রহিমা আক্তার মৌ
আজ আমার অবসরের ১৩ তম দিন(টেস্ট করার হিসাবে)। ১৮ মার্চ দুপুরের পর থেকে এই রুম এই বিছানা আমার সাথী। ১২/১৪ ফিটের রুমে ৬/৭ ফিট সেগুন কাঠের খাট, দুইটা ওয়াড়্রব একটা ড্রেসিংটেবিল, একটা পেলাসটিকের চেয়ার, একটা স্ট্রেন ফ্যান। মাথার উপরে দুই ফ্যান থাকলেও চলে না, এসি থাকলেও তা চলেনা (প্রায় ১১ মাস থেকে এই রুমে বিদ্যুৎ নেই। পাশের রুম থেকে লাইন এনে একটা লাইট ও নতুন কেনা স্ট্রেন ফ্যানটা চালানো হয়।
বালিশে মাথা রাখা অবস্থায় চোখ খুললেই আমাদের টিভিটা দেখতে পাই। তাই মাঝে মাঝে এইরুম থেকেই টিভি দেখি। ঘড়িতে কয়টা বাজে জানিনা, চোখ খুলে দেখি টিভি চলে। বুঝলাম কেউ উঠেছে। বাসায় আমি ছাড়া আর দুজন(আহসান আর অভ্র) আজকে। ২৫ মার্চ রাতে আহসান গ্রামের বাড়ি যায়, গতকাল ৩০ মার্চ রাতে ফিরে।
আমি এপাশওপাশ হচ্ছি, কিন্তু কাউকে দেখিনা। আবার চোখ বন্ধ, কারণ আমার উঠেও কোন লাভ নেই। ফজরের আজানের সময় উঠে নামাজ পড়ে শুয়েছি। মাথাটা কয়েক ইঞ্চি উপরে তুলে টিভির চ্যানেল দেখি। চ্যানেল দেখলেই বুঝবো টিভির সামনে কে? আহসান হলে সংবাদের চ্যানেল বা ইউটিউব দেয়া থাকবে। অন্য চ্যানেল হলে অভ্র। আসলেই তাই অভ্র উঠেছে। অভ্রর মোবাইল এর রিংটোন পেলাম, বুঝলাম ফুডপান্ডা সকালের নাস্তা নিয়ে এসেছে। রাতেই রৌদ্রকে বলা আছে, ও সকালে নাস্তার ওর্ডার করবে, সাথে অভ্র'র নাম্বার দেয়া হবে। (অভ্র'র আলাদা মোবাইল দিই নি, বাসায় রাখার একটা নাম্বার আছে নরমাল টিপেটিপে চালানোর, সেটাই অভ্র'র কাছে থাকে। অবশ্য ও অনলাইন ক্লাস করে ল্যপটপে। ফেইসবুক চালায় আমাদের মা মেয়ের যৌথ আইডিতে।)
উঠে মুখ হাত ধুয়ে অভ্রকে ডাক দিলাম,
-- নাস্তা এসেছে।
-- হ্যাঁ।
-- তোর আব্বু উঠেছে।
-- হ্যাঁ উঠেছে।
রুমে আর বারান্দায় কয়েক পা হাঁটলাম। বিছানায় আসলাম অল্প ব্যায়াম করতে। আহসান টেবিলে এসে নাস্তা খেল, অফিস চলে গেলো। আমি ব্যায়াম শেষ করে লিখতে বসেছি এই লেখা। নাস্তা পরে খাব, ঘরের দরজায় যে ছোট টেবিল রাখা সেখানে আমার নাস্তা(রুটি, ডাল+ভাজি, আর ডিম) রেখে দিয়েছে অভ্র।
আমি খুবই ঘুম প্রিয় মানুষ ছিলাম, ঠিক কতটা ঘুমারু ছিলাম তা আমার বাবার বাড়ির সবাই জানে। বিশেষ করে আমার বড় বোন নাজমা আপা। ছিলাম বলছি এই কারণে যে এখন নেই। পড়তে বসে চেয়ারে মাথা দিয়ে হা করে কত যে ঘুমিয়েছি তা নাজমা আপা ছাড়া কেউ জানেনা। কতদিন যে আমার মুখে পানি বা লবন দিয়েছে সেই হিসাব নেই। ১৯৮৯ সালে আপা এসএসসি দিয়ে ঢাকায় আসে, আসার সময় আমার ঘুমও নিয়ে যায়। ১৯৯১ সালে এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে আমিও স্বপ্নের শহর ঢাকায় চলে আসি।
