ডা. আহমেদ জোবায়ের :
রহিমা বেগম তাঁর স্বামী আজগর আলীর চুল টেনে দিতে দিতে বললেন, আপনি ভেঙ্গে পড়বেন না।
টাকার ব্যবস্থা একটা কিছু হবে।
আপনার চিকিৎসা ঠিকঠাক হবে।
আপনি চলে গেলে আমাদের কি হবে?
আমাদের কে দেখে রাখবে?
কে বকা দিবে ভুল করবে?
আজগর আলীর চোখ দুটো ভিজে গেলো।
গড়িয়ে পড়া অশ্রুতে দাঁড়িগুলো ভিজে জবজব অবস্থা।
বুকের ভেতর কেমন তীব্র হাহাকার লাগছে।
আজগর আলী ক্ষীণ কন্ঠে বললেন, কোথায় টাকা পাবে রহিমা তুমি?
এত টাকা আমাদের কেউ দিবে না।
যাদের জন্য সারাজীবন মেহনত করলাম তারাতো আমাদের খবর ও নেয়না।
বড় ভাবী হিসেবে আমাদের মা মরা ভাইবোনদের মায়ের আদর দিলা। আমার বাবার এত সেবা করলা।
কিন্ত দিনশেষে কি পেলা রহিমা?
মেয়েটা বড় হয়েছে। মানুষের চোখে লাগছে।
বিয়ের প্রস্তাব আসে। কিভাবে মেয়েটাকে বিয়ে দেই?
দুনিয়া থেকে চলে যাবার আগে মেয়েটার একটা গতি করে যেতে পারলে কিছুটা স্বস্তি লাগতো।
রহিমা বেগম পরম মমতায় স্বামীর কপালে ম্যাসাজ করে দিচ্ছেন।।
হুট করে আজগর আলীর কপালে একটা চুমু খেলেন।
আজগর আলী তাকালেন অতীতের দিকে।
বিশটা বছর বিদেশে পড়ে ছিলেন।
৫ বছরে একবার দেশে আসতেন।
অনেক কষ্ট করেছেন।
না খেয়ে থেকেও বাড়িতে টাকা পাঠাতে দেরি করেননি।
চারটা ভাইবোনের লেখাপড়া, বাবার চিকিৎসা, সংসারের খরচ মিটাতে মিটাতে সবচেয়ে বেশি অবহেলা সয়েছেন রহিমা।
অদ্ভুত এক নারী।। কোনদিন কোনকিছুর জন্য অনুযোগ -অভিযোগ করেননি।
নিজেদের চার বাচ্চার ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবেননি।
মা মরা আজগর আলীর চার ভাইবোনকে বুকে আগলে মানুষ করেছেন রহিমা।
তাদের বিয়ে দিয়েছেন।
বোনটা কিছুটা অসুবিধায় থাকলেও তিন ভাই আজ প্রতিষ্ঠিত। সবার গাড়ি বাড়ি আছে।
শহরে আয়েশি জীবন।
একজনের বিরাট ব্যবসা।
সবার কথা ভাবতে ভাবতে আজগর আলীর নিজের দিকে তাকানোর ফুরসৎ মিলেনি।
চোখ দুটো এত বেহায়া কেন ভাবছে আজগর আলী।
এত কান্না আসে কোথায় থেকে।
অশ্রুগন্থিগুলো শুকিয়ে যায়না কেন?
রহিমা বেগম মুরগীর স্যুপ বানিয়ে এনেছেন স্বামীর জন্য।
চামচ দিয়ে স্যুপ মুখে দিতে দিতে তিনি বললেন, একদম ভাব্বেন না।। কোন চিন্তার কিছু নেই।
যার কেউ নেই তার আল্লাহ আছেন।
যার আল্লাহ আছেন,তার দুনিয়ার কাউকে লাগেনা।
আজগর আলী স্ত্রীর কথায় শান্তি পেলেন।
তিনি বললেন,রহিমা তুমি এতবড় বিপদ, অসহায় অবস্থায় এত ধৈর্য্য কিভাবে রাখো?
