মো. কাওছার আলী, ডিআইইউ :
ভোরের আলোর মত সচ্ছ রাকিবের জীবন৷ বয়স কম হলেও কাজ করতে হয় বড়দের সমান। ১৩ বছর বয়সী ছেলেটা বড়দের সমান কাজ করেও বেতন পায় অর্ধেক। প্রতিবাদ করারও যে উপায় নেই৷ কেউ নেই শিশু শ্রমিকের হয়ে কথা বলার। বাবা থাকলেও অর্থ উপার্যন করার ক্ষমতা হারিয়েছেন অনেক বছর আগেই। রাকিব সবে মাত্র ৭ম শ্রেণির ছাত্র। যে বয়সে স্কুলের বাচ্চাদের সাথে খেলা করার কথা সে বয়সেই বাস্তবতা তাকে আকস্মিকভাবে বদলে দিয়েছে৷ এভাবেই বাড়তে থাকে দিন৷ চলতে থাকে শিশু শ্রমিক রাকিবের যুদ্ধ৷
রাকিবের বাবা ছিলেন একজন রাজমিস্ত্রী। হটাৎ আক্রান্ত হন প্যারালাইসিস রোগে। তখন রাকিব ৪র্থ শ্রেণীর একজন ছাত্র। তার বাবা অসুস্থ হাওয়ার পরেই তো শুরু হয়েছে তাদের কষ্টের দিন পার করা। বাবা প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হাওয়ার পরে আর কাজ করতে পারে না। পরিবারের আয়ের উৎস অকেজো হয়ে পড়ায় পরিবারের হাল ধরে রাখতে রাকিবের মা শুরু করেন গৃহস্থ বাড়িতে কাজ করা। তারা মা যে বেতন পেতো তা দিয়ে তাদের সংসার চলতো না বললেই হয়। চলবেই বা কি করে রাকিবের ছোট বোনটাও যে এখন স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে। ছোট বোন সাদিয়াও যে কান্না করে "৫ টাকা দাও, স্কুলে মজা কিনে খাবো" বলে। ঠিক মতো ঔষধ না খাওয়ায় তার বাবারও সমস্যা বাড়তে থাকে । এবার যেন সংসারের অবস্থা আরও খারাপ হয়ে গেলো। তার মা গৃহস্থ বাড়িতে কাজ করার পাশাপাশি ইট ভাঙ্গার কাজ শুরু করে। এভাবে কোনো রকমে চলতে থাকে তাদের সংসার। গভীর আক্ষেপের জীবনবোধ নিয়ে বাড়তে থাকে সময়৷
এর মাঝেই আবির্ভব হয় মহামারি করোনা ভাইরাসের। তখন রাকিব ৫ম শ্রেণি পাশ করে ৬ষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র। রাকিবের মায়ের করোনার লক্ষন দেখা দেয়। তার পরেই শুরু হয় রাকিবের জীবনের সবচেয়ে নিষ্ঠুর দিনগুলো। রাকিবের মা রাবেয়ার করোনার লক্ষন প্রকাশ পেলে তার গৃহস্থ বাড়িতে কাজ বাতিল হয়ে যায়, সেই সাথে ইট ভাঙ্গার কাজ থেকে বিতাড়িত করে তাকে। ঘরে অসুস্থ বাবা, করোনার লক্ষন নিয়ে সংগ্রামী মা এবং ৪র্থ শ্রেণিতে পড়া ছোট বোন সাদিয়া- সবার দ্বায়িত্ব যে এবার রাকিবের উপরে। তার প্রতিবেশীরা কেউ কেউ এগিয়ে আসেন এবং কিছু দিন সাহায্য সহোযোগিতা করেন।প্রতিবেশীরাও আর কতো দিন তাদের দেখাশোনা করবেন। কিছু দিনের ভেতর কমে যায় তাদের সহোযোগিতা করা মানুষ। পরিবারের এক বেহাল অবস্থা। ছোট ছেলেটিকে কে বা কি কাজ দিবে। রাকিবকে নিকটস্থ একটি বেসরকারি প্রোজেক্টে রাজমিস্ত্রীর হেলপারিতে নিযুক্ত করে দেন প্রতিবেশি রব্বানী। ততদিনে রাকিবও বুঝে যায় জীবন এমনি৷
স্কুল বন্ধ থাকাতে বসেই থাকতে হতো রাকিবের। প্রথম দিকে খুই আগ্রহের সাথে কাজ করেন রাকিব। কিন্তু তার কাজের মাঝে ছিলো না কোনো বিশ্রাম, পেতোনা সঠিক মূল্য। রুগ্ন শরীরের রাকিবের কাজের তেজ কমে যায়। মাঝে মাঝেই শুনতে হয় বাজে বকুনি, সবাই যখন বিশ্রম নেয় তখনও কাজ করতে হয়ে রাকিবের। বিশ্রমের কথা বললে, কাজের পরিচালক বলেন "বিড়ি, সিগারেট না খাইলে আবার বিশ্রাম কিসের?।
শিশু শ্রমিক রাকিবও এবার নেশা করতে বাধ্য। বিশ্রামের নামে অহেতুক তারও জ্বলাতে হয় বিড়িতে আগুন। এবার রাকিবের মা সুস্থ হয়ে আবারও শুরু করেন গৃহস্থ বাড়িতে কাজ এবং ফিরে যান ইট ভাঙ্গার কাজেও। হটাৎ এক কালো সন্ধ্যায় কাজ শেষ হাওয়ার আগেই রাকিবকে শুনতে হয় তার প্যারালাইসিসে আক্রান্ত বাবার মৃত্যুর খবর। দৌড়ে বাসায় গিয়ে বাড়ি ভর্তি মানুষকে নিয়ে বাবাকে জানায় চির বিদায়। এরই মাঝে রাকিব ৭ম শ্রেণীর ছাত্র। কিন্তু তার পার আর বই নিয়ে যাওয়ার সুযোগ হয়নি স্কুলের বারান্দায়। স্কুলে যাবেই বা কিভাবে? কাজে না গেলে যে কাজ বন্ধ, কাজ বন্ধ হলে বাজার করার টাকা আসবে কোথায় থেকে। এভাবেই বিড়ির আগুন জ্বালিয়ে চলতে থাকে শিশু শ্রমিক রাকিবের জীবন। শেষ হয় একটি সম্ভবনার, একটি স্বপ্নের৷ ফিরে গিয়ে জানতে ইচ্ছে করে রাকিব কি আবারও স্কুলে আসবে? কিন্তু কি লাভ বিষাদ বাড়িয়!
এমআই