১৯৯৪ সালে ১৮ বছর বয়সে বিয়ে আর ২০ বছর বয়সে মা হওয়া। বিয়ের চার মাস পরে সংসার শুরু হয় সাভারে, আহসানের অফিস ঢাকায়। তখন আহসান জার্মানের একটা ফার্মে জব করতো। বিয়ের ২মাস পর সরকারি চাকরীর পরীক্ষা দেয়। যে মাসে সংসার শুরু করি সে মাসেই সরকারি চাকরি হয়। অনেকে (অফিসের লোকেরা, বন্ধু বান্ধবরা) বলেছে, বউ এর ভাগ্যে সরকারি চাকরি। অবশ্য আহসান বা পরিবারের কেউ আমার সামনে এসব বলেনি, অন্যরা বলেছে। ১৯৯৪ সালের জুন মাস, নতুন চাকরি আহসানের বেতন সব মিলিয়ে মাত্র ২৩০০/ টাকা। তখন আমাদের বাসা ভাড়া ১৭০০/। শুরু হয় আহসানের পার্টটাইম জব। সরকারি অফিসের পর ২/৩ ঘন্টা। ছুটির দিনে ১০- ৫ টা। দেবর আমাদের কাছে থাকতো। সেই সংসার শুরুর সাথে সাথে আমার ঘুম থেকে উঠার সময় বা নিয়ম বদলে যায়। নিজের ইচ্ছে মতো কোনদিন ঘুম থেকে উঠতে পারিনি। অফিস যাবে তার ঘন্টা আগে আমাকে উঠতে হতো। দেবর স্কুলে যাবে তার আগে আমাকে উঠতে হতো। শুরু হলো অন্যদের প্রয়োজনেই আমার ঘুম থেকে উঠা।
সন্তান হলো, রাত জেগে আমিই পাহারা দিই। ঘুমাই আর সকালের উঠা নির্ভর করে আমাদের বাসার কে কখন বাইরে যাবে তার উপরে। সাভার ছেড়ে ঢাকায় এলাম ১৯৯৮ সালে। কেউ বাড়ী যাবে বাস ধরবে, তাকে নাস্তা দিতে সেই ঘন্টা আগে আমার উঠা। ছোট একটা মেয়ে থাকতো তখন যার উপরে নাস্তার দায়িত্ব দেয়া সম্ভব নয়, আর আমিও দিতাম না। রৌদ্রের স্কুল শুরু, অভ্র হলো। ওরা একই স্কুলে পড়েছে। সকাল ৭'১৫ মিনিটে বের হতে হতো। রিকসা না পেলে হেঁটে যেন আসতে পারি। আমাকে ঘুম থেকে উঠতে হতো ৬ টায়। ঘুম ভাঙলে আর ঘুম ধরেনা বলে ৬ টায় উঠে ফজরের নামাজ পড়ে, নাস্তা রেডি করে ওদের খাইয়ে দিয়ে স্কুলে বের হতাম। স্কুলে দিয়ে এসে আহসানের নাস্তা। সে ৮টায় বের হতো। ৮'১৫ অভ্র'র স্কুল, আমি আবার বের হতাম ওকে নিয়ে। আহসানের অফিসের পথেই অভ্র'র স্কুল। কিন্তু সে নিয়ে আসবে না।
সংসারের ২৭ বছর ঠিক একই ভাবে যাচ্ছিলো। এইবাসায় আছি ২০১০ থেকে। এখানে গ্যাসের সমস্যা অনেক। মাঝ রাতে উঠে রান্না করেছি, ভোরে উঠে রান্না করেছি। রাত জেগে ছিলাম রান্নার জন্যে। ছুটির দিনে ফজরের সময় উঠতাম, কারণ ৬ টায় উঠা লাগবেনা। ছুটির দিনে আহসানের কাজ থাকে বেশি, সে ভাবে আমিও ঘুম থেকে উঠি। আহসানের কাজ না থাকলে ১০/১১/১২ টায় উঠে। নাস্তা খেয়ে আবার ঘুম। দুপুরে খেয়ে আবার ঘুম। কিন্তু আমি আর দিনের বেলায় ঘুমাতে পারিনা।
মাসে ১/২ দিন আয়োজন করে নিতাম ঘুমাতে। মানে দুপুরের খাবার খাইয়ে বিকেলের নাস্তা রেডি করে অভ্রকে বলে ঘুমাতাম। কারণ আমার অবর্তমানে সংসারের যা দায়িত্ব তা অভ্র করবে। রৌদ্র একটু উদাসীন আর অলস বলে তাকে দিয়ে হতো না। দেখা যেত আমি ঘুমালাম পেছনে সেও ঘুম।
