্ছি, এত রক্তক্ষয় করছি? হয়তো সুখের জন্য শান্তির জন্য। নিজের কামনা-বাসনা পরিপূর্ণতা দেবার জন্য। কিংবা শুধু বেঁচে থাকার তাগিদে। নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য। অথবা সময়ের প্রয়োজনে। সময়ের প্রয়োজন মেটাবার জন্য লড়ছি আমরা।’ গল্পটি যে যুদ্ধকালে লিখিত হয়েছিল তার প্রমাণ তখনো মুক্তিযুদ্ধের হতাহতের সংখ্যা নির্ধারণ হয়নি। তাছাড়া মুক্তিযোদ্ধাদের ধারণা ছিল যুদ্ধ শেষ হতে অনেক সময় লাগবে। পাকিস্তানের মতো ঝানু সামরিক বাহিনীর হাত থেকে সহজে মুক্তি পাওয়া যাবে না। আর তাদের বর্বর বাহিনীর হাতে নির্বিচারে বাঙালি হত্যার ঘটনা নাৎসি হত্যা অতিক্রম করবে বলেই মনে হয়েছিল। যুদ্ধ প্রলম্বিত হলে সে আশঙ্কা সত্য হতে পারতো।
বাংলা ছোটগল্প বয়সে নবীন। টেনেটুনে শতখানেক বছর। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেইএ ভাষায় সাহিত্যের সবচেয়ে বলবান শাখা হয়ে উঠেছে ছোটগল্প। এ কথা ঠিক এক রবীন্দ্রনাথের হাতেই ছোট গল্পের ঋদ্ধি তাকেই উৎকর্ষের চূড়া বলা যায়। তাই বলে রবীন্দ্র-পরবর্তী ছোট গল্পের বিকাশ থেমে থাকেনি। রবীন্দ্র-পরবর্তীরা ছোটগল্পকে করে তুলেছেন আরো তীক্ষè ও ইংগিতবাহী। ছোটগল্পের বিষয় সচেতনতাকে নিয়ে কমবেশি আমাদের ধারণা আছে। কিন্তু গত শতকের একাত্তর সালের ২৫ এপ্রিল কালরাত্রির আগে বাংলা ছোটগল্পের লেখকরাও এই ভয়াবহ অভিজ্ঞতাকে বিষয় করে তোলার কথা ভাবতে পারেননি। আর পারলেও তা গল্প না হয়ে ফ্যান্টাসি হতে পারতো।
মুক্তিযুদ্ধ
বাঙালি
জীবনের
সম্পূর্ণ আলাদা অভিজ্ঞতা হাজার বছরে ভাষা-জাতির ইতিহাসে তা যেমন ছিল না। ভবিষ্যতে থাকার যুক্তিসংগত কারণ নেই। আগেও হত্যা গণহত্যা বিদ্রোহ আন্দোলন ও রাজ্যবদল হয়েছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট সব থেকে ভিন্ন ও বৃহত্তর। এমন একটা সর্বাত্মক যুদ্ধের বৈশিষ্ট্য ছোটগল্পে তুলে ধরা কি সম্ভব? ছোটগল্প বিন্দুর মধ্যে সিন্ধুর প্রতিবিম্ব হলেও ইতস্তত বিক্ষিপ্ত হাজারো কাহিনী, হাজারো অভিজ্ঞতা ছোটগল্প কীভাবে ধারণ করে এ প্রশ্নটি অস্বাভাবিক নয়। নেপোলিয়নের যুদ্ধের কাহিনী ধারণে তলস্তয় যেমন বৃহৎ উপন্যাস ফেঁদেছিলেন, তেমন একটা উপন্যাসেই কি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অনুপুঙ্খ বর্ণনা করা যায়? জহির রায়হান তাঁর গল্পে এর ইংগিত দিয়েছেন। এই যুদ্ধের লক্ষ্য ছিল বহুজনে বহুরকম। এই জনপদের প্রায় প্রতিটি মানুষ তার নিজেদের মতো করে মুক্তিকামনা করছিলো। প্রতিটি মানুষের মুক্তির ছোট ছোট ইচ্ছেগুলোর সম্মিলনই ছিল মুক্তিযুদ্ধ। আর সেদিক দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্য বলতে ছোটগল্প সঠিক উপায়। আর সবগুলো ছোটগল্প মিলেই মুক্তিযুদ্ধের একটি গল্প। একটি মহাগল্প। বাঙালি তথা এই জনপদের মানুষের সংগ্রাম ও স্বপ্নযাত্রা মানুষ হিসেবে টিকে থাকার লড়াই, জীবনদান ও বিশ্বাসঘাতকতা, তার কুটিল ও জটিল মনের পরিচয় এই গল্পগুলোতে ধরা পড়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের ছোটগল্পের কেন্দ্রীয় বিষয় মুক্তিযুদ্ধ হলেও স্থান-কাল-পাত্র ভেদে মুক্তিযুদ্ধের গল্পকে আমরা বহুভাবে পল্লবিত হতে দেখেছি। রচনাকালের দিক দিয়ে তা প্রধানত তিন প্রকার।
