শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪

ডায়াবেটিক রোগীদের দাঁতের সমস্যা ও করণীয়

শনিবার, মে ২৮, ২০২২
ডায়াবেটিক রোগীদের দাঁতের সমস্যা ও করণীয়

ডাঃ ফাতেমা রহমান খান 
১.
সুফিয়া বেগম ক্লিনিকে এসেছেন মুখে দূর্গন্ধ ও মুখের  শুষ্কতার সমস্যা নিয়ে। প্রতিদিন দু'বার ব্রাশ করেন, নিয়মিত মাউথওয়াশ দিয়ে কুলিসহ দাঁতের যথাসম্ভব যত্ন নিয়েও এর থেকে রেহাই পাচ্ছেন না। প্রচুর পানি পিপাসা পায়, পানি পান করেও যেন বার বার মুখ ও জিহ্বা শুকিয়ে আসে। দাঁতের ক্ষয়ও শুরু হয়ে গিয়েছে এরই মধ্যে। 

২.
মিরাজ সাহেব এর বয়স ষাটের বেশি।  তিনি কয়েক বছর  থেকে ডায়াবেটিস রোগে ভুগছেন। প্রথমে নিয়ন্ত্রিত থাকলেও এখন কখনো কখনো অনিয়ন্ত্রিত হয়ে যায়। ডেন্টিস্টের কাছে আসার মূল কারণ হল তাঁর দাঁতের মাড়ি প্রায়ই ফুলে যায়, পুঁজ হয়। ইদানিং উনি খেয়াল করছেন  কয়েকটি দাঁত হালকা নড়ছে। 

৩.
আলমাস সাহেবের সমস্যা হল দাঁতের গোড়া পাথরে ভরে গেছে। একসময় নিয়ম করে ব্রাশ করতেন। কিন্তু যখন খেয়াল করলেন ব্রাশ করার সময় দাঁতের গোড়া থেকে রক্ত বের হয় ও ব্যাথা অনুভূত হয়, টুথব্রাশ বাদ দিয়ে আংগুলে টুথপেস্ট লাগিয়ে তিনি দাঁত পরিষ্কার করেন।  তাতে দাঁত আংশিক পরিষ্কার হলেও দাঁত ও মাড়ির মাঝখানে পকেট তৈরি হয়ে গিয়েছে, জমেছে প্ল্যাক৷ অত:পর তা দিনে দিনে শক্ত ক্ষুদ্র পাথরের মত আকার ধারণ করেছে। তিনি এখন দাঁত পরিষ্কার করতে গেলে ব্যাথাও পান আবার মাড়ি থেকে রক্তও পড়ে৷ 
উনাদের সবাইকেই পাঠানো হল ব্লাড সুগার টেস্ট করাতে এবং বলা বাহুল্য উনারা সবাই ছিলেন ডায়াবেটিক পেশেন্ট। 

ডেন্টাল ক্লিনিকে আসা অনেক রোগীই আমরা পাই যারা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত অথচ তা অসনাক্ত অবস্থায় ও বিনা চিকিৎসায় দিব্যি দিন কাটিয়ে যাচ্ছেন। ডায়াবেটিস একটি মারাত্মক রোগ যেখানে শরীর পর্যাপ্ত ইনসুলিন তৈরি করতে পারে না। ইনসুলিন চিনিকে শরীরের কোষে প্রবেশ করিয়ে দেয়, অত:পর এটি দেহের শক্তির জন্য ব্যবহৃত হয়। 

এখন প্রশ্ন হল, ডায়াবেটিস হলে বা রক্তে শর্করার পরিমান বেশি হলেই কি কেবল উপরোক্ত উপসর্গ গুলো দেখা দিবে? অবশ্যই না। 