২০২০ সালে করোনার জন্যে লকডাউন শুরু, অফিস স্কুল বন্ধ। একটু দেরিতে উঠা হতো, কিন্তু ওই যে গ্যাস তার জন্যে ভোরে উঠতে হতো। নইলে রাত জেগে রান্না করে ঘুমাতাম। কিন্তু যেই সকালে উঠবে আমাকে উঠতেই হতো নাস্তা দিতে। আর মাসে একদিন আয়োজন করে ঘুমানো। মনে হত ঘুম জমা হতে হতে আমি ক্লান্ত, একদিন দিনে ঘুমালে ফ্রেস হয়ে যেতাম।
স্কুল শুরু না হলেও অফিস শুরু হল। ফজরের নামাজ ঠিক সময়ে পড়তে পারছি, পড়ে আবার ঘুম। ৭'৩০ মিনিটে উঠি, নাস্তা রেডি করি। আহসান খেয়ে ৮'৩০ অফিস যায়। ডিসেম্বর ২০২০ থেকে আহসানকে নিয়ে হাসপাতাল। ফেব্রুয়ারি থেকে বোনকে নিয়ে। দিনের ঘুম আমার হারাম হয়ে গেল। হাসপাতাল থেকে বোনকে নিজের বাসায় আনলাম। ৭ মার্চ বোনকে নিয়ে গেলাম ডায়ালসিস করতে। মা এলেন সাভার থেকে, হাসপাতাল বসে মা কে বলি,
-- আজ রবিবার তো এখানে। কাল কিছু বাজার করবো, পরশু দুপুরে মানে মঙ্গলবারে ঘুমাবো। আপনি তো বাসায় আছেন, আপার দিক নজর দিবেন।
ডায়ালসিস শেষ না হতেই বোনকে ইমার্জেন্সিতে। দ্রুত ভর্তি করাই। রাত ১ টা পর্যন্ত অক্সিজেন দিতে হয়। কেবিন পাইনি বলে বোনের সাথে আমিই, কারণ মহিলা ওয়ার্ডে পুরুষ থাকা যাবে না। ৮ মার্চ ভাইয়া (বোনের বর) আসে কিন্তু কেবিন না পাওয়ায় আমিই বোনের সাথে। ১০ মার্চ রাতে কেবিন পাই। ১১ মার্চ বাসায় আসি। প্রতিদিন সকালে যাই হাসপাতালে সন্ধ্যায় আসি। রাতে কিছু রান্না আর সকালে রান্না করে আবার হাসপাতাল। ১৬ মার্চ যাইনি, শরীরটা ভালো না, আর চলতে চায়না। ভাইয়ের ড্রাইভার কে দিয়ে খাবার পাঠালাম, দুপুরে ঘুমালাম। ১৭ মার্চ অভ্রকে নিয়ে গেলাম, শরীর আরো কিছুটা খারাপ। রাতেই জ্বর সাথে গলা ব্যাথা আর করোনার সব উপসর্গ। ১৮ তারিখ নিজে একাই গেলাম সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে। কোন কাজ হলনা। ১৮ তারিখ দুপুরে রুমে প্রবেশ। রাতে সেম্পল নিতে আসে লোক। আমি তো আমাকে চিনি, আমি ৯৯% শিওর হয়ে যাই যে আমার গৃহবন্দীর সময় এসেছে।
করোনা রোগীকে অনেক ঘুমাতে হয়, কিন্তু এই সময় ঘুম কম হয়। ঘুমের ওষুধ দেয়নি আমায় ডাক্তার। এখন আমার অনেক সময় অনেক সময় ঘুমানোর, কিন্তু ঘুম নেই চোখে। বারান্দায় গিয়ে বসি, ভি আই পি রাস্তা দেখি গাছের ফাঁকেফাঁকে। রুম থেকে বারান্দা বারান্দা থেকে রুম হাঁটি। বোবা মানুষের মতো রুমে বসে টিভি দেখি। মোবাইল নষ্ট, ট্যাবে কোন রকম লিখি, ফেইসবুক চালাই, আজান দিলে নামাজে দাঁড়াই। টেবিলে খাবার দিলে খাই। ইচ্ছে করলে দিনে রাতে ২৪ ঘন্টার মাঝে ১৮/২০ ঘন্টা ঘুমাতে পারি কিন্তু আমার চোখে ঘুম নেই। সারাদিন পর রাত ১২ টায় ক্লান্ত শরীর ঘুমিয়ে যায়। ৫ টায় উঠি, আবার ঘুমাতে চেষ্টা করি।
লেখক :
রহিমা আক্তার মৌ
লেখকঃ সাহিত্যিক কলামিস্ট প্রাবন্ধিক।