ডাঃ তাজকেরা সুলতানা চৌধুরী :
যখন তার পুতুল খেলার সময়। বিয়ের দুই বছরের মধ্যেই তিনি গর্ভবতী হন। তার গর্ভকালীন সময়ে সেবা নেয়ার সুযোগও পাননি, ঘরেই তার প্রসব হয়। প্রসব বেদনা ২৪ ঘণ্টারও বেশি সময় স্থায়ী ছিল। দীর্ঘ প্রসব বেদনার পর তিনি একটি মৃত বাচ্চা প্রসব করেন।
প্রসবের কয়েকদিন পর থেকেই তিনি লক্ষ্য করেন তার যোনিপথ দিয়ে প্রস্রাব ঝরছে অহরহ। কয়েক মাস পেরিয়ে যায় কিন্তু তার সর্বক্ষণ প্রস্রাব
ঝরা অব্যাহত থাকে। ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা তার পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। তার কাপড়ে সব সময় প্রস্রাবের গন্ধ তাকে খুবই বিপর্যস্ত করে তোলে।
এরকম পরিস্থিতিতে তিনি তার স্বামীর ঘরে থাকতে পারলেন না। তাকে তালাক দেয়া হয়। আত্মীয়-স্বজন কেউ তাকে গ্রহণ করতে আসেনি। তার জন্য কোন কাজ পাওয়াও অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। ১৪ বছরের হনুফা বেগম বেঁচে থাকার চেষ্টায় ভিক্ষাবৃত্তি শুরু করেন।
তিনি যে অসুখে ভুগছেন তার নাম মহিলাজনিত ফিস্টুলা। মূলত এটি এমন একটি অসুখ যখন কারও প্রস্রাবের রাস্তা বা যোনিপথ এক বা একাধিক নালি/ছিদ্র দিয়ে মূত্রপথ/মূত্রথলি বা পায়ুপথ বা মলাশয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। যার ফলে আক্রান্ত মহিলার যোনিপথ দিয়ে সব সময় প্রস্রাব বা পায়খানা বা দুটোই ঝরতে থাকে। প্রধানত বাধাগ্রস্ত প্রসব (১২ ঘণ্টার বেশি সময় স্থায়ী) হলে বাচ্চার মাথা প্রসবের রাস্তায় দীর্ঘক্ষণ আটকে থাকার ফলে এ অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে। এ অসুখের বেলায় আক্রান্ত নারী প্রস্রাব বা পায়খানার ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলতে পারেন।
হনুফা বেগমের বেলায়ও তার যোনিপথের সঙ্গে মূত্রথলির একটি নালী দিয়ে সংযুক্ত হয়ে গেছে যার ফলে তার প্রস্রাবের রাস্তা দিয়ে সব সময় প্রস্রাব ঝরছিল।
৪০ বছর রোগে ভোগার পর যখন তিনি এই বিষয়ে একজন এনজিও কর্মীর দেখা পান।
তিনি বলেছিলেন, আমি ৪০ বছর খোদার নাম নিতে পরিনি, নামাজ পড়তে পারিনি। আমাকে কোন ছোট বাচ্চা কোলে নিতে দেয়া হয় না। তার কথা শুনে কারও আবেগ ধরে রাখা খুবই কষ্টকর হয়ে পড়ে।
তাকে একটি হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। তাকে জানানো হয় এ রোগের আধুনিক চিকিৎসা আছে। তিনি জানতেন না যে এ রোগ ভালো হতে পারে। হাসপাতালে তার অপারেশন হয় এবং তার প্রস্রাব ঝরা সমস্যা পুরাপুরি ভালো হয়ে যায়। বুঝতে কষ্ট হয় না যে তিনি যেন নতুন জীবন ফিরে পেয়েছেন। হনুফা বেগম তার জীবনের নতুন অর্থ খুঁজে পেয়েছেন।
এই ক্ষেত্রে ফিস্টুলার কারণ ছিল দীর্ঘস্থায়ী প্রসব। তবে দীর্ঘস্থায়ী প্রসব ছাড়াও অনান্য কিছু কারণে মহিলাজনিত ফিস্টুলা হতে পারে। যদি কোন মহিলার যোনিপথে, তলপেটে অথবা জরায়ুতে কোন অপারেশন হয় তবে কখনও কখনও অপারেশনকালী অস্ত্রের/যন্ত্রপাতির আঘাতেও ফিস্টুলা হওয়া সম্ভব। অনুমান করা হয় আমাদের দেশে এক-চতুর্থাংশ ফিস্টুলা রোগী অস্ত্রোপচারের সময় যন্ত্রপাতির অনাকাক্সিক্ষত আঘাতের ফলে এ রোগের শিকার হয়েছেন। দেখা গেছে, জরায়ু অপসারণ (হিস্টেকটমি) অপারেশনের সময় বেশির ভাগ ফিস্টুলা রোগী এ দুর্ভাগ্যের শিকার হন।
কিভাবে মহিলাজনিত ফিস্টুলা প্রতিরোধ করা যায়? কিভাবে হনুফা বেগম তার পরিণতি এড়াতে পারতেন?
