ডা. মোহাম্মদ জোবায়ের মিয়া :
একটি কেইস হিস্ট্রি দিয়েই শুরু করছি।
“একটি ছেলে কলেজে ২য় বষে’ এইচ এস সি পড়ছে। সামনে পরীক্ষা, উদ্বিগ্ন মা- বাবা ডাক্তারের কাছে এসে বললো, ছেলে বাথরুমে ঢুকলে আর বেরই হয়না। ওর জন্য অন্য সবার সময় নস্ট হচ্ছে। আধা ঘন্টা লাগে হাত মুখ ধোওয়ায়, গোসল করতে লাগে প্রায় এক ঘন্টা। টয়লেটে গোসলের সাবান দুই এক দিনেই শেষ হয়ে যায়। সব কিছুতেই কেমন ঢিলা ঢিলা ভাব। সব সময় অস্থিরতায় ভুগে, টেনশনে থাকে। ওর পোশাক, বিছানা পত্র, বই খাতায় ময়লা লেগে যাচ্ছে এই ভেবে ভেবে অস্থির।তার হাতের আংগুলের ফাকে ফাকে সাদা ঘা হয়ে গেছে।সে লেখাপড়ায় খারাপ করছে। কলেজে অনিয়মিত হয়ে যাচ্ছে। ওকে নিয়ে এখন কি করি ডাক্তার সাহেব!”
২য় কেইস হিস্ট্রি
টুম্পা (ছদ্মনাম) নামে একটি মেয়ে, বয়স ২৫, মফস্বলে থাকে, আমার কাছে এসে বললো, স্যার আমার মাথায় সবসময় একই চিন্তা বার বার ঘুরপাক খাচ্ছে, আমি জানি সেগুলি অহেতুক চিন্তা। আমি এগুলি ভাবতে চাইনা। কিন্ত বিরত থাকতে পারিনা। চেস্টা করি ঔ চিন্তাগুলি করবোনা। কিন্ত মাথা ব্যথা করে। আমার মাথাটা ফ্রেস করে দেন স্যার, প্লিজ! আমি জিজ্ঞেস করি, কি চিন্তা তোমার মাথায় আসে? সে বলে নবী রাসুল মিথ্যা, কোরআন মিথ্যা, এই সব চিন্তা। সে বলে, আমি ছোট বেলা থেকেই একজন মুসলমান পরিবারের ধার্মিক মেয়ে। নামাজ পড়ি, রোজা করি। আল্লাহ কে বিশ্বাস করি। কিন্ত কয়েক মাস হলো, যখনই নামাজে যাই, এগুলি মনে আসে। আমার নামাজে মনোযোগ নাই, শূরা ভুল হয়ে যায়। স্যার, আমি অনেক পাপ করে ফেলেছি।আমাকে বাঁচান! আমি যখনই কোন কাজ করতে যাই তখনই এসব মনে পড়ছে। আমি এখন সব সময় নিজেকে গুটিয়ে রাখি। মন মরা হয়ে থাকি। আমার এটা কি কোন মানসিক রোগ? আমি কি এর থেকে নিস্তার পাবো না?
এই রোগের আরো কিছু বিরক্তিকর এবং কস্টকর উপসরগের কথা রোগীদের কাছে শোনা যায় যেমন, কারো কারো বাইরে বের হলে বাসায় এসে গোসল করতেই হবে এবং কাপড় পাল্টাতে হবেই। যত বারই বাইরে যাওয়া হবে ততোবারই গোসল করতে হবে। কেউ কেউ বিশেষ কিছু প্রাণী যেমন কুকুর যদি পাশে দিয়ে হেটে যায়। গায়ে ছোঁয়া না লাগলেও তাকে গোসল করতে হবে। স্বামী-স্ত্রী সহবাসেও তারা বিরত থাকেন। তাদের নোংরা লেগে যাবে এই ভয়ে। অনেক মা আছেন যারা নিজের সন্তান কে অন্য কেউ কোলে নিলেও গোসল করান বার বার। কেউ কেউ বার বার ঘরের ছিটকিনি/ লক চেক করেন। ঘুমোতে গিয়ে বার বার উঠে যান। দরজা ঠিক মতো লাগানো হয়েছে কিনা বার বার নিশ্চিত হন। তবুও শান্তি মিলেনা। অনেকে তার গোছানো টেবিল, বিছানা, ঘরের আসবাব কেউ একটু এলোমেলো করলে ভীষণ বিরক্ত হয়ে পড়েন। কলমদানীটি তার মতো করেই রাখতে হবে, একটুও নড় চড় করা যাবেনা। অনেকে আছেন বার বার টাকা গুনেন। ভুল হলো কিনা এই ভেবে ৫/৭ বার চেক করেন। কেশিয়ার সাহেব দের অবশ্য এই গুণ থাকাটা ভালো। কিন্ত রোগ বলবো আমরা তখনই যা তার এবং তার আশেপাশের লোকজনের কস্টের কারন হয়ে দাঁড়ায়। ব্যাপারটা অমূলক বুঝেও যখন বিরত থাকতে পারেনা। এই সমস্যা গুলির কারনে যদি তার ব্যক্তিগত, পারিবারিক এবং কম'ক্ষেত্রে ব্যাপক বিঘ্নতার সৃস্টি হয়।
কাদের হয়? কেন হয়? সমাধান কি?