১. ’৭১ সালে চূড়ান্ত মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে মুক্তির চেতনা নিয়ে যেসব গল্প লিখিত হয়েছিল, এ ধারার সূচনা মূলত ’৫২-র ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে।
২. মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে লিখিত মুক্তিযুদ্ধের গল্প।
৩. চূড়ান্ত স্বাধীনতার পর মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাকে অবলম্বন করে লিখিত মুক্তিযুদ্ধের গল্প।
তাছাড়া মুক্তিযোদ্ধার রয়েছে নানা চরিত্র। কেউ যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে ভারতে হিজরত করেছিলেন। কেউ দেশের মধ্যেই প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। কেউ প্রশিক্ষণ ছাড়াই লড়াই শুরু করেছিলেন। কেউ গেরিলা যুদ্ধ করেছিলেন। কেউ সম্মুখ যুদ্ধ। যুদ্ধের মারণাস্ত্র ছাড়া এমনকি দা বটি লাঠিসোটাও হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যবহার হয়েছিল। আবার অনেকেই ছিলেন চোরাই মুক্তিযোদ্ধা। আসলে দলমত ধর্ম বর্ণ বয়স লিঙ্গের পার্থক্য ছাড়াই এ জনপদের প্রায় সবাই মুক্তিযোদ্ধায় পরিণত হয়েছিল। সেই সঙ্গে এদেশের ভূপ্রকৃতি ও ঋতুবৈচিত্র্য অপরিচিত পাকসেনাদের সুযোগমত বেকায়দায় ফেলেছিল। আর দেশের মধ্যে যারা পাকবাহিনীর দোসর ছিল, তাদের রাজনৈতিক অংশটা বাদ দিলে অধিকাংশই ছিল অনাহারী ভীতু ও সুবিধাবাদী শ্রেণির।
মুক্তিযুদ্ধ চার দশক অতিক্রম করে গেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই এখনো জীবিত। লেখক এবং পাঠক-জনতার প্রায় এক-চতুর্থাংশের কোনো না কোনোভাবে এখনো রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ স্মৃতি। মুক্তিযোদ্ধা, পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নিকট আত্মীয়-স্বজন এমনকি পাক-হানাদার বাহিনীর দুষ্কর্মের সহযোগীদের অনেকেই এখনো রয়েছে জীবিত। সুতরাং মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ ঘটনা নিয়ে গল্প উপন্যাস লেখার কাল এখনো বিদ্যমান। সম্প্রতি যুদ্ধ অপরাধের বিচার নিয়ে কিছুটা তৎপরতা দেখা যাচ্ছে, তার সঙ্গে হূমায়ুন আহমেদের ‘জলিল সাহেবের পিটিশন’ গল্পটির বেশ মিল রয়েছে।
জলিল
সাহেব
দুজন
শহীদ
মুক্তিযোদ্ধার বাবা। দুই দশক আগে লেখা এই গল্প সমকালীন প্রেক্ষাপটেও তার আবেদন হারায়নি। এ গল্পের নায়ক জলিল সাহেব যুদ্ধ অপরাধীদের বিচারের জন্য জনে জনে স্বাক্ষর সংগ্রহ করে বেড়িয়েছেন। তিনি বিচার চান এজন্য নয় যে যুদ্ধে তার দুই ছেলে নিহত হয়েছেন। এ গল্পে হূমায়ুন আহমেদ যুদ্ধের বাস্তবতা অস্বীকার করেননি। এমনকি যুদ্ধে নিহত তার পুত্র হারানোর কষ্টের চেয়েও তার প্রাণে বাজে যেসব নিরাপরাধ লোককে সে সময় ধরে নিয়ে মেরে ফেলা হয়েছিল। পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন করা সময়ের প্রয়োজনে
অপরাধ
ছিল
সত্য
কিন্তু
তারচেয়ে জঘন্য অপরাধ ছিল নিরপরাধ লোক হত্যা, শিশু ও নারী হত্যা, নিরস্ত্র ও বৃদ্ধ হত্যা তদুপরি ধর্ষণ, লুণ্ঠন, বাড়িঘর ও ফসলের মাঠ জ্বালিয়ে দেয়া। জলিল সাহেব বলছেন, ‘ত্রিশ লাখ লোক মরে গেল। কোনো বিচার হলো না মনে হলে বুকের মধ্যে চিনচিন ব্যথা হয়।’
হূমায়ুন
আহমেদ
অবশ্য
এ
গল্পে
বিচার
বহির্ভূত কোনো শাস্তি প্রত্যাশা করেননি। তাই জলির সাহেব বলেন, ‘শুধু দস্তখত যোগাড় করলেই হবে না। কেস চালানোর মতো এভিডেন্স থাকতে হবে। বিনা অপরাধে লোকজন ধরে ধরে মেরেছে’ এটা প্রমাণ করতে হবে না?’
