দাস আল্লাহর প্রতি বান্দার শ্রেষ্ঠ একটা উপাধি। এটা তার জন্য সর্বোচ্চ সম্মানিত বিষয়। তাই আমরা দেখি, আল্লাহ তা’আলা যখন রাসূল ﷺ কে এই নিম্ন দুনিয়া থেকে সর্বোচ্চ স্থান তাঁর নিকটে নিয়ে গেলেন, তখন রাসূল ﷺ কে আব্দ বা দাস (বান্দা) হিসেবেই আখ্যায়িত করেছেন। [সূরা বনী ইজরাইল : ১]
আল্লাহর দাস হতে হলে আপনার মাঝে ৫টি গুণ থাকতে হবে। এটা ইবনে তাইমিয়া (রাহিমাহুল্লাহ) এর কথা। ইবাদত ও দ্বীন বিষয়ে আল্লাহ তা’আলা বলেন,
وَمَآ أُمِرُوٓا إِلَّا لِيَعْبُدُوا اللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ حُنَفَآءَ وَيُقِيمُوا الصَّلٰوةَ وَيُؤْتُوا الزَّكٰوةَ ۚ وَذٰلِكَ دِينُ الْقَيِّمَةِ
﴾তাদেরকে এছাড়া কোনো নির্দেশ করা হয়নি যে, তারা খাঁটি মনে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর ইবাদত করবে, সালাত কায়েম করবে এবং যাকাত দেবে। এটাই সুদৃঢ় ধর্ম।﴿ [সূরা বায়্যিনাহ : ৫]
সেই পাঁচটি গুণ এখন এখানে তুলে ধরব।
[১] ভালোবাসা। মুহাব্বাত। আল্লাহর দাস হতে হলে তাঁকে ভালোবাসতে হবে। আল্লাহকে ভালোবাসার আগ পর্যন্ত আপনি তাঁর দাস হতে পারবেন না। এই ভালোবাসার অর্থ কী? আল্লাহর ভালোবাসার চাইতে দুনিয়ার বাকী সব ভালোবাসা কম থাকতে হবে। আপনার প্রতিটি ভালোবাসা আল্লাহর ভালোবাসার নির্দেশিত সীমানার মাধ্যমে পরিচালিত হতে হবে। তাই, আপনার পরিবার, সন্তান, স্বামী বা স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা আল্লাহর আনুগত্যের মাধ্যমে হতে হবে। এটা আল্লাহর দাসত্বের প্রথম শর্ত-আল্লাহকে ভালোবাসা।
[২] আনুগত্য। ইতা’আত। রাসূল ﷺ বলেন,
لَا طَاعَةَ لِمَخْلُوْقٍ فِي مَعْصِيَةِ الْخَالِقِ
‘স্রষ্টার অবাধ্যতায় সৃষ্টির কোনো আনুগত্য নেই।’ [বুখারী : ৭২৫৭; মুসলিম : ১৮৪০]
মানে, সৃষ্টির আনুগত্য করতে গিয়ে কখনই আল্লাহর অবাধ্যতায় যাওয়া যাবে না। হ্যাঁ, আপনি আপনার বসের আনুগত্য করবেন, ট্রাফিক আইন মানবেন, অনেক কিছুরই আনুগত্য করতে হবে। কিন্তু আল্লাহর অবাধ্যতা হবে এমনভাবে ওসব মানা যাবে না। আল্লাহর আনুগত্য প্রথমে আসবে। আনুগত্য আল্লাহর দাসত্বের দ্বিতীয় গুণ।
[৩] আন্তরিকতা। ইখলাস। এর মানে আপনি যাই কিছু করেন না কেন, সেগুলো আল্লাহর দাস হিসেবে করে থাকেন। কিছু জিনিস আল্লাহর জন্য করেন আর বাকীটা অন্যকিছুর জন্য করে থাকেন, এমনটা হবে না। যেমন, সালাত পড়বেন আল্লাহর জন্য আর সবকিছু নিজের জন্য। কিন্তু আপনি যদি আল্লাহর দাস হন সবকিছু কার জন্য হবে? মালিক আল্লাহর জন্য। আপনার চাকরি আল্লাহর জন্য, আপনার পরিবার আল্লাহর জন্য, আপনার ইবাদাত আল্লাহর জন্য। প্রতিটি বিষয়ই আল্লাহর জন্য নিবেদিত। কিন্তু আপনি যদি কেবল ইবাদাতকারী হিসেবে নিজেকে চিন্তা করেন, তাহলে আপনি আপনার জীবনের কেবল একটা অংশ আল্লাহকে দিচ্ছেন, পুরো জীবনটাই আল্লাহর জন্য দিচ্ছেন না।
