বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪

৩ দিন সাগরে ঘুরিয়ে মালয়েশিয়া বলে সেন্টমার্টিনে নামিয়ে দিত

সোমবার, এপ্রিল ১১, ২০২২
৩ দিন সাগরে ঘুরিয়ে মালয়েশিয়া বলে সেন্টমার্টিনে নামিয়ে দিত

নিজস্ব প্রতিবেদক:

কক্সবাজারের পেকুয়া ও চট্টগ্রামের বাঁশখালী এলাকা থেকে মানবপাচারকারী চক্রের পাঁচ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে র‍্যাব। তারা হলেন— মো. ইসমাইল (৩২), শফিউল আলম (৩৭), রিয়াজ খান রাজু (৪১), মো. হোসেন (৬০) ও মো. ইউনুছ মাঝি (৫৬)। র‍্যাব বলছে, চক্রটি দরিদ্র ও নিরীহ মানুষদের দুই লাখ টাকায় মালয়েশিয়া পাঠানোর কথা বলে চুক্তি করত। টাকা নিয়ে সাগরে তিন-চার দিন ঘুরিয়ে রাতের আঁধারে মালয়েশিয়া পৌঁছার কথা বলে সেন্টমার্টিনে নামিয়ে দিত।

এছাড়া অবৈধভাবে সাগর পথে ট্রলার যোগে মালয়েশিয়া নিয়ে অজ্ঞাত কোনো দ্বীপে মানুষকে নামিয়ে দিয়ে আসত চক্রটি। অবশ্য তার আগে মানুষের কাছ থেকে খালি স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর রাখত তারা। টাকা দিতে না পারলে স্বাক্ষরযুক্ত স্ট্যাম্পের মাধ্যমে তাদের আবাদি জমি, বাড়ি-ঘর দখল করে নিতো চক্রটি। এ চক্রে রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাশীলরাও জড়িত। চক্রটির সদস্যরা কয়েক ভাগে মানবপাচার করত বলেও জানায় র‌্যাব।

সোমবার (১১ এপ্রিল) চান্দগাঁও ক্যাম্পে সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র‍্যাব-৭ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল এম এ ইউসুফ।

র‍্যাব-৭ এর অধিনায়ক বলেন, মানবপাচারকারী চক্রের যে পাঁচ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তার মধ্যে চার জনই মূলহোতা। চক্রটি তিন ভাগে কাজ করত। প্রথমে গ্রুপের কাজ হচ্ছে, তারা অল্প খরচে মালয়েশিয়া যাওয়ার কথা বলে মানুষ জোগাড় করত। দ্বিতীয় গ্রুপটি পাসপোর্ট তৈরি করত। তারা দীর্ঘদিন ধরে পাসপোর্ট তৈরি করছে। তাদের সঙ্গে পাসপোর্ট অফিসের কারও যোগাযোগ থাকতে পারে। তৃতীয় গ্রুপটি ট্রলারে করে মানুষ নিয়ে যেত। মালয়েশিয়া নিয়ে যাওয়ার জন্য দুই লাখ টাকার চুক্তি করত। এক লাখ টাকা অ্যাডভান্স নিত। বাকি টাকা মালয়েশিয়া নেওয়ার পরে দেওয়ার চুক্তি থাকত। সেখানে যাওয়ার পর পরিবার থেকে বাকি টাকা আদায় করত।

তিনি বলেন, তারা একসঙ্গে অনেক মানুষ থেকে টাকা নিত। এর মধ্যে চার-পাঁচ জনকে বৈধ পথে মালয়েশিয়া পাঠাত বিভিন্ন এজেন্ট ও লোকের মাধ্যমে।  সেখানে তাদের চাকরির ব্যবস্থাও করত। তখন অন্যদের বলত আমরা কয়েকজনকে পাঠিয়েছি, তারা ভালো আছে। রেফারেন্স হিসেবে বৈধভাবে পাঠানো লোকদের নাম বলত।

টাকা নেওয়া লোকজনের মধ্যে আরেকটি গ্রুপ ট্রলারে করে মালয়েশিয়া সীমান্তে নিয়ে যেত। সেখানে বর্ডারের কাছাকাছি কোথাও নামিয়ে দিত। আর বলত জঙ্গল বা নদী পার হলে তাদের এসে নিয়ে যাবে। তারা ট্রলারে করে ৫০-৬০ জনকে নিয়ে যেত। ট্রলার থেকে নামার পরই সমস্যায় পড়ত পাচার হওয়া ব্যক্তিরা। কারণ তাদের কাছে কোনো পাসপোর্ট থাকে নেই, পথও অচেনা। এভাবে যাওয়া লোকজন মালয়েশিয়া পুলিশের হাতে আটক হতো বা জঙ্গলে আটকা পড়ত। সেখান থেকে জঙ্গল পার হয়ে চার-পাঁচ জন মালয়েশিয়া পৌঁছাতে পারত। তখন তারা পরিবারের কাছে মেসেজ দিত। তারপর বাকি টাকা এই চক্রটিকে দিত।

