প্রতি বছর বাজেট আসে, পাশও হয়ে যায়।সাধারণ মানুষের কথা সুবিবেচনা না করে বাজেট পাশ হয়। কিছু জিনিসের দাম বাড়ে আবার কিছু জিনিসের দাম কমে। মনে হয় বাজেট যেন দ্রব্য’র দামবৃদ্ধির জন্যই! সিএনজি-রিকশাওয়ালা, খুচরা দোকানী সবাই দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির উৎসবে যেন মেতে ওঠে।
বাজেট পেশ তাই সাধারণ মানুষের কাছে “বোঝার উপর শাকের আঁটি”র মতো বাড়তি উপদ্রব। বাজেটের নাম শুনলেই তাই গরীব ও সম্বলহীনরা ভয় পেয়ে যান।এমন তো হবার কথা নয়।"
সব ক্ষমতাসীন সরকারই চায় একটি সর্বোত্তম বাজেট তৈরী করতে। যা হবে জনবান্ধব, উদ্যেগক্তা বান্ধব ও উন্নয়নের জন্য হবে লাগসই। কিন্তু তা কী হয়?
গত ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার জাতীয় বাজেট সংসদে পেশ করা হয়েছে। কিন্তু উদ্যেগক্তা, বেকার এবং গরিবের জন্য তা কতখানি সুখবর দিতে পেরেছে?
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ হিসাবে দেশের মাথাপিছু আয় এখন ২ হাজার ৫৫৪ ডলার, কিন্তু আজও এদেশের মেহনতী মানুষ রাস্তায় কুকুরের পাশে অথবা স্টেশনে রাত্রি যাপন করে এবং ডাস্টবিনের পাশে বসে মহানন্দে আহার গ্রহণ করে।
২০২০-২১ সালে করোনা মহামারী মোকাবেলায় সরকার যথেষ্ট সাফল্যের পরিচয় দিয়েছে। তারপরও কোন সূত্র মতে দেড় কোটি বা অন্য সূত্র মতে তিন কোটি মানুষ তাদের নিয়মিত চাকরি হারিয়েছে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশে বেকার ও প্রচ্ছন্ন বেকারের সংখ্যা প্রায় চার কোটি। ২০২২-২৩ সালের বাজেটে ভারত, নেপাল ও অন্যান্য দেশের মতো কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বাজেট বরাদ্দ দিগুন করতে হবে। পরোক্ষ কর্মসংস্থানের পাশাপাশি, প্রত্যক্ষ কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে অধিক মনোযোগ দিতে হবে।
সচরাচর যারা বাজেট প্রণয়ন করেন, তারা দাবী করে থাকেন যে, তারা অনেক ভেবে-চিন্তে জনগণের জীবনমান উন্নয়নের জন্য একটি বাজেট পেশ করেছেন। তবে সেই বাজেট কতটুকু জনকল্যাণকর হয়, তা ভেবে দেখার প্রয়োজন আছে। প্রায় ১৮ কোটি মানুষের দেশে পর্যাপ্ত সংখ্যক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা খুব সহজ ব্যপার নয়। তাই ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যেক্তা সৃষ্টিতে ঋণের প্রবাহ যথেষ্ট বৃদ্ধি করতে হবে। নিকট অতিতে ব্যাংক সমূহ ক্ষুদ্র উদ্যেক্তা ও নারী উদ্যেগক্তাদের ঋণ দিতে গরিমুষি করেছে, বলে অভিযোগ আছে।
বাজেটে নিঃসন্দেহে সরকারের অর্থনৈতিক ভাবনার, উন্নয়ন চিন্তার প্রতিফলন থাকে। তবে, তা কতদূর উদ্যেগক্তা বান্ধব, গরিব বান্ধব ও অর্থনীতির জন্য লাগসই হয় তা ভাবার বিষয়। কারণ দেশের ১৮ কোটি মানুষ তাদের কষ্টার্জিত আয় থেকেই কর দেন। তার সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের দায়িত্ব। বিশেষ করে গরীব মানুষ যারা তেল-নুন কিনতেও সরকারকে ট্যাক্স দিচ্ছেন, তাদের জীবন-যাত্রা যেন আরও সহজ হয়, তাদের মৌলিক চাহিদাগুলো যেন তারা সস্তায় পেতে পারেন তা নিশ্চিত করা দরকার। ৩০ লক্ষ শিক্ষিত বেকার সরকারি বা বেসরকারি চাকরি তে যোগদান করে অথবা উদ্যেগক্তা হয়ে নিজের ও দেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখতে পারে। তা জাতীয় বাজেটে বরাদ্দের মাধ্যমে নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