হূমায়ুন আহমেদের চিরাচরিত উত্তম পুরুষে লেখা এ গল্পে তিনি বিদেশকালীন তাঁর গল্পের নায়কের কাজের প্রতি সমর্থন খুঁজে পেয়েছিলেন। তার মনে হলো ‘ঠিকই তো ত্রিশ
লাখ
লোক
হত্যা
করে
পার
পেয়ে
যাওয়া
উচিত
নয়।
জলিল
সাহেব
যা
করেছেন
ঠিকই
করেছেন। এটা মধ্যযুগ না। এ যুগে এত বড় অন্যায় সহ্য করা যায় না।’
তবে এ আলোচক গল্পের মধ্যযুগ সম্পর্কে লেখকের এ মন্তব্যের বিরোধিতা করেন। প্রকৃতপক্ষে মধ্যযুগে কি এ ধরনের হত্যার ইতিহাস আছে। মধ্যযুগে কি এত মানুষ হত্যা করা যেত? বলা চলে, তরবারিই তো একমাত্র মারণাস্ত্র। যাদের তরবারি দিয়ে হত্যা করা হতো, তাদের হাতেও তো তরবারি থাকতো। প্রতিপক্ষকে আঘাত করার এই জঘন্য অপরাধ আধুনিক কালের। অহেতুক আমাদের মধ্যযুগকে উল্লেখ করে আধুনিককালের বর্বরতাকে লঘু করার সুযোগ নেই। তাছাড়া প্রশিক্ষিত পাক বাহিনী অস্ত্র ধরেছিল সম্পূর্ণ নিরস্ত্র বাঙালিদের বিরুদ্ধে। এমনকি বর্বর সেনাবাহিনীর ইতিহাস ও ভূগোল জ্ঞানে বাঙালিরা সত্যিকার মুসলমান নয় বলেও তাদের নিধন করা।
তবে যাই হোক, জলিল সাহেবের শেষ আশা কিন্তু পূরণ হয়নি। যুদ্ধাপরাধীদের
বিচার
করা
সম্ভব
হয়নি।
স্বাক্ষর সংগ্রহের এক পর্যায়ে তিনি মারা যান। বিচারের জন্য মামলা রুজু করতে পারেননি। গল্পের বর্ণনাকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক যিনি ভেবেছিলেন, জলির সাহেবের অসমাপ্ত কাজ তিনি এগিয়ে নিয়ে যাবেন। কিন্তু এই অসমাপ্ত কাজ এতদিনেও এগিয়ে নেয়া কেন সম্ভব হয়নি তার একটি যুৎসই কারণও গল্পকার উল্লেখ করেছেন, ‘আমি জলিল’ সাহেব নই। আমাকে ভবিষ্যতের কথা ভাবতে
হয়।
মিরপুরে একটা পরিত্যক্ত বাড়ি কেনার জন্য নানা ধরনের লোকজনের সঙ্গে কথা বলতে হয়। জলিল সাহেবের বত্রিশ হাজার দরখাস্তের ফাইল নিয়ে রাস্তায় বেরোনোর আমার সময় কোথায়?’ গল্পের শেষটায় লেখক আপোষকামী মধ্যবিত্তের টিকে থাকার সংকট ঠিকমতই চিহ্নিত করেছেন।
মুক্তিযুদ্ধের
ছোটগল্পের রয়েছে বহুমুখী চরিত্র। এ সময়ের তীক্ষè ও প্রতিভাবান গল্পকারদের দৃষ্টি যে সব এড়িয়ে যায়নি। তাই মুক্তিযুদ্ধের ছোটগল্পগুলোর রয়েছে সম্পূর্ণ আলাদা বিস্তার। একঘেয়েমি ও একরৈখিকতা থেকে মুক্তÑ কে মুক্তিযোদ্ধা আর কে মুক্তিযোদ্ধা নয়, এমনকি মুক্তিযুদ্ধের সর্বব্যাপ্ত পরিধি বোঝার জন্য এ সময়ের ছোটগল্পই সবচেয়ে জীবন্ত ও সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। মুক্তিযোদ্ধাদের যে কত রকমফের ছিল তা বোঝার জন্য, আবু জাফর শামসুদ্দীনের ‘কলিমদ্দি দফাদার’, শওকত ওসমানের দুই ব্রিগেডিয়ার’, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘রেনইকোট’, ইমদাদুল
হক
মিলনের
‘লোকটি
রাজাকার ছিল’, মঈনুল আহসান সাবেরের ‘কবেজ লেঠেল’ প্রভৃতি গল্পের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধার বিচিত্ররূপ ও চরিত্র ধরা পড়েছে। কলিমদ্দি দফাদার যুদ্ধের সময় বহাল তবিয়তে তার সরকারি দায়িত্ব পালন করে গেছেন। নামাজী মানুষ। তাকে বিশ্বাস করতে মিলিটারিদের কষ্ট হয়নি। কিন্তু সুযোগ পেলেই মিলিটারিদের বেকায়দায় ফেলে দিয়েছে সে। একবার মুক্তিবাহিনীর আস্তানা দেখিয়ে দেয়ার সময়ে বর্ষার খরস্রোতা নদীর উপর কাঠের নড়বড়ে সাঁকো ঝাকিয়ে মুক্তিবাহিনী বলে চিৎকার করে তাদের নদীতে ফেলে দিয়ে খতম করেছিলেন। কলিমদ্দি দফাদার এখনো ইউনিয়ন পরিষদে চাকরি করেন। তার সঙ্গীরা সবাই মুক্তিযোদ্ধা। সবার কাছে তার একটু আলাদা মর্যাদা রয়েছে।
দুই ব্রিগেডিয়ার গল্পে শওকত ওসমান যুদ্ধের আকস্মিকতা এবং সয়ীদ ভূঁইয়া নামের এক দমকল বাহিনীর ব্রিগেডিয়ারের আগুন নেভানো কাহিনী বর্ণনা করেন। ২৫ মার্চের কালরাত্রিতে যখন পলাশী এলাকায় পাকবাহিনী ধ্বংসযজ্ঞ চালায় তখন সয়ীদ ভূঁইয়া তার দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে পাক বাহিনীর গুলিতে নিহত হয়। তাকে কেন গুলি করা হয় জানতে চাইলে পাক ব্রিগেডিয়ার বলে, ‘শোন বাঙালিকে বাচ্চা হামভি ডিউটি যে নিকলা। মেরা আর ডিউটি
হ্যায়
আগ
(আগুন)
বাগানা
জায়গা
তোমরা
হ্যা
বুজানা
(নেভানো)...সমঝা?’
আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের রেইনকোট গল্পের মুক্তিযোদ্ধা একজন কলেজ শিক্ষক। নাম নূরুল হুদা। সে আনুষ্ঠানিকভাবে মুক্তিযুদ্ধে গমন করেনি। কিন্তু মিলিটারির কাছে সে ঠিকই ধরা পড়ে যায়। আর মিলিটারির কাছে ধরা পড়া মানেই অমানুষিক নির্যাতন। সেই নির্যাতন নূরুল হুদাকে সইতে হয়েছিল। এই গল্পটির নাম রেইনকোট কেন। ইলিয়াস ঠিকই তার প্রতিভার মাপে গল্পটি রচনা করেছেন। শিল্প সৌকর্য বিবেচনায় ইলিয়াসের গল্পটি মনে রাখার মতো। গল্পের নায়ক নূরুল হুদাকে স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য ছাদের হুকের সঙ্গে উল্টো করে বাঁধা হয়। তার পাছার উপর যথেচ্ছা সপাং চাবুক মারা হয়। এই নির্যাতনে এক সময় নূরুল হুদা আবিষ্কার করে রেইনকোটের ওপর বৃষ্টি পড়ার শব্দ। অর্থাৎ তার চামড়াকে রেইনকোট আর মিলিটারির অত্যাচারকে বৃষ্টির অত্যাচারের অধিক কিছু মনে হয় না। কারণ নূরুল হুদা আগেই জানতেন, রাশিয়ার জেনারেল উইন্টার যেমন রাশিয়াকে রক্ষা করেছিল তেমন বাঙালির জেনারেল মনসুনও পাক হানাদারদের নাস্তানাবুদ করে ছাড়বে।
ইমদাদুল
হক
মিলন
একটি
সম্পূর্ণ রাজাকার চরিত্রের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের অনুপ্রেরণা আবিষ্কার করেছেন। তার গল্পে প্রকৃত শিল্পীসুলভ দরদ ও উদ্বোধন ধরা পড়েছে। তার গল্পের ‘লোকটি রাজাকার ছিল’ তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু বড় কথা রাজাকার এবং মুক্তিযুদ্ধের তফাৎ সে জানতো না। পেটের দায়ে চেয়ারম্যানের কাছে গেলে চেয়ারম্যানই তাকে রাজাকারের চাকরি দেয়। সে তো একটি কাজ হিসেবেই এটিকে দেখেছে। এমন সরল বোকা মানুষ যে পেটের দায়ে রাজাকারী ফাঁদে পড়েছিলÑগল্পকার সেকথাই বলতে চেয়েছেন। কিন্তু যখন সে জানলো দেশের বিরুদ্ধে কাজ করছে, বিদেশি খারাপ মানুষদের পক্ষে কাজ করছে তখন তার হুশ ফেরে। তার এই বেঈমানীর শাস্তি যে মৃত্যুদ- হওয়া উচিত সে ব্যাপারে সে নিজেই রায় দেয়। আর সে এজন্য মৃত্যুদ- পেতে চায় যাতে অন্য কেউ আর রাজাকার হতে সাহস না পায়।
মঈনুল আহসান সাবেরের ‘কবেজ লেঠেল’ গল্পের কবেজও অতসব বোঝে না। বংশপরম্পরায় লেঠেল। আকমল প্রধানের লেঠেল। বাছবিচার ছাড়াই খুনটুন তার পেশা। যুদ্ধের সময় সুযোগ সন্ধানীরা যে তার প্রতিপক্ষকে হত্যা করে মুক্তিবাহিনীর ওপর দোষ চাপাতোÑদুই রাজাকারের কাহিনী বর্ণনার মাধ্যমে সাবের তা তুলে ধরেছেন। কিন্তু কবেজ লেঠেল এই প্রথমবারের মতো নিজের বিবেচনা মতো রমজান শেখকে খুন করে। কারণ মিলিটারিদের হত্যা ধর্ষণে রমজান শেখ প্রকাশ্যে ইন্ধন যুগিয়ে যাচ্ছিল। কবেজের কাছে মিলিটারি বা মুক্তিযুদ্ধের চেয়ে প্রকাশ্য অত্যাচারীকে খতম করাই ছিল প্রধান কাজ।
