জগেশ রয়
রাশিয়া ও ইউক্রেনর সংকট জানতে হলে একটু পিছনে ফিরতে হবে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে পূুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রের অস্থিত্ব টিকিয়ে রাখতে যুক্তরাষ্ট্র ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন তৎপর হয়ে উঠে। উভয় পক্ষের অস্তিত্ব যখন সংকটে পড়ে তখন আবার দুই পক্ষ এক হয়ে যায়। যখন জার্মানি নেতা হিটলার নিজের দেশের অস্তিত্ব লড়াইয়ের সংকট থেকে উদ্ধারের জন্য যুদ্ধ শুরু করেন তথন যুক্তরাষ্ট্র ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন এক হয়ে জার্মানি ও তার মিত্রদের বিরুদ্ধে লড়াই করে। সেই যুদ্ধে জার্মানিসহ সমর্থক দেশসমূহ পরাজিত হলে চল্লিশের দশকে স্নায়ুযুদ্ধ প্রবল আকার ধারণ করতে থাকে। উভয় পক্ষ সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করতে থাকে।
সাম্প্রতিক সময়ে ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধ অভিযানের কেন্দ্রে রয়েছে নিরাপত্তা জোট ন্যাটো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ১৯৪৯ সালে যুক্তরাষ্ট্র মিত্রদের নিয়ে সামরিক শক্তি জোট ন্যাটো (উত্তর আটলান্টিক নিরাপত্তা জোট) প্রতিষ্ঠিত করে ।
অপর দিকে ওয়ার'শ স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালীন কেন্দ্রীয় ও পূর্ব ইউরোপের আটটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র নিয়ে ১৯৫৫ সালে গঠিত সম্মিলিত প্রতিরক্ষা চুক্তি। ওয়ার'শ চুক্তিটি ন্যাটোর ক্ষমতার ভারসাম্য হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সে্ই সময় ন্যাটোর মূল উদ্দেশ্য ছিল তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের (ইউএসএসআর) আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের মিত্ররা বৃহত্তর রাজনৈতিক সহযোগিতার মাধ্যমে যেকোনো ধরনের সংঘর্ষ এড়াতে ন্যাটোকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছিল। তবে ন্যাটো এবং ওয়ার'শ এর মধ্যে সরাসরি কোন সামরিক দ্বন্দ্ব হয়নি, কিন্তু একে ওপরের বিরুদ্ধে প্রক্সি যুদ্ধে লিপ্ত ছিল।
১৯৯২ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙ্গনের ফলে ১৫টি রাষ্ট্র গঠিত হয়। এই ভাঙনকে রাশিয়ার জন্য একটি ভূ-রাজনৈতিক বিপর্যয় ঘটে। পরবর্তীতে ১৯৯৯ সালে তিনটি প্রাক্তন সোভিয়েত মিত্রকে ন্যাটো সদস্যপদ দেয়। দেশগুলো হলো চেক প্রজাতন্ত্র, হাঙ্গেরি এবং পোল্যান্ড। সোভিয়েত সামরিক জোট ওয়ারশো প্যাক্টের সাথে যু্ক্ত বুলগেরিয়া, রোমানিয়া, স্লোভাকিয়া এবং স্লোভেনিয়াও ন্যাটোতে যোগ দেয় ২০০৪ সালে।
একই সময়ে, বলটিক সাগর উপকূলের তিনটি প্রাক্তন সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র, এস্তোনিয়া, লাতভিয়া এবং লিথুয়েনিয়াও ন্যাটো সদস্যপদ লাভ করে। বলটিক প্রজাতন্ত্রগুলোকে নেটোর সদস্যপদ দেওয়াটা রাশিয়াকে সবচেয়ে বেশি আতঙ্কিত করে। এই তিনটি দেশ এক সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ ছিল এবং মস্কো তাদের ‘নিকট বিদেশ’ হিসেবে গণ্য করে।
ইউক্রেনের জনসংখ্যার একটা বড় অংশ রুশভাষী। রাশিয়ার সঙ্গে তাদের সাংস্কৃতিক-সামাজিক ঘনিষ্ঠতা আছে। ইউক্রেনে সবসময় দুটি পক্ষ প্রভাব বিস্তার করে থাকেন। একটি পশ্চিম ইউরোপ পন্থী ও আরেকটি রুশপন্থী। ইউরোপীয় পন্থীরা পশ্চিম ইউরোপের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে চায়। তারা সামরিক জোট ন্যাটোর সদস্য হতে আগ্রহী। অপর ধারাটি রুশপন্থী। তারা রাশিয়ার বলয়ে থাকতে চায়।
বর্তমান ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি পশ্চিম ইউরোপপন্থী হওয়ার গুঞ্জন উঠেছিল, ইউক্রেন ন্যাটোতে যোগ দিচ্ছেন। এর প্রতিক্রিয়ায় রাশিয়া বলেছিল, তাদের প্রতিবেশী ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্যতম শরিক ইউক্রেন কখনোই ন্যাটোতে যোগ দিতে পারবে না। অর্থাৎ, ইউক্রেনের এই জোটে যোগদানের ওপর চিরস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে হবে এমনটাই বলেছিল রাশিয়া। রাশিয়া ন্যাটোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছিল, পূর্ব ইউরোপের সব ধরনের সামরিক সম্প্রসারণ কার্যক্রম বন্ধ রাখতে। বস্তুত, ন্যাটো পুরো অঞ্চলের নিরাপত্তাকে ঝুঁকির মুখে ফেলেছে বলে দাবি করছে রাশিয়া।
তবে ইউরোপের পরাশক্তিরা রাশিয়ার এসব দাবি মেনে নিতে প্রস্তুত নয়। তারা যুক্তি দেন, রাশিয়া, ইউক্রেনের পররাষ্ট্র নীতির সিদ্ধান্তে নাক গলাতে পারে না। তারা ন্যাটোর 'খোলা দরজা নীতির' কথা উল্লেখ করে জানান, যেকোনো ইউরোপীয় রাষ্ট্র ন্যাটোর সদস্যপদ চাইতে পারে।
ন্যাটোর প্রভাব যতই রাশিয়ার সীমান্তের কাছাকাছি এসে পৌছেছে, ততই রাশিয়া অস্থিত্ব সংকটে পড়েছেন। ন্যাটোর প্রভাবমুক্ত রাখতেই ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরু করে রাশিয়া। নিজের অস্তিত্ব জানান দিতেই রাশিয়ার এই যুদ্ধ অভিযান ।
এদিকে ইউক্রেন কোন পক্ষেই শক্ত অবস্থান না নিয়ে রাশিয়া এই সুযোগ লুফে নিয়েছে। তাই তারা ইউক্রেনে অভিযান চালায়। যেহেতু ইউক্রেন ন্যাটতে যোগ দেয়নি সেক্ষেত্রে আমেরিকাসহ প্রভাবশালী রাষ্ট্র নেতারা প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধে সহায়তা করছে না। বর্তমানে এই কঠিন সময়ে কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি ইউক্রেন?
লেখক: জগেশ রয়
সাবেক সাধারণ সম্পাদক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় প্রেসক্লাব
সময় জার্নাল/আরইউ