আরও অনেক কারণেই এসব উপসর্গ দেখা দিতে পারে। তবে ডায়াবেটিক পেশেন্টরা দাঁত ও মাড়ির এ সমস্যা নিয়ে ভোগেন সবচেয়ে বেশি । আবার ডায়াবেটিক রোগীদের ব্লাড সুগার যদি নিয়ন্ত্রণে থাকে ও তারা নিয়মিত দাঁতের যত্ন নেন তাহলে দাঁতের সমস্যা থেকে অবশ্যই রেহাই পেতে পারেন। 
আরেকটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। তা হল, ডায়াবেটিক পেশেন্ট এর দাঁতের চিকিৎসার আগে অবশ্যই ব্লাড সুগার পরীক্ষা করে নিতে হবে। কেননা রক্তে গ্লুকোজ অনিয়ন্ত্রিত থাকা অবস্থায় চিকিৎসা করা হলে হার্টের সমস্যা ( ব্যাকটেরিয়াল এন্ডোকার্ডাইটিস) সহ আরো অনেক জটিলতা দেখা দিতে পারে।
কারো অনিয়ন্ত্রিত  ডায়াবেটিস থাকলে দাঁত ও মুখের যে সমস্যা গুলো হয় সেগুলো হল :  

১. ড্রাই মাউথ ( মুখগহবর ও জিহবার শুষ্কতা) - ডায়াবেটিক রোগীদের একটি প্রধান সমস্যা হল মুখের শুষ্কতা ও প্রচুর পিপাসা লাগা। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হলে প্রাথমিক পর্যায়ে এ সমস্যাকে একটি লক্ষণ হিসেবে ধরা হয়। লালাগ্রন্থির নিঃসরণ কমে যাওয়ায় মুখের ভেতরের ন্যাচারাল ক্লিনজিং কমে যায় এবং মাড়ির প্রদাহ ও দাঁতের ক্ষয়রোগ শুরু হয়। 

২. জিনজিভাইটিস (মাড়ির প্রদাহ) - রক্তে শর্করার পরিমাণ বেশি হওয়ায় ও ন্যাচারাল ক্লিনিজিং না হওয়ায় মুখে অবস্থিত ব্যাক্টেরিয়ার কার্যক্রম বেড়ে যায়। ফলে দাঁতের মাড়িতে ইনফেকশান দেখা দেয়। এতে মাড়ি ফুলে যায়, রক্ত ও পুঁজ বের হয় ও চিকিৎসা করা না হলে এক পর্যায়ে মাড়ি দূর্বল হয়ে পড়ে। দাঁতের শেকড় উন্মুক্ত হয়ে যাওয়ায় দাঁত শিরশির করে। 

৩. পেরিওডোন্টাইটিস ( দাঁত ও আশপাশের টিস্যুগুলোর প্রদাহ)- সময়মত মাড়ির প্রদাহের চিকিৎসা করা না হলে দাঁতের চারপাশের লিগামেন্ট ও মাড়ির নিচে অবস্থিত হাড়ে ইনফেকশান ছড়িয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে ইনফেক্টেড মাড়ি ও হাড় দাঁতকে আর শক্ত করে ধরে রাখতে পারেনা। দাঁতগুলো ক্রমান্বয়ে নড়বড়ে হয়ে পড়ে এবং কিছু ক্ষেত্রে অসময়ে দাঁত পড়ে যায়। 

৪. ডেন্টাল ক্যারিজ ( দাঁতের ক্ষয়রোগ) - ডায়াবেটিক পেশেন্টের মুখের শুষ্কতা ও ব্যাক্টেরিয়ার অতি সক্রিয়তা দাঁতের ক্ষয় রোগের অন্যতম কারণ। সময়মত পদক্ষেপ না নেওয়া হলে একে একে অনেকগুলো দাঁত ক্ষয়ে যেতে পারে। 

৫. ওরাল থ্রাশ বা ক্যান্ডিডোসিস ( ছত্রাকজনিত সাদা রোগ)- জিহবা ও মুখগহ্বর এর অন্যান্য অংশে ক্যানডিডা নামক ছত্রাক দিয়ে এ রোগের বিস্তার ঘটে। এ ছত্রাকের মূল খাদ্য চিনি যা রোগীর রক্তে বেড়ে যাওয়ায় এদের বৃদ্ধি ত্বরান্বিত করে৷ সময়মত চিকিৎসা না করা হলে জটিলতা দেখা দিতে পারে। 

৬. ওরাল আলসার ( মুখে ঘা) - ডায়াবেটিক রোগীর দেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়ায় মুখের ভেতরে ও বাইরে ঘা হতে দেখা যায় যা সহজে ভাল হতে চায় না। 
ডায়াবেটিক রোগীদের দাঁত ও মুখের যত্নের ব্যাপারে কিছু পরামর্শ দেওয়া হল :