তাই, আল্লাহ কুর’আনে আমাদের শেখাচ্ছেন যে,
قُلْ إِنَّ صَلَاتِى وَنُسُكِى وَمَحْيَاىَ وَمَمَاتِى لِلَّهِ رَبِّ الْعٰلَمِينَ
﴾বল, “আমার নামায, আমার কোরবানি, আমার জীবন ও আমার মৃত্যু সারা জাহানের প্রভু আল্লাহর জন্য।﴿ [সূরা নাজম : ১৬২]
এর বাস্তবিক অর্থ কী জানেন? আমি যখন আমার ক্যারিয়ারের উদ্দেশ্য বানাবো, আমি যখন পারিবারিক উদ্দেশ্য বানাবো, আমি যখন আমার ব্যবসার উদ্দেশ্য তৈরি করবো—আমার চূড়ান্ত উদ্দেশ্য কী হবে? এগুলোর উদ্দেশ্য হবে আমার মালিকের সেবার জন্যে। এটা আমাদের পুরো আচরণই বদলে দিবে। আল্লাহ যখন আমাদের তাঁর বান্দা (দাস) হবার জন্য আহবান করে, অধিকাংশ মুসলিমরা এটাকে কী হিসেবে নেয়? তারা এটাকে ইবাদাতের মধ্যে সীমিত করে ফেলে। তারা মনে করে কেবল সালাত, সিয়াম, জিকির করলেই আল্লাহর দাস হয়ে যাবে! কিন্তু না, এটা আরো বিস্তৃত বিষয়। আপনার-আমার পুরো জীবনের সাথে ইবাদাত ও দাসত্ব জড়িত।
[৪] বিশ্বাস। তাওয়াক্কুল। আপনাকে আপনার মালিককে বিশ্বাস করতে হবে। আপনার মালিকের প্রতি আপনার চূড়ান্ত ও নিঃশর্ত বিশ্বাস থাকতে হবে। তিনি যা-ই করেন এটা আপনাকে বিশ্বাস করতে হবে যে আপনার ভালোর জন্যই করে থাকেন। তিনি আপনাকে যা দেন সেটা কল্যাণকর, আর যদি কিছু থেকে বঞ্চিত করেন তবে সেটাও আপনার জন্য কল্যাণকর বলেই দেননি। আপনি যদি কিছু পেয়ে থাকেন তবে সেটা আল্লাহর পক্ষ থেকে উপহার। আর যদি কিছু না দেন তবে সেখানে কল্যাণ রয়েছে বলে আপনাকে দৃঢ় বিশ্বাস রাখতে হবে। যা কিছুই ঘটুক না কেন, সেটা আল্লাহর হুকুম। আল্লাহ বলেন,
لِّكَيْلَا تَأْسَوْا عَلٰى مَا فَاتَكُمْ وَلَا تَفْرَحُوا بِمَآ ءَاتٰىكُمْ
﴾(আল্লাহ এটা এজন্য বলছেন) যাতে তোমরা যা হারাও তার জন্য দুঃখ না করো এবং তিনি তোমাদেরকে যা দান করেন তা নিয়ে উল্লসিত না হও।﴿ [সূরা হাদীদ : ২৩]
খুব সহজ হিসেব : আল্লাহ আপনাকে যা দেন সে বিষয়ে অতিরিক্ত খুশি হবার কিছু নেই, যা হারান বা পান না তাতেও দুঃখিত হবার কিছু নেই। প্রতিটি বিষয়ই আল্লাহর হুকুম, তাঁর পক্ষ থেকে হয়েছে। আপনি বরং আল্লাহর উপর পুরোপুরি বিশ্বাস রাখুন, আপনার তাওয়াক্কুল যেন আল্লাহর উপর হয়।
একজন দাস কোনো মাধ্যম বা মেডিয়ামের উপর বিশ্বাস রাখে না। আপনি আপনার গাড়ির উপর বিশ্বাস রাখেন না কারণ এটা বিশ্বস্ত কোম্পানির গাড়ি। আপনি আপনার পরিবারের উপর বিশ্বাস রাখেন না। আপনি আপনার পরিবার থেকে কিছুর আশা রাখেন না, আশা রাখবেন আল্লাহর কাছে।
