কোমল পানীয় ও দাঁতের ক্ষয়রোগ: ডাঃ ফাতিমা রহমান খান
গরমের দিনে আমাদের দেশে খুব জনপ্রিয় একটি সতেজকারক পানীয় হল কোমল পানীয় বা সফট ড্রিংক্স। শুধু গরমের দিনেই নয়, বাড়িতে বা রেস্টুরেন্টে রিচফুড খাওয়ার সাথে, খেলার মাঠে বা স্পোর্টস ক্লাবে, স্কুল কলেজ কিংবা অফিসের ক্যান্টিনে, রাস্তাঘাটে ভ্রমণক্লান্তি ও তৃষ্ণা মেটাতে পৃথিবীর সব দেশেই এর জনপ্রিয়তা এখন শীর্ষে।
অথচ কোমল পানীয় সাময়িক তৃষ্ণা নিবারক ও সতেজকারক হলেও স্বাস্থ্যের জন্য যে কতটা ক্ষতিকর এ সম্পর্কে অনেকের ধারণা নেই। আর এ বিষয়ে জানা থাকলেও দীর্ঘদিনের অভ্যাসের কারণে এর অতিরিক্ত ব্যবহার থেকে তাদের রেহাই মিলছে না।
কি থাকে এই কোমল পানীয় বা সফট ড্রিংকে?
কোমল পানীয় হল একটি মাদকবিহীন পানীয় যাতে দ্রবীভূত থাকে কার্বন মেশানো পানি, রিফাইন্ড চিনি, ক্যাফেইন, কৃত্রিম রঙ ও সুগন্ধিকারক এবং নানা রকম এসিড। ব্যাক্টেরিয়া ও ফাংগাস এর আক্রমণ ঠেকাতে ও দীর্ঘদিন মজুত রাখার উদ্দেশ্যে এতে মেশানো হয় কেমিক্যাল প্রিজারভেটিভ। জমাট বাধা রোধ করতে দেওয়া হয় ইথিলিন গ্লাইকল যা দেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। আধা লিটারের এক বোতল পানীয়তে ১৭০ ক্যালরি সোডা ও আনুমানিক পনের চামচ চিনি মেশানো হয় যা দাঁত ও হাড়সহ দেহের প্রত্যেকটি অংগপ্রত্যংগের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকারক।
দাঁতের উপর কোমল পানীয়ের প্রভাব কি?
দাঁত হল আমাদের শরীরের সবচাইতে শক্তিশালী অংশ। এর বাইরের আবরণ "এনামেল" দিয়ে গঠিত। এর ৯৬% হল ক্যালসিয়াম ও অন্যান্য খনিজ পদার্থ। Mohs hardness scale অনুযায়ী এনামেল এর কাঠিন্যতার পরিমান হল ৫ যা স্টিল বা ইস্পাতের সমান।
নিয়মিত কোমল পানীয় পান করার কারণে দাঁতের এনামেল মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গবেষণা করে দেখা গেছে একটি দাঁতকে যদি কোকা কোলার মধ্যে এক সপ্তাহ ডুবিয়ে রাখা হয় তাহলে সপ্তাহ শেষে তার অস্তিত্ব আর খুঁজে পাওয়া যায় না। সামাজিক মাধ্যমগুলোতে ইতোমধ্যে কোকা কোলা দিয়ে বাথ্রুমের টাইলস, কমোড, বেসিন ঝকঝকে পরিষ্কার করার কৌশলের প্রচারণাও বলে দেয় সফট ড্রিংক্সে থাকা এসিড কতটা শক্তিশালী ও দেহের জন্য কতটা বিপদজনক!
আমরা যখন কোমল পানীয় পান করি তখন এতে থাকা চিনি মুখের ভেতরের ব্যাক্টেরিয়ার সাথে মিথষ্ক্রিয়া শেষে এসিড তৈরি করে। এই এসিড দাঁতের সংস্পর্শে এলে এনামেলের ক্ষয় শুরু হয়, একে বলে Erosion। Erosion এর কারণে দাঁত হলদেটে হয়ে যায় এবং একসময় দাঁতে ক্যাভিটি বা ছিদ্র হওয়া শুরু হয়। দুধ দাঁতের এনামেল আবরণকেও নষ্ট করে দেয় কোল্ড ড্রিংক্স। এছাড়া চিনির পরিমাণ বেশি থাকায় শিশুরা পরবর্তীতে অন্য পুষ্টিকর পানীয় জাতীয় খাবার গুলো ( দুধ, ফলের রস) খেতে চায়না। তাতে দাঁত ও হাড়ের গঠনে ব্যাঘাত ঘটে।
একেকবার কোমল পানীয়ের ক্ষতিকর প্রভাব থাকে প্রায় ২০ মিনিট। চিনিমুক্ত বা চিনিযুক্ত উভয় ধরনের পানীয়ই তাদের নিজস্ব এসিড তৈরি করে দাঁতের ক্ষয় ত্বরান্বিত করে।
এনামেল ক্ষয়ে গেলে এবার তার নিচের আবরণ "ডেন্টিন" আক্রান্ত হয়। এর ফলে দাঁত শিরশির করে ও ঠান্ডা গরম পানি ও খাবার খাওয়ার সময় ব্যাথা হয়। এমনকি বাতাসের সংস্পর্শেও ব্যাথা অনূভুত হতে পারে। যারা দিনের মধ্যে একাধিকবার কোল্ড ড্রিংক্স গ্রহণ করেন তাদের একে একে সব দাঁত ক্ষয়রোগে আক্রান্ত হতে থাকে, নিয়মিত ব্রাশ করেও রেহাই পাওয়া যায় না।
কিভাবে কোমল পানীয় জনিত দাঁতের ক্ষয়রোগের ঝুঁকি কমাবেন?
-কোমল পানীয়ের পরিবর্তে ফলের রস, ডাবের পানি বা অন্যান্য শরবত খাওয়ার অভ্যাস করুন।
- যদি কখনও পার্টিতে বা আড্ডায় এসব পানীয় গ্রহণ করতেই হয়, গ্লাসে ঢেলে নিন ও স্ট্র ব্যবহার করুন। এতে পরিমিত/ অল্প পরিমাণে খাওয়া হবে এবং স্ট্র ব্যবহারের কারণে ড্রিংক্স দাঁত স্পর্শ করবে না।
- কোমল পানীয়ের মধ্যে তুলনামূলক ভাবে নিরাপদ হল আর্টিফিশিয়াল কালার ছাড়া পানীয়গুলো। পরিস্থিতি ও প্রয়োজনের খাতিরে যদি সামান্য পান করতেই হয় তবে রঙ বিহীন পানীয় পান করুন।
- সন্ধ্যার পর বা রাতের বেলা কোমল পানীয় পরিহার করুন।
- কোমল পানীয় গ্রহণের পর ভাল করে কুলি ও ব্রাশ করে ফেলুন।
- নিয়মিত ডেন্টাল চেকাপ অপরিহার্য। তাতে দাঁতের ক্ষয় ও অন্যান্য সমস্যাগুলো প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়ে, চিকিৎসা সহজ হয়।