র‌্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, এছাড়া চক্রটি মালয়েশিয়া নেওয়ার কথা বলে সাগরে দুই-তিন দিন ঘুরিয়ে রাতের আঁধারে সেন্টমার্টিনে নামিয়ে দিত। সেন্টমার্টিনকে মালয়েশিয়া বলে নামিয়ে দিত। পরে মানবপাচারকারীদের কাছে টাকা ফেরত চাইলে মামলা দেওয়াসহ বিভিন্নভাবে হয়রানি করা হতো। তারা নিজেরাও জানে না তারা কতজন লোকের কাছ থেকে এভাবে মালয়েশিয়া পাঠানোর কথা বলে টাকা নিয়েছে। এছাড়া কতজন এভাবে যাওয়ার সময় মারা গেছেন তারও সঠিক তথ্য নেই। তাদের কাছ থেকে ৩১টি পাসপোর্ট জব্দ করা হয়েছে।

দুই ভাই মানবপাচার চক্রের মূলহোতা

র‍্যাব-৭ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল এম এ ইউসুফ বলেন, মানবপাচার চক্রের মূলহোতা হচ্ছে আপন দুই ভাই ইসমাইল হোসেন ও শফিউল আলম।  তারা মূলত মানুষ সংগ্রহ করে মালয়েশিয়া পাঠানোর জন্য। তারা কক্সবাজারের পেকুয়া ও চট্টগ্রামের বাঁশখালী থানা এলাকার নিরীহ মানুষের দারিদ্র্যের সুযোগে স্বল্প খরচে বিদেশ পাঠানোর জন্য কন্ট্রাক করত। এরপর তাদের কাছ থেকে খালি স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর রাখত। তারপর কিছু টাকার বিনিময়ে মালয়েশিয়া যেতে আগ্রহী প্রার্থীদের পাসপোর্ট বানানোর জন্য তাদের অন্যতম সহযোগী আসামি রিয়াজ খান রাজুকে দেয়।

তিনি বলেন, দুই ভাইয়ের নামে মানবপাচার আইনসহ বিভিন্ন অভিযোগে সাতটি করে মামলা আছে। আসামি রিয়াজ খান রাজু মালয়েশিয়া যেতে আগ্রহীদের পাসপোর্ট তৈরির কাজ শেষ করে দিত। পরে চক্রটি পাসপোর্ট করা মানুষকে বলত তাদের মাধ্যমে স্বল্প খরচে মালয়েশিয়া যাওয়া সম্ভব।

এই চক্রকে বিশ্বাস করে মানুষ রাজুর কাছে মালয়েশিয়া যাওয়ার মোট খরচের অর্ধেক টাকা জমা দিত। তারপর দুই ভাই ও রাজুর সহযোগীরা মিলে  মালয়েশিয়া যেতে আগ্রহী লোকদের গভীর রাতে ট্রলারে তুলে দিত। ট্রলারে তুলে দেওয়ার আগে তাদের সবার পাসপোর্টের কপি রাজুর কাছে রেখে দিত। তখন তারা বলত বিদেশে পৌঁছানোর পর বাকি টাকা পরিশোধ করলে তাদের পাসপোর্ট পাঠিয়ে দেবে।

সেন্টমার্টিনে নামিয়ে হাতিয়ে নিত টাকা, প্রতিবাদ করলে করা হতো মারধর

লেফটেন্যান্ট কর্নেল এম এ ইউসুফ বলেন, জয়নাল আবেদীন নামে এক ভুক্তভোগী অভিযোগ করেন, রিয়াজ খান রাজুকে বিশ্বাস করে তার কাছে পাসপোর্ট তৈরি করতে যায় তিনি। রাজু তার কাছে পাসপোর্ট বানানোর কারণ জানতে চায়। তখন ভিকটিম জানান সুযোগ হলে বিদেশে যাবেন। তখন রাজু ভিকটিমকে বলে, তাকে কম টাকার মধ্যে মালয়েশিয়া পাঠাতে পারবে। তার মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশে লোক আছে।