সাধারনত টিন এজ গ্রুপ থেকেই এই রোগের প্রকোপ বেশী দেখা যায়। তবে যেকোন বয়সেই শুরু হতে পারে। ছেলে-মেয়ে সমানভাবেই আক্রান্ত হয়।
এটি একটি মাইনর মেন্টাল ডিসঅর্ডার। কিন্ত ভোগান্তি কম নয়।
সকল মানসিক রোগের মতই বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে এই রোগের সঠিক কারন এখনো জানা যায়নি। তবে জেনেটিক, বায়োলজিক্যাল এবং এনভাইরনমেন্টাল কিছু কিছু কারনেও এই রোগ হতে পারে বলে ধারনা করা হয়।
চিকিৎসা সাধারনত দুই ধরনের: :
১. সাইকোলজিক্যাল
২. ফার্মাকোলজিক্যাল
দুইধরনের চিকিৎসা একসাথে প্রয়োগ করলে ভালো ফল পাওয়া যায়।
সাইকোলজিক্যাল চিকিৎসার মধ্যে কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি খুব উপকারী। এখানে রোগীর ভুল চিন্তাগুলির উপর কাজ করা হয়। বিশেষ করে নিগেটিভ থট, কোর বিলিভ এগুলির পূন:গ’ঠন করার চেস্টা করা হয়।
রেসপন্স প্রিভেনশন: এটির মাধ্যমে রোগী কিভাবে একই কাজ বার বার করা থেকে বিরত থাকবে এই টেকনিক প্রাক্টিস করানো হয়।
থট স্টপিং: একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে নেতিবাচক চিন্তাকে সাময়িক বন্ধ করার চেস্টা করা হয়। কোন ব্যক্তিকে হাতে একটি রাবার বেন্ড বেধে রাখতে বলা হয়। যখন তার অমূলক চিন্তাগুলি আসবে তখন সে বেন্ডটি টান দিবে। একটু ব্যথা পেলে মনোযোগ টা অন্য দিকে সরে যাবে।
থট চ্যালেঞ্জ: এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কল্পনায় নেতিবাচক চিন্তাগুলি আহবান করে চ্যালেঞ্জ করা হয়।
আরো একটি প্রয়োজনীয় পদ্ধতি হলো রিলাক্সেশন থেরাপি। খুব কম পরিশ্রমেই আমরা ব্রেদিং এক্সারসাইজ করতে পারি। যখনি সময় পাবেন তখনি ১০ বার করে ধীরে ধীরে লমবা শ্বাস নিন একটু ধরে রাখুন এবং ধীরে ধীরে ছাড়ুন। আপনার দেহ- মনে প্রশান্তি আসবে। নেতীবাচক চিন্তাও দূর হবে।
প্রতিদিন আধাঘন্টা জোরে হাটুন। অনেক রোগ প্রতিরোধ হবে।
এবার আসি, ফারমাকোথেরাপী বা মেডিসিন দিয়ে চিকিৎসা।
প্রবাদ আছে কথায় চিড়া ভিজেনা। তাই রোগীরা কিছু মেডিসিন প্রত্যাশা করে। বাস্তবিক ভাবেই কিছু এন্টি ডিপ্রেসেন্ট সূচীবায়ুরোগীদের খুব কাজে আসে। ও সি ডি রোগীদের একই সাথে এংজাইটি ডিসঅর্ডার এবং ডিপ্রেসিভ ডিসওরডার থাকতে পারে।
বিশেষ করে ফ্লোক্সেটিন, সারট্রালিন, সিটালোপ্রাম, এস সিটালোপ্রাম, ফ্লোভোক্সেমিন অত্যন্ত কার্যকর ঔসধ। ক্লোমিপ্রামিন, ইমিপ্রামিন একসময় বেশ জনপ্রিয় ছিল।
রোগীদের একটি জিজ্ঞাসা, এই রোগ কি ভালো হয়?
উত্তর হলো যদি কমপক্ষে ৬ মাস সঠিক নিয়মে চিকিতসা করা যায়, তবে অনেকে একেবারেই ভালো হয়। কারো কারো বহুদিন পর রোগটি ফিরে আসতে পারে। কেউ কেউ বারবার আক্রান্ত হয় এবং তাদের চিকিতসা নিয়েই স্বাভাবিক থাকতে হবে। এই রোগীদের কিছু আচরন দেখে অনেকেই তাদের উন্মাদ ভাবে। এটি একটি বড় অন্যায় কাজ। তাই আসুন ওসিডি সম্পকে জানি এবং সঠিক চিকিৎসা গ্রহন করি।
ডা. মোহাম্মদ জোবায়ের মিয়া
সহকারী অধ্যাপক (সাইকিয়াট্রি)
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ, ঢাকা।
১৪.০২.২০২২