আজগর আলীর কোলন ক্যান্সার হয়েছে।
সেটা শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে গেছে।
অপারেশন, কেমো সহ অনেক টাকার দরকার।
যেই ভাইবোনের মানুষ করতে একদিন সব মায়া বিলিয়ে দিয়েছেন তাদের কাছে আজগর আলী গেঁয়ো, অশিক্ষিত।
তাদের স্ট্যাটাসের সাথে খাপ খাওয়াতে অপারগ তিনি।
তারা সব বিস্মৃত হয়ে নিজের দুনিয়ায় ব্যস্ত।
আজগর আলীর মেয়েটা চাচাদের ফোন দিয়ে জানিয়েছে।
ছোট ভাইটা ২০ হাজার টাকা দিয়ে বলছে আর কিছু করার নেই।
অন্য দুই ভাই তো এতই ব্যস্ত ভাইকে এক মিনিট ফোন দেবার টাইম তাদের নেই।
মেয়েটা ফেসবুকে দেখলো তার মেঝো ভাই বউ বাচ্চা নিয়ে আন্দামান দ্বীপে নাকি ঘুরতে গেছে।
খুব আনন্দ করতে।
ফেসবুকে ৫০টা ছবি নাকি দিছে।
মেয়ের কথা শুনে আজগর আলী কেমন নীরব হয়ে গেলেন। মেয়েটা চাচাকে নাকি ম্যাসেজ ও দিয়েছে।
কিন্ত রিপ্লাই আসেনি।
আজগর আলী মেয়েটাকে বুকে নিয়ে বললেন, মা তোর এই চাচার একবার এপেন্ডিসাইটিস হয়েছিলো।
অপারেশন করতে ১৫ হাজার টাকা লাগবে বলে তোর দাদা ফোন দিলো।
আমার কাছে এক টাকাও নেই দুই মাস বেতন পাইনা।
আগের মাসে ধার করে বাড়িতে টাকা পাঠাইছি।
তখন তুই ছোট। শখ করে তোর জন্য একটা সোনার চেইন কিনছিলাম। সেটা দেশের এক লোককে দিয়ে টাকা এনে দেশে পাঠাইছিলাম।
সবই আমার ভাগ্য।
রহিমা বেগম চার ছেলে মেয়েকে নিয়ে বৈঠকে বসলেন। তিনি বললেন,তোমরা কেউ তোমাদের চাচাদের কাছে
তোমার বাবার চিকিৎসায় সহায়তা চাও তা আমি চাইনা।
তোমার বাবা তাদের জন্য যা করেছেন,তা ছিলো বড় ভাই হিসেবে তার দায়িত্ব।
এখন কেউ যদি নিজ থেকে দায়িত্ব অনুভব করে,তবে ভালো কিন্ত আমি তোমার বাবাকে তার ভাইদের কাছে
ছোট হতে দিবো না।
তোদের বাবার মাথা আমি নীঁচু হতে দিবো না।
আমার সাফ কথা।
রহিমা বেগম বললেন, আমার মা আমাকে ২ ভরি সোনা দিয়েছেন তা বিক্রি করবো।
আমি তোমাদের বড় মামাকে গিয়ে বলে এসেছি।
আমার বাবার সম্পত্তিতে যেইটুকুন অংশ আমি পাই তার বিনিময়ে আমাকে টাকা দিয়ে দিতে।
আগে ভাবছিলাম বাবার বাড়ির সম্পত্তি আনবো না।
এখন সিদ্ধান্ত নিয়েছি আনবো।
তোমার বাবার চিকিৎসা ইন্ডিয়াতে নিয়ে করাবো।
দেশের চিকিৎসকরা বলছেন,তার ক্যান্সার ছড়িয়ে গেছে।
আমি নিজেও জানি তিনি বাঁচবেন না।
মরার আগে আমি তাকে শান্তি দিতে চাই।
তার চিকিৎসা হয়েছে এই অনুভূতি তার পাওয়া চাই।
কথা বলতে বলতে রহিমা বেগম ডুকরে কেঁদে উঠলেন।
আজগর আলী বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন।
বড় ঘরে কাউকে না দেখে রহিমা রহিমা বলে ডাকলেন।
কেউ সাড়া দিচ্ছেনা দেখে নিজে অনেক কষ্টে ঘর থেকে বের হয়ে কাচারি ঘরের দরজায় এসে দেখেন দরজা ভেজানো,ভেতরে সবার আওয়াজ শুনা যাচ্ছে।
তিনি চুপচাপ দাঁড়িয়ে শুