বৃহস্পতিবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪

সেই শিশু আজ জগৎ জোড়া

শনিবার, মার্চ ১৯, ২০২২
সেই শিশু আজ জগৎ জোড়া

অসীম কুমার সরকার:

বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা তাঁর ‘শেখ মুজিব আমার পিতা’ প্রবন্ধে লিখেছেন,- “আমার আব্বার নানা শেখ আবদুল মজিদ, আমার আব্বার আকিকার সময় নাম রাখেন শেখ মুজিবুর রহমান। আমার দাদির দুই কন্যা সন্তানের পর প্রথম পুত্র সন্তান আমার আব্বা, আর তাই আমার দাদির বাবা তার সমস্থ সম্পত্তি দাদিকে দান করেন এবং নাম রাখার সময় বলে যান, মা সায়েরা, তোর ছেলের নাম এমন রাখলাম যে নাম জগৎ জোড়া খ্যাত হবে।” [সূত্রঃ শেখ মুজিব আমার পিতা]। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নানার নাম রাখা স্বার্থক হয়েছে। যে নাম আজ কোটি মানুষের মুখে মুখে। যে নাম আজ ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা। যে নাম মানেই ৭ই মার্চের উত্তাল লাখো জনতা, যে নাম মানেই স্বাধীনতা, যে নাম মানেই তোমার আমার সোনার বাংলাদেশ। 

হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, স্বাধীনতা সংগ্রামের মহানায়ক, বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ রাত আটটায় তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অন্তর্ভুক্ত ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহাকুমার (বর্তমান গোপালগঞ্জ জেলা) পাটগাতি ইউনিয়নের বাইগার নদী তীরবর্তী টুঙ্গিপাড়া গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে শেখ বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি এক সম্ভ্রান্ত উচ্চ বংশীয় ঐতিহ্যের ধারক ছিলেন। আর এই উচ্চ বংশীয় ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় তাঁর মাঝে আশৈশব ধর্মীয় মূল্যবোধ ও মানবিক চেতনা বোধের উম্মেষ ঘটেছিল। তবে ‘শেখ’ পদবিতে যারা পরিচিত তার পিছনে রয়েছে অনবদ্য তাৎপর্যময়তা। ইসলামের মহান পয়গম্বর ও মানবতার পরম বন্ধু মহানবি হজরত মোহাম্মদ (সা.) ধর্ম প্রচার করতে গিয়ে তিনি যাদের সরাসরি মুসলিম করেছেন, ইতিহাসে তাঁরা ‘শেখ’ অভিধায় ভূষিত।

ইতিহাস ঘেটে জানা যায়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পূর্ব পুরুষেরা ছিলেন ব্যবলনীয সভ্যতার লীলাভূমি ইরাক থেকে আগত দরবেশ শেখ আউয়ালের বংশধর। প্রায় সাড়ে পাঁচশ বছর আগে খ্রিস্টীয় পঞ্চদশ শতকে আনুমানিক ১৪৬৩ খ্রিস্টাব্দের দিকে বিশ্বখ্যাত হজরত বায়েজিদ বোস্তামী (রাহ.) এর সফর সঙ্গী হিসেবে দরবেশ শেখ আউয়াল এই উপমহাদেশে পবিত্র ইসলাম ধর্ম প্রচারের লক্ষ্যে সমুদ্র পথে জাহাজে করে বারো আউলিয়ার পূণ্যভূমি নামে খ্যাত দেশ চট্টগ্রামে এসে আস্তানা গেড়েছিলেন। দরবেশ শেখ আউয়াল ছিলেন হজরত বায়েজিদ বোস্তামীর ঘনিষ্ঠদের মধ্যে অন্যতম। অলিকুল শিরোমণি বায়েজিদ বোস্তামী (রাহ.) একদিন তাঁকে নির্দেশ দেন, তিনি যেন মেঘনা পাড়ের এলাকায় গিয়ে সেখানকার আদিবাসীদের মাঝে ইসলামের শান্তির বাণী প্রচার করেন। গুরুর আদেশ মেনে শেখ আউয়াল চলে আসেন মেঘনা বিধৌত সোনারগাঁও-এ।