মুক্তিযুদ্ধ যে এখনো শেষ হয়নি সৈয়দ শামসুল হকের ‘ভালো করে কিছুই দেখা যাচ্ছে না বলে’ গল্পে নিখুঁতভাবে ধরা পড়েছে। এরূপ দক্ষ শিল্পী মুক্তিযুদ্ধের একটি চেতনা-প্রবাহ তৈরি করতে চেয়েছেন। পরিচিত মুক্তিযোদ্ধাদের পুনরায় আবির্ভাব দেখে অপরাধীদের মুক্তিযুদ্ধের কথা মনে পড়ে। তাই ইমাম সাহেব ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করে, ‘কন, বাহে, শুনি হামরা। মুক্তিযুদ্ধ কি ফির শুরু হইয়া গেইছে?’ আবু ইসহাক একটা ময়না পাখি নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের গল্প রচনা করেছেন। চিন্তা ও বিষয় বিবেচনায় গল্পটির একটি মূল্য রয়েছে। যুদ্ধের সময় একটি ময়না পাখি জয়বাংলা শব্দটি রপ্ত করেছিল। পাক মেজর এই পোষা ময়নাটি এক মুক্তিযোদ্ধা পরিবার থেকে জব্দ করে। ময়নাটিকে পাকিস্তান জিন্দাবাদ শেখাতে চেষ্টা করে। কিছুতেই ফল হয় না। গল্পকার বলেছেন, স্বাধীন বাংলাদেশেও জয়বাংলা ডাকটি বহুদিন শোনা গেছে। এখন আর ডাকে না। পাহাড়ি ময়না হয়তো পাহাড়েই চলে গেছে। চার দশকের রাজনৈতিক বাস্তবতায় জয়বাংলা তার আগের গুরুত্ব হারিয়ে ফেলেছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধকালে শব্দটিতে একটি জাতির সমষ্টিগত উজ্জীবনী শক্তি ছিল সে সত্য অস্বীকার করা মিথ্যার নামান্তর।
আলাউদ্দিন আল আজাদের ‘আমাকে একটি ফুল দাও’ মাহমুদুল হকের ‘বেওয়ারিশ লাশ’ রাহাত খানের ‘মধ্যিখানে চর’ প্রভৃতি গল্পে যুদ্ধের ভয়াবহতার মধ্যেও স্বাভাবিক প্রেম ও কামের জয় অক্ষুণœ রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী কালপর্বের নিখুঁত বর্ণনা উঠে এসেছে শহীদুল জহিরের ‘কাঁটা’ গল্পে। গল্পের অনুপঙ্খ বর্ণনায় লেখকের রয়েছে মুন্সিয়ানা। স্বপ্ন ও বাস্তবতার মাধ্যমে তার এ কাহিনী এগিয়ে চলে। তিনি এ বর্ণনায় শৈলি হিসেবে বেছে নিয়েছেন একই সঙ্গে জাদুবাস্তবতা ও চেতনা প্রবাহ রীতি। যুদ্ধের সময় ভূতের গলির বাসিন্দারা একটি হিন্দু পরিবারকে বাঁচাতে ব্যর্থ হয়েছিল কিংবা আসলেই হয়েছিল কিনা তাদের এই ধন্ধই গল্পের মুখ্য উপজীব্য। পাক মিলিটারি এবং তাদের দোসর রাজাকার আবু বকরের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করতে আসলে তারা নিজেরাই সুবোধ ও তার স্ত্রী স্বপ্নাকে একটি কুয়োর মধ্যে ফেলে দিয়েছিল। একটি এলকার জনগণের সামষ্টিক কষ্ট একটি অভিন্ন চরিত্র নিয়ে এ গল্পে প্রকাশ পেয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গল্প লেখেননি, প্রকৃতপক্ষে এমন গল্পকার নেই। আর মুক্তিযুদ্ধের গল্পই বর্তমান গল্প লেখকদের বাংলাদেশ পূর্ববর্তীকালের লেখক থেকে আলাদা করেছে। অনেকেই লিখেছেন একাধিক গল্প কিংবা সম্পূর্ণ গল্পগ্রন্থ। মুক্তিযুদ্ধের গল্প নিয়ে হয়েছে একাধিক গল্প সংকলন। এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রতিটি গল্পে রয়েছে আলাদা রূপ ও মাত্রা। তবু এই সংক্ষিপ্ত আলোচনায় কিছু গল্প এবং গল্পকারের কথা না বললে পুরোপুরি অসম্পূর্ণতার অপরাধ থেকে যায়। এর মধ্যে আবু রুশদের ‘খালাস’, সুচরিত চৌধুরীর ‘সে দিন রাত শান্ত ছিল’, আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরীর ‘রোদের অন্ধকারে বৃষ্টি’, আবু বকর সিদ্দিকের ‘জাল যোদ্ধা’, শহীদ আখন্দের ‘ছিন্নভিন্ন ভালোবাসা’, রাবেয়া খাতুনের ‘যেদিকে তাকাই কেবলি কালো’, শওকত আলীর ‘পুনর্বার বেওনেট’, বশীর আল হেলালের ‘শবের নিচে সোনা’, বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের ‘আমার আল্লারে’, হাসান আজিজুল হকের ‘ভূষণের একদিন’, হাসনাত আব্দুল হাইয়ের ‘একাত্তরের মোপাঁসা’, জ্যোতি প্রকাশ দত্তের ‘দিন ফুরানোর খেলা’, রিজিয়া রহমানের ‘একজন মুক্তিযোদ্ধার জন্ম’, মাহবুব তালুকদারের ‘শরণার্থী’, রশীদ হায়দারের ‘আপনজন’, বিপ্রদাস বড়–য়ার ‘বাবার স্বপ্ন ও একজন রাজকন্যা’, আব্দুল মান্নান সৈয়দের ‘ব্ল্যাক আউট’, সুব্রত বড়–য়ার ‘নির্বাসনে একজন’, সেলিনা হোসেনের ‘আমিনা ও মদিনার গল্প’, রবিউল হুসাইনের ‘পাথরের ফুল’, বুলবুল চৌধুরীর ‘নদী জানে’, কায়েস আহমদের ‘নচিকেতাগণ’, শাকের চৌধুরীর ‘সংশয়ের ঘর’, জুলফিকার মতিনের ‘খোঁজা’, শাহরিয়ার কবিরের ‘একাত্তরের যিশু’, সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলামের ‘গ্লানি’, অসীম সাহার ‘ভ্রণ’, আফসান চৌধুরীর ‘ধর’, সুশান্ত মজুমদারের ‘রাজা আসেনি বাদ্য বাজাও’, মঞ্জু সরকারের ‘রাজাকারের ভূত’, মুহম্মদ জাফর ইকবালের ‘নূরুল এবং তার নোট বুক’, আবু সাঈদ জুবেরীর ‘নিরপেক্ষ জীবন’, ভাস্কর চৌধুরীর ‘গন্তব্য কোথায়’, শাহীন আখতারের ‘আরো এমন রাত ছিল’, নাসরীন জাহানের ‘বিশ্বাস খুনি’, শাহাদুজ্জামানের ‘অগল্প’, সেলিম মোরশেদের ‘বিপক্ষে ব্রজন’, পারভেজ হোসেনের ‘স্তব্ধতার অনুবাদ’, মশিউল আলমের ‘অযোদ্ধা’, হামিদ কায়সারের ‘এক বোন চন্দ্রভানু’সহ রয়েছে অসংখ্য ছোটগল্প। মুক্তিযুদ্ধের গল্প নামে কোনো কোনো লেখকের আলাদা গল্পের বই রয়েছে। লেখিকা সংঘ থেকে কেবল মহিলাদের লেখা মুক্তিযুদ্ধের গল্প নিয়ে একটি গল্প সংকলন প্রকাশিত হয়েছে। আবুল হাসনাত এবং হারুন হাবীবসহ অনেকেই করেছেন মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন লেখকের ছোটগল্প সংকলন। এসব সংকলনের বাইরেও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে অসংখ্য মুক্তিযুদ্ধের গল্প। বরং এমন সব গল্প হারিয়ে যেতে বসেছে যা যুদ্ধের নয় মাসকালে অসংখ্য অখ্যাত গল্পকাররা মুক্তিযুদ্ধে অনুপ্রেরণা যোগাতে লিখেছিলেন। বর্তমানে ছোটগল্পের বাজার মন্দা। তবুও মুক্তিযুদ্ধের গল্প লেখা থেমে নেই। বিশেষ করে স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসে দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য সাময়িকীর খোরাক হিসেবে এবং অসংখ্য লিটলম্যাগের পরিশ্রমী লেখকদের কল্যাণে। তবু মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কালজয়ী কোন সাহিত্য রচনা হচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু প্রকৃত লেখক তো কালজয়ী লেখার জন্য থেমে থাকেন না। একজন লেখক মূলত তার নিজের লেখাটিই লিখে যান। আর জনশ্রুত যে লেখা দাবি করে তা তো কোনো একজন লেখক কোনো একদিন লিখবেন। তাহলে কিছুই হচ্ছে না বলে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার চেয়ে যা হয়েছে তার দিকে চোখ ফেরালেও দেখা যাবে নিজ ঘরে বাছা রতনের রাজি। আর প্রকৃতই এ লেখকের বিশ্বাস মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংগঠিত করতে চাইলে ছোটগল্পের কাছে ফেরা ছাড়া গত্যন্তর নেই।
মজিদ মাহমুদ
কবি ও প্রাবন্ধিক
সময় জার্নাল/ইম
Somoy Journal is new coming online based newspaper in Bangladesh. It's growing as a most reading and popular Bangladeshi and Bengali website in the world.
উপদেষ্টা সম্পাদক: প্রফেসর সৈয়দ আহসানুল আলম পারভেজ
কপিরাইট স্বত্ব ২০১৯-২০২৪ সময় জার্নাল