যখন আপনি কোনো সৃষ্টির উপর বিশ্বাস রাখবেন, আশা রাখবেন আপনি প্রতিনিয়ত নিরাশ হবেন, আশাহত হবেন। যখন আপনি আল্লাহর উপর আশা রাখবেন, তখন কিছুই আপনাকে আশাহত করবে না। এটাই বিশ্বাস, তাওয়াক্কুল।
[৫] দাসত্বের শর্ত। এটা খুব বিস্ময়কর ধারণা। প্রতিটি সম্পর্কে শর্ত থাকে, নিয়মাবলি থাকে। শিক্ষক-ছাত্রদের মাঝে সম্পর্ক থাকে। এই সম্পর্কের দুটো দিকেরই কিছু নির্দিষ্ট দায়-দায়িত্ব রয়েছে। সন্তান-পিতামাতার সম্পর্কেও দুটো দিকেই নির্দিষ্ট দায়িত্ব রয়েছে। চাকরিদাতা-চাকরীজীবী দুই দিকেই শর্ত রয়েছে—আপনি এতটার সময় আসবেন, এতটায় অফিস ত্যাগ করবেন, এতো বেতন পাবেন, উভয়ে উপরের অবস্থাদি বুঝতে হবে। এগুলো করবেন, এগুলো করতে পারবেন না ইত্যাদি শর্ত রয়েছে। আমরা জানি দাসত্বের এই শর্তগুলো আমাদের পাশ থেকে নিয়ন্ত্রিত হবে না, এগুলো আমরা পরিচালনা করবো না। এগুলো বরং মাস্টার বা মালিক দ্বারা নির্ধারিত, যিনি হুকুমকারী, নিয়ন্ত্রণকারী।
ইবনে তাইমিয়া (রাহিমাহুল্লাহ) বলতেন, দুনিয়ার জান্নাতে যে প্রবেশ করবে আখেরাতের জান্নাতেও সে প্রবেশ করবে। জানি না দুনিয়ার জান্নাত কি, কিন্তু সালাহতে তার কিছু ছিটেফুটা টের পেয়েছিলাম এই বইয়ের বিষয়াবলি প্রয়োগে।
রামাদান মাসে নামাজের মাধ্যমে আল্লাহর সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক করার ও অসীম সাওয়াবের মাধ্যমে হয়ে দাঁড়ায় নামাজের ইবাদাত। সেই ইবাদাতের মধুরতা ও পুরো সাওয়াবের কোনো কমতি যেন না থাকে সেটা যেন নিশ্চিত করতে পারি আমরা। সেজন্য নামাজের প্রশান্তি ও শীতলতা দরকার।
যেদিন আপনার শত শত টাকা, বিশাল সম্পদ, দিনার-দিরহাম, ডলার কিছুই কাজে লাগবে না, কাজে লাগবে কেবল আল্লাহর জন্য নিবেদিতে উত্তম সময় ও ইবাদাত, সেগুলোরই সর্বোত্তম একটি ইবাদাত নামাজ। সেই নামাজ ঠিকমতো কবুল হচ্ছে তো? না হলে তো অন্যান্য আমলও নষ্ট হওয়া শুরু করেছে বলে হাদীসে এসেছে। কারণ আল্লাহর সাথে সরাসরি যোগাযোগের যেই ইবাদাত বিশুদ্ধভাবে, খুশু ও আন্তরিকতার সাথে হচ্ছে না তাহলে সেই আল্লাহর অন্যান্য কাজগুলো কীভাবে করবেন?!! “কীভাবে নামাজের মধুরতা লাভ করা যায়?” বইটি আপনার আখিরাতকে করতে পারে অনেক উজ্জ্বল, আনন্দপূর্ণ।
আখিরাতে ফরজ নামাজের ঘাটতিগুলো পূরণ করা হবে নফল নামাজ দিয়ে। কিন্তু কথা হলো আপনার নামাজই যদি কবুল না হয় তবে কি আল্লাহ সেগুলো দিয়ে পূর্ণ করবেন ফরজের ঘাটতিগুলো?! না। যে নামাজের তাঁর প্রাণ (খুশু) থাকে না, সেটা কবুল হবে কীভাবে? এসব নিয়েই তো মিশারী আল-খারাজের বিশদ আলোচনার “কীভাবে নামাজের মধুরতা লাভ করা যায়?” বইটি। রামাদান ও বছরের প্রতিদিনকার নামাজের ইবাদাতকে প্রশান্তির শীতলতায় আচ্ছন্ন করতে এই বইটিও সংগ্রহ করতে পারেন।