ইলিয়াস হোসেন :
ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন কার্যত শেষ হতে চলেছে। বস্তুত রাশিয়া এ আগ্রাসন আর চালিয়ে যেতে পারছে না। প্রচলিত যুদ্ধে রাশিয়া কার্যত পরাজিত। প্রায় এক মাসের অভিযানে ইউক্রেনে ধ্বংসযজ্ঞ চালানো ছাড়া রাশিয়ার আর কোনো অর্জন নেই। ইউক্রেনের কোনো একটি বড় অঞ্চলও রাশিয়া দখল করতে পারেনি। রাজধানী কিয়েভ দখল ও সেখানে পুতুল সরকার বসানোর স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। বরং রাশিয়ার হাজার হাজার সেনা মরেছে। ট্যাংক ও বিমানের কবর হয়েছে ইউক্রেনের মাটিতে।
কিছুদিনের মধ্যেই একটি শান্তিচুক্তি বা অস্ত্ররিবতি হতে যাচ্ছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। চুক্তিতে রাশিয়ার অর্জন হবে একটাই- ইউক্রেন শুধু অঙ্গীকার করবে সে ন্যাটোতে যাবে না। রাশিয়ার আরও অনেক দাবি ছিল। সেগুলো মাটিচাপা পড়েছে। জেলেনস্কি সরকারকে মেনেই মস্কো চুক্তি করতে যাচ্ছে। রাশিয়া ইউক্রেন থেকে কার্যত খালি হাতে ফিরতে যাচ্ছে।
এই যুদ্ধে রাশিয়ার ক্ষতি অপরিসীম। দেশটি এখন দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন। রাশিয়ার সামনে অর্থনৈতিক বিপর্যয় আসন্ন। শান্তিচুক্তি হলেও পাশ্চাত্যের নজিরবিহীন নিষেধাজ্ঞা আরও বহুদিন বহাল থাকবে। রাশিয়ার জ্বালানির বিকল্প উৎস বের করে ফেলেছে পাশ্চাত্য- কাতার, ইরান ও ভেনিজুয়েলা। সেটাও আরেক বিপর্যয় রাশিয়ার জন্য। এখনো রাশিয়ার অর্থনৈতিক সংকট মারাত্মক হয়নি। তবে কিছুদিনের মধ্যেই সেটা স্পষ্ট ধরা পড়বে।
বাংলাদেশের যারা রাশিয়ার জয় নিয়ে আশাবাদী ছিলেন তারা ভুলে গেছেন, রাশিয়া আমেরিকাসহ পুরো পাশ্চাত্যের বিরুদ্ধে লড়ছে। রাশিয়ার সামরিক শক্তি নিয়ে এতোদিন যে বাহাদুরি ছিল তা ফুটো হয়ে গেছে। খুবই একটা ছোটদেশকে সে গ্রাস করতে পারেনি। এই রাশিয়াকে বাংলাদেশের অনেকে আমেরিকার সমান মনে করে! আচ্ছা, ভিয়েতনাম, ইরাক ও আফগানিস্তানে আমেরিকা কত বছর যুদ্ধ করেছে মনে আছে?
এ প্রসঙ্গে আরেকটি কথা না বললেই নয়। ভিয়েতনাম, ইরাক ও আফগানিস্তানে আমেরিকা যে কারণে পরাজিত হয়েছে, সেই একই কারণে ইউক্রেনে রাশিয়ার পরাজয় অবধারিত। সেটা হলো- একটি জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা ও বৃহৎ শক্তির দাদাগিরি সহ্য না করার মানবীয় প্রবৃত্তি। একই কারণে রাশিয়াও এক সময় আফগানিস্তানে পরাস্ত হয়েছিল।
যুদ্ধ শুধু অস্ত্রের খেলা নয়, টাকারও প্রদর্শনী। এখানেই রাশিয়া ধরা। সোভিয়েত ইউনিয়ন যখন ভেঙে যায় তখনও রাশিয়ার অস্ত্রের অভাব ছিল না, কিন্তু ছিল না টাকা। আজও সেই একই কথা প্রযোজ্য। ভুলে গেলে ভুল হবে যে রাশিয়ার অর্থনীতির আকার যুক্তরাষ্ট্রের একটি রাজ্যের সমান।
ইউক্রেন ছিল পাশ্চাত্যের প্রক্সিযুদ্ধের ক্ষেত্র। এতে পাশ্চাত্য যথেষ্ট প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়ে রাশিয়ার প্রভোকেশন বা উসকানি এড়িয়েছে। তারা চায়নি ফ্যাসিষ্ট পুতিনের সঙ্গে যুদ্ধে জড়াতে।
বাংলাদেশের মানুষ বুঝতে চায় না, শুধু অস্ত্র আর অর্থ নয়, মেধার খেলায়ও পাশ্চাত্যের সঙ্গে রাশিয়ার পেরে ওঠার কথা নয়। আচ্ছা বলুন তো, দুনিয়ার বেশিরভাগ মেধাবী মানুষ শেষমেষ কোথায় আশ্রয় নেয়? এর উত্তর- যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপে। রাশিয়ার মেধাবীরাও একই গন্তব্যে ছোটে।
শেষ কথা: পৃথিবীর কোনো স্বৈরাচার আলোচনায় বসতে আগ্রহী হয় না। তারা আলোচনাকে নিজেদের তথাকথিত লৌহমানব ভাবমূর্র্তির জন্য বিপর্যয়কর বলে মনে করেন। পুতিন যে সরকারকে উৎখাত করতে আগ্রাসন শুরু করেছিলেন, এখন তার সঙ্গেই আলোচনায় বসছেন। এটাই কী তার পরাজয় নয়?
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, দৈনিক সমকাল।