সচরাচর দেখে যায় যে, অনেক ঢাক-ঢোল পিটিয়ে জাতীয় সংসদে খসড়া বাজেট পেশ করা হয়। তখন সংসদের ভিতরে বাহিরে নানান সমালোচনা-আলোচনার ঝড় ওঠে। বাজেট পেশকারী পক্ষ দাবী করেন, “এবারের বাজেট গরীববান্ধব ও উদ্যেগক্তা বান্ধব বাজেট। এমন কল্যাণকর বাজেট অতীতে কেউ দেখেনি।” বিরোধীরা এক কথায় তা নাকচ করে বলেন, “এবাজেট গরীব মারার বাজেট। এই বাজেটে গরীব আরও গরীব হবে।” এমন তর্ক-বিতর্কের ঝড়ের মাঝে চাপা পড়ে যায় দরিদ্র ও চরম দরিদ্র অসহায় সব মানুষের চাওয়া-পাওয়ার সব হিসেব-নিকেশ! সম্ভাবনায় শিক্ষিত বেকারদের উদ্যেক্তা হবার স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে যায়।
গরীব আরও গরীব হয় এবং ধনী আরও ধনী হয়। নতুন নতুন বিলোনিয়ার তৈরী হতে থাকে।
গতানুগতিক এইসব বাজেট জনকল্যাণে ও উদ্যেক্তা তৈরিতে তেমন ভূমিকা রাখে বলে মনে হয়না।বরং চলমান নীবর শোষণের যন্ত্রটাকেই নতুন করে চালু রাখে বলে মনে হয়।
সাধারণত দেখা যায় যে, তৈরীকৃত বাজেটে বেকার, প্রচ্ছন্ন বেকার, গরীব, কৃষক, শ্রমিকদের জন্য কোন সুখবর থাকে না, দরিদ্র কর্মজীবীদের(working poor) চাহিদার কথা বারবারই উপেক্ষিতই থেকে যায়। তবে এদেশে গরিবের থেকে দরিদ্র কর্মজীবীদের অবস্থা যে খুব একটা ভালো তা বলা যায় না। এটা শুধু বাংলাদেশেই নয়, খোদ মার্কিনমুলুকে, ব্রিটেনে এবং ইউরোপের কোন কোন দেশে দরিদ্র কর্মজীবীদের অবস্থা প্রায় একই রকম।কারণ দ্রব্যমূল্য বাড়ে কিন্তু তাদের বেতন বাড়েনা। তাই তাদের আর্থিক সংকট আরও প্রকট হয়ে দেখা দেয়।
তা হলে উদ্যেক্তা বান্ধব ও একটি লাগসই গরীববান্ধব বাজেট তৈরীতে সমস্যা কোথায়?
সমস্যা আসলে বাজেট প্রণেতাদের মস্তিষ্কে।চিন্তা ধারণায় পরিবর্তন আনতে হবে।বাজেট প্রণেতাদের দূরদর্শীতা দেখাতে হবে।সমকালীন সামাজিক অর্থনৈতিক পেক্ষাপট অনুধাবনে সক্ষম হতে হবে। বাজেটের বরাদ্দ যেন সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে সে বিষয়ে সচেষ্ট থাকতে হবে সর্বোপরি গরিব বাচাঁও আর্দশের প্রতি সহানুভূতিজাত কমিটমেন্ট থাকতে হবে।
বর্তমানে মহামারী করোনার বিভিন্ন ভ্যারিযেন্ট গুলো প্রচণ্ড ঝড় তুলেছে মানবসমাজে, দেশে–দেশান্তরে। প্রতিটি দেশকে এখন নতুন করে New Economic Order তৈরী করতে হচ্ছে। চলমান অবস্থার পেক্ষাপটে তা করতে হবে বাজেটের মাধ্যমে। তাই দরিদ্র কর্মজীবী ও উদ্যেগক্তাদের কথা মাথায় রেখেই রাষ্ট্রের বাজেট তৈরী করতে হবে।
লেখক: অধ্যাপক সৈয়দ আহসানুল আলম পারভেজ
অর্থনীতিবিদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং চেয়ারম্যান, এনবিইআর।
সুষম সমাজ ও গরিব বান্ধব বাজেট বিষয়ক পুস্তকেরও লেখক অধ্যাপক সৈয়দ আহসানুল আলম পারভেজ
সময় জার্নাল/আরইউ