সেখানে স্থানীয় এক বাঙালি কন্যাকে বিয়ে করেন। সেই সুবাদে দরবেশ শেখ আউয়ালের পরবর্তীকালে তাঁরই সন্তান শেখ জহির উদ্দিনও বসবাস করেন এ অঞ্চলে। তবে শেখ জহির উদ্দিনের ছেলে শেখ জান মাহমুদ ওরফে তেড়কি শেখ এ এলাকায় বেশ কিছু দিন বসবাসের পর এক সময় ব্যবসার উদ্দ্যেগে খুলনায় পাড়ি জমান। এরপর তেড়কি শেখের ছেলে শেখ বোরহান উদ্দিন তার এক বন্ধুর কাছ থেকে জানতে পারেন মধুমতি ও ঘাঘোর নদীর মাঝখানে জেগে ওঠা টুঙ্গিপাড়া গ্রামের কথা। পরবর্তীতে তিনি একদিন রূপসা নদী পাড়ি দিয়ে বন্ধুর সাথে চলে আসেন টুঙ্গিপাড়ায় এবং এখানেই তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে আজীবনের জন্য স্থায়ী নিবাস গড়ে তোলেন। আর এভাবেই ঐতিহাসিক টুঙ্গিপাড়ার মাটিতে শেখ পরিবারের গোড়াপত্তন ঘটে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দরবেশ শেখ আউয়ালেরই সপ্তম অধস্তন বংশধর।

বোরহান উদ্দিনের ছিল তিন পুত্র। তারা হলেন- শেখ একরামউল্লা, শেখ তাজ মোহাম্মদ ও শেখ কুদরতউল্লাহ। শেখ একরামউল্লার ছিল দুই সন্তান: শেখ মোহাম্মদ জাকির ও শেখ ওয়াসিম উদ্দিন। আবার শেখ একরামউল্লার জেষ্ঠ পুত্র শেখ মোহাম্মদ জাকিরের ছিল তিন সন্তান: শেখ আব্দুল মজিদ, শেখ আব্দুর রশিদ এবং শেখ আব্দুল হামিদ। আর এই শেখ আব্দুল হামিদ ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আপন দাদা। শেখ আব্দুল হামিদের ছিল তিন পুত্র। তারা হলেন- শেখ লুৎফর রহমান, শেখ শফিউর রহমান এবং শেখ হাবিবুর রহমান। ইংরেজি ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ শেখ আব্দুল হামিদের বড় ছেলে শেখ লুৎফর রহমানের ঘর আলো করে জন্ম নেন মুক্তিকামী বাঙালির প্রাণের মানুষ, স্বাধীনতা সংগ্রামের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পিতা-মাতা যাঁকে আদর করে খোকা নামে ডাকতেন। বঙ্গবন্ধুর পিতা-মাতা শেখ লুৎফর রহমান ও মোছাম্মৎ সাহেরা খাতুনের চার কন্যা ও দুই পুত্রের মধ্যে বঙ্গবন্ধু ছিলেন তৃতীয় সন্তান। বঙ্গবন্ধুর বড় বোন ছিল ফাতেমা বেগম, মেজ বোন আছিয়া বেগম, সেজ বোন আমেনা বেগম হেলেন, ছোট বোন খোদেজা বেগম এবং তাঁর ছোট ভাইয়ের নাম ছিল শেখ আবু নাসের।