- খাওয়া, ঘুম ও ব্যায়াম রুটিন মাফিক করে এবং প্রয়োজনীয় ওষুধ সেবন করে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখুন।

- মুখগহ্বরের শুষ্কতা এড়াতে প্রচুর পানি পান করুন। 

- প্রতি ছয় মাস পরপর একবার আপনার দাঁত এবং মাড়ি আপনার ডেন্টিস্ট দ্বারা পরীক্ষা করিয়ে নিন। কত দিন পর পর চেকআপের প্রয়োজন হবে মূলত তা নির্ধারণ করবে আপনার ডাক্তার,  আপনার দাঁতের ও মুখগহ্বর এর অবস্থা বিবেচনা করে। 

- খাবার পর ডেন্টাল ফ্লস ব্যবহার করুন। এতে দুই দাঁতের মাঝখানে জমে থাকা খাদ্যকণা গুলো পরিষ্কার করা যাবে এবং দাঁতে প্ল্যাক জমা ও মাড়ির প্রদাহ থেকে রক্ষা করা যাবে। 

- দিনে দুবার ফ্লোরাইড যুক্ত টুথপেস্ট দিয়ে দাঁত ব্রাশ করুন। এক্ষেত্রে মাড়ির ক্ষত এড়াতে নরম ব্রিসলের টুথব্রাশ ব্যবহার করা যেতে পারে। 

- মাউথওয়াশ ব্যবহার করাটা আবশ্যক, তা বাসায় তৈরি প্রাকৃতিক হোক বা কেমিক্যাল ফর্মুলার হোক। নিয়মিত কুলি মাড়ির জন্য একটি উত্তম ব্যায়ামও বটে। এতে মাড়িতে রক্ত সঞ্চালন বাড়বে ও ইনফেকশান এর সম্ভাবনা কমে যাবে। 

- আপনি যদি রিমুভেবল ডেনচার বা আলগা কৃত্রিম দাঁত ব্যবহার করে থাকেন তবে রাতের বেলা সেগুলো খুলে রাখুন। প্রতিদিন সকালে সেটা পরিষ্কার করে ব্যবহার করুন।

- আপনি যদি ধূমপায়ী হন, যত দ্রুত সম্ভব এ অভ্যাস ত্যাগ করুন। কিভাবে দ্রুত এ বদ অভ্যাস ত্যাগ করবেন সে ব্যাপারে আপনার ডেন্টিস্ট এর পরামর্শ নিতে পারেন। 

ডায়াবেটিস এমন একটি অসুখ যা অনিয়ন্ত্রিত থাকলে সময়ের সাথে সাথে কিডনি, স্নায়ু, চোখ, হাড় ও দাঁতকে দূর্বল করে ফেলে। রোগী যেকোন ইনফেকশনে আক্রান্ত হন খুব সহজে, চিকিৎসাটাও সময়সাপেক্ষ হয়ে যায়। সেজন্য সময়মত এর ডায়াগনোসিস ও সংশ্লিষ্ট রোগ গুলোর চিকিৎসা  হওয়া খুব জরুরি।

ডাঃ ফাতেমা রহমান খান 
সিনিয়র ডেন্টাল সার্জন 
লাইফলাইন কন্সাল্টেশান এন্ড ডায়াগনস্টিক লিমিটেড 
বসুন্ধরা,  ঢাকা।


Somoy Journal is new coming online based newspaper in Bangladesh. It's growing as a most reading and popular Bangladeshi and Bengali website in the world.

উপদেষ্টা সম্পাদক: প্রফেসর সৈয়দ আহসানুল আলম পারভেজ

যোগাযোগ:
এহসান টাওয়ার, লেন-১৬/১৭, পূর্বাচল রোড, উত্তর বাড্ডা, ঢাকা-১২১২, বাংলাদেশ
কর্পোরেট অফিস: ২২৯/ক, প্রগতি সরণি, কুড়িল, ঢাকা-১২২৯
ইমেইল: somoyjournal@gmail.com
নিউজরুম ই-মেইল : sjnewsdesk@gmail.com

কপিরাইট স্বত্ব ২০১৯-২০২৪ সময় জার্নাল