হনুফা বেগম বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছিলেন। কম বয়সী মেয়েদের বিয়ে তাদের অনেক রকম ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেয়। অল্প বয়স হওয়ার কারণে পরিবারে তাদের অবস্থান দুর্বল হতে পারে। সে কারণেই তাদের প্রয়োজনগুলো পরিবারে যারা সিদ্ধান্ত নেয় তারা যথাযথ গুরুত্ব নাও দিতে পারে। তুরতুরী বেগমের পরিণত বয়সে বিয়ে হলে হয়তো তার জীবনের ইতিহাস অন্য রকম হতে পারত।
তুগর্ভকালীন মানসম্পন্ন সেবা এবং তখন ফিস্টুলা এড়িয়ে চলার পরামর্শ দেয়া ফিস্টুলা প্রতিরোধের আরেকটি সুযোগ। তুরতুরী বেগমের মতো প্রান্তিক পরিবারের গর্ভবতীদের জন্য তা আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
দক্ষ দাইয়ের সঙ্গে প্রসব এবং সম্ভব হলে হাসপাতালে সন্তান জন্মদান ফিস্টুলা প্রতিরোধের সরাসরি উপায়। দক্ষ দাইরা বাধাগ্রস্ত প্রসব খুব সহজেই বুঝতে পারেন এবং রোগিণীকে উপযুক্ত স্বাস্থ্য কেন্দ্রে রেফার করতে পারেন। কোন কোন সময় বাধাগ্রস্ত প্রসবের জন্য সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে বাচ্চা প্রসবের ব্যবস্থা করতে পারেন।
সিজারিয়ান অপারেশন সম্পর্কে জনগণের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া থাকতে পারে। কেউ কেউ মনে করতে পারেন কোন কোন হাসপাতালে অধিক হারে সিজারিয়ান অপারেশন করা হয়। স্বাস্থ্য সেবার মান সমুন্নত রাখার মাধ্যমেই মূলতঃ জনসাধারণের এই উদ্বেগ নিরসন করা সম্ভব। এর ফলে অনেক বেশি মা হাসপাতালে প্রসবের জন্য আগ্রহী হয়ে উঠবেন।
হনুফা বেগমের মতো অসংখ্য মহিলাদের জন্য যেমন ফিস্টুলা প্রতিরোধ করা খুবই জরুরি তেমনই জরুরি যারা এ রোগে ইতিমধ্যে আক্রান্ত তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। বিশ্বব্যাপী দশ থেকে বিশ লাখ নারী বর্তমান পৃথিবীতে ফিস্টুলা সমস্যা নিয়ে বেঁচে আছেন। আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো মূলত এর অন্তর্ভুক্ত। প্রতিবছর প্রায় ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ নতুন রোগী যোগ হচ্ছে এ সংখ্যার সঙ্গে।
২০০৩ সালের এক জরিপের আলোকে অনুমান করা হয়, বাংলাদেশে প্রায় ৭০ হাজার মহিলা ফিস্টুলা রোগে আক্রান্ত। প্রতিবছর এর সঙ্গে যোগ হচ্ছে আরও ২ হাজারের মতো নতুন রোগী। সেই হিসাবে গড়ে বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামে অন্তত একজন মহিলা ফিস্টুলার মতো অসুখ নিয়ে দুর্বিষহ জীবনযাপন করছেন।
তারা আছেন লোকচক্ষুর আড়ালে। তারা আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন। তারা বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছেন। তাদের চিহ্নিত করা সবসময় খুব সহজ হয় না।