কবির ভাষায় সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা আমাদের এই জন্মভূমি। বঙ্গবন্ধুর জন্মভূমি টুঙ্গিপাড়া যেন তারই প্রতিচ্ছবি। তথ্য মতে প্রায় দুইশ বছর পূর্বে এ গাঁয়ের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছিল রূপের রানী মধুমতি। কালের বিবর্তনে মধুমতি আজ ভরাট হতে হতে টুঙ্গিপাড়া থেকে দূরে সরে গেছে। রয়ে গেছে তারই সন্তান শাখা নদী বাইগার। আকাঁ বাঁকা বাইগার নদীর মৃদু কলতান ও
তার উভয় পাশে সারিবদ্ধ তাল, তমাল, হিজলের নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখে চোখ জুড়িয়ে যেত। আহ! কী অপরূপ দৃশ্য দ্বারা বেষ্টিত টঙ্গিপাড়া গ্রাম খানি ছিল প্রকৃতি মায়ের অপরূপ সৌন্দর্য্যের লীলাভূমি। পাখির গান আর নদীর কলকল ধ্বনিতে মুখরিত ছিল এ গ্রাম খানি। পল্লী জননীর সুশীতল তলে এবং ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড়ে বাঙালি জাতির ভবিষ্যৎ কর্ণধর বঙ্গবন্ধু শেখ
মুজিবুর রহমানের এখানেই বেড়ে ওঠা।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক বিস্ময় নাম। সমগ্র বাঙালি জাতির জন্য তিনি বাংলার মাটিতে আশির্বাদ হয়ে এসেছিলেন। আমার বাপ দাদার মুখ থেকে শুনেছি এবং জেনেছি, ছোট থেকেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন চঞ্চল, দূরন্তমনা ও অসীম সাহসী। তিনি ছিলেন নিরহংকার, অনাড়ম্বর, দয়ালু ও মহানুভব। ছিলেন মানবতার এক মূর্ত প্রতীক। ছোট থেকেই মানুষের দুঃখ দুর্দশায় তাঁর প্রাণ কেঁদে উঠত। গরীব বন্ধুদের রোদ বৃষ্টিতে কষ্ট পেতে দেখলে তিনি নিজের ছাতা দান করে দিতেন। শীতের সময় নিজের কথা না ভেবে গরীব ছিন্ন বস্ত্রধারী বন্ধুদের মাঝে নিজের জামা কাপড় বিলিয়ে দিতেন। দুর্ভিক্ষের সময় নিজের গোলা থেকে ধান বিতরণ করতেন। সভা সমিতি করে ধনীদের কাছ থেকে ধান চাল সংগ্রহ করে গরীব ছাত্রদের মাঝে বিলিয়ে দিতেন। মানুষের প্রতি ছিল তাঁর অকৃত্রিম ভালবাসা। 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক জীবনের সূচনা ঘটেছিল ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দে মিশনারি স্কুলে পড়ার সময় থেকে এবং শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক ও গণতন্ত্রের মানস পুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সান্নিধ্যে এসে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। তিনি বাংলাকে রাষ্ট্রীয় ভাষা করার জন্য একাধিকবার কারাভোগ করেন। একটানা
১৪ দিন জেলে বসেও অনসন ধর্মঘট করেছেন। এমন দৃঢ় সংকল্প একজন মানুষের কথা আমি আর জীবনে শুনিনি।

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তিনি স্বাধীনতার ডাক দেন। তাঁর এক ডাকে পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ জনগণ শ্রমিক, কৃষক, তাতি, জেলে, কামার, কুমার সহ সকল শ্রেণির নারী পুরুষ ছুটেছিল সেদিন রেসকোর্স ময়দানে। মুহুর্তের মধ্যে রেসকোর্স ময়দান পরিণত হয় এক মহা জনসমুদ্রে। সেখানে তিনি শোনালেন তাঁর অমর বাণী, ‘ প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে।.... রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেবো। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, জয়বাংলা।’

বঙ্গবন্ধু ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি ও দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে কেন্দ্রীয়ভাবে নেতৃত্ব প্রদান করা এবং স্বাধীনতা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক হিসেবে কৃতিত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে বাংলাদেশের জাতির পিতা উপাধিতে ভূষিত করা হয়। মানবতার মূর্ত প্রতীক হিসেবে তাঁকে ভূষিত করা হয় বঙ্গবন্ধু উপাধিতে। শুধু তাই নয় তাঁকে প্রাচীন বাঙালি সভ্যতার আধুনিক স্থপতি ও সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বঙ্গবন্ধু সারাটা জীবন দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য সংগ্রাম করে গেছেন। নিজের দুঃখ কষ্টকে তুচ্ছ করে দেশের স্বাধীনতার জন্য, এই মা মাটি ও মানুষের মঙ্গলের জন্য দিনের পর দিন জেল খেটেছেন। তিনি ছিলেন অসীম সাহসী। এই সাহসেই ভর করেই তিনি তাঁর জীবন রাজনীতি ও বাংলার মানুষের জন্য বিসর্জন দিয়ে গেছেন। তিনি না থাকলে হয়তো কোনদিন স্বাধীন বাংলাদেশ পেতাম না।

লেখক : অসীম কুমার সরকার, সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার মোরেলগঞ্জ, বাগেরহাট ।


Somoy Journal is new coming online based newspaper in Bangladesh. It's growing as a most reading and popular Bangladeshi and Bengali website in the world.

উপদেষ্টা সম্পাদক: প্রফেসর সৈয়দ আহসানুল আলম পারভেজ

যোগাযোগ:
এহসান টাওয়ার, লেন-১৬/১৭, পূর্বাচল রোড, উত্তর বাড্ডা, ঢাকা-১২১২, বাংলাদেশ
কর্পোরেট অফিস: ২২৯/ক, প্রগতি সরণি, কুড়িল, ঢাকা-১২২৯
ইমেইল: somoyjournal@gmail.com
নিউজরুম ই-মেইল : sjnewsdesk@gmail.com

কপিরাইট স্বত্ব ২০১৯-২০২৪ সময় জার্নাল