এ কথার পরিপ্রেক্ষিতে ভিকটিম রাজুকে পাসপোর্ট তৈরি করার জন্য প্রাথমিকভাবে ১৫ হাজার টাকা দেয়। কিছুদিনের মধ্যে রাজু পাসপোর্ট তৈরি করে দেয়।  তখন রাজুকে বিশ্বাস করে মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য পুনরায় এক লাখ টাকা দেয় ভিকটিম। বাকি টাকা মালয়েশিয়া যাওয়ার পর পরিশোধ করতে বলে রাজু। টাকা দেওয়ার ১৫ দিন পর রাজু ভিকটিমকে গভীর রাতে পেকুয়ার একটি ঘাট থেকে ট্রলারে তুলে দেয়। ওই ট্রলারে রাজুর মানবপাচার চক্রের কয়েকজন সদস্যসহ আরও ১৫ থেকে ২০ জন ভুক্তভোগী ছিল। পরে জয়নালসহ বাকি ভুক্তভোগীদের নিয়ে দুই-তিন দিন গভীর সাগরে ট্রলারটি ঘোরাফেরা করে। এরপর গভীর রাতে সেন্টমার্টিন দ্বীপে এনে মালয়েশিয়া চলে এসেছে বলে ট্রলার থেকে সবাইকে নামিয়ে দেয়।

সকাল হলে ভুক্তভোগীরা বুঝতে পারেন রাজু প্রতারণা করে তাদের সেন্টমার্টিন দ্বীপে নামিয়ে দিয়েছে। এরপর তারা কয়েকদিন সেন্টমার্টিনে মানবেতর জীবনযাপন করে বাড়ি ফিরে যায়। বাড়ি ফিরে রাজুর কাছে মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য দেওয়া টাকা ফেরত চায় জয়নাল। পরে রাজু তাদের মারধর করে এও অপহরণ করে মেরে ফেলার হুমকি দেয়।

সরকারি দলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত রাজু

লেফটেন্যান্ট কর্নেল এম এ ইউসুফ বলেন, রিয়াজ খান রাজু স্থানীয় পেকুয়া উপজেলার একজন রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তি। তার ভয়ে এলাকার কেউ কথা বলার সাহস পায় না। কেউ তার বিরুদ্ধে বলতে গেলে তাকে বাড়ি ছাড়া করে দেয়। এ কারণে কেউ থানায় অভিযোগ পর্যন্ত করার সাহস পায় না। সে পাসপোর্টের দালাল। বিভিন্ন জনের সঙ্গে পরিচয় থাকায় সে সহজেই পাসপোর্ট করে দিতে পারে। রাজুর কাছেই মালয়েশিয়া যেতে আগ্রহীরা টাকা জমা দিত। তার আগে স্ট্যাম্পের মাধ্যমে চুক্তি করত। টাকা রাজুর কাছে জমা রাখত।

তিনি বলেন, রাজু সরকারি দলের একটি অঙ্গ সংগঠনের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বলে জানতে পরেছি। রিয়াজ খান রাজু শুধু এক ব্যক্তির সঙ্গেই এরকম প্রতারণা করেনি। সে তার আশপাশের এলাকার আরও অনেক মানুষের সঙ্গে একইভাবে প্রতারণা করেছে। রাজু ১০ বছর ধরে পাসপোর্ট তৈরির কাজের সঙ্গে জড়িত। এ কাজে পাসপোর্ট অফিসের কেউ জড়িত কি না তা জানতে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।

জানা গেছে, রাজু পেকুয়া উপজেলার রাজা খালী ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি।

র‍্যাব-৭ এর অধিনায়ক বলেন, গ্রেপ্তার হোসেন এবং ইউনুসও এ চক্রটির সঙ্গে জড়িত। ইউনুস ট্রলার নিয়ে সাগর পথে যেত বলে জানতে পেরেছি।

তিনি আরও বলেন, রোববার চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলার বাঁশখালী এবং পেকুয়া এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে এই পাঁচ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

এমআই 


Somoy Journal is new coming online based newspaper in Bangladesh. It's growing as a most reading and popular Bangladeshi and Bengali website in the world.

উপদেষ্টা সম্পাদক: প্রফেসর সৈয়দ আহসানুল আলম পারভেজ

যোগাযোগ:
এহসান টাওয়ার, লেন-১৬/১৭, পূর্বাচল রোড, উত্তর বাড্ডা, ঢাকা-১২১২, বাংলাদেশ
কর্পোরেট অফিস: ২২৯/ক, প্রগতি সরণি, কুড়িল, ঢাকা-১২২৯
ইমেইল: somoyjournal@gmail.com
নিউজরুম ই-মেইল : sjnewsdesk@gmail.com

কপিরাইট স্বত্ব ২০১৯-২০২৪ সময় জার্নাল