ফিস্টুলা রোগীদের অপারেশন করেই তার ওপর আমাদের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না, বরং তাকে পুনর্বাসন করা তার জীবিকার ব্যবস্থা করাও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাকে সাহস জোগানো, মানসিক এবং সামাজিক সমর্থন দেয়া, তার পরিবারে এবং তার সমাজে তার জন্য একটু জায়গা করে দেয়া, এই কাজগুলো সমাজপতি, সমাজভিত্তিক প্রতিষ্ঠান যেমন- ক্লাব, মসজিদ, সামাজিক সংগঠন এবং স্থানীয় গণমাধ্যম খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। স্থানীয় সরকারের নেতৃবৃন্দ যেমন- ইউপি সদস্য বিশেষ করে মহিলা সদস্য এক্ষেত্রে বিরাট অবদান রাখতে পারেন।
ফিস্টুলা অপারেশনের জন্য বিশেষ দক্ষ চিকিৎসকের প্রয়োজন। বাংলাদেশে বড় মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোতে বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ও ন্যাশনাল ফিস্টুলা সেন্টার, ঢাকা মেডিকেল কলেজে বিনামূল্যে ফিস্টুলা চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে। কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতাল যেমন- ল্যাম্ব হাসপাতাল দিনাজপুর, কুমুদিনী হাসপাতাল টাঙ্গাইল, আদ্-দীন হাসপাতাল ঢাকা, যশোর ও খুলনায় ফিস্টুলার অপারেশন সম্পূর্ণ বিনামূল্যে করা হয়ে থাকে।
এক্ষেত্রে রোগী এবং রোগীর একজন সঙ্গীর যাতায়াত খরচ এর ব্যবস্থাও করা হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে স্বাস্থ্যকর্মী ও এনজিও মাঠকর্মীরা সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে সহজেই রোগী চিহ্নিতকরণ ও রেফারকরণের জন্য দক্ষ হয়ে উঠতে পারেন। বাংলাদেশে ইউএসএআইডি, জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিল, এনজেন্ডার হেলথ বাংলাদেশের ফিস্টুলা কেয়ার প্লাস প্রকল্প, বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে এদেশে ফিস্টুলা প্রতিরোধ, চিকিৎসা পারিবারিক ও সামাজিক পুনর্বাসনের জন্য কাজ করছে। ফিস্টুলামুক্ত জীবন যা নারীর একান্ত অধিকার। সরকারি-বেসরকারি সংগঠন, সুশীল সমাজ, স্থানীয় সরকার ও স্থানীয় সামাজিক উদ্যোগের মাধ্যমে ফিস্টুলা প্রতিরোধ ও চিকিৎসা নিশ্চিত করা প্রয়োজন যা নারীর জন্য ফিস্টুলামুক্ত জীবন গড়তে সহায়ক ভূমিকা রাখবে। তথ্য সূত্র : ফিস্টুলা কেয়ার প্লাস প্রকল্প, এনজেন্ডার হেলথ্ বাংলাদেশ।
লেখক :
ডাঃ তাজকেরা সুলতানা চৌধুরী, সহকারী অধ্যাপক, সহীদ সহরওয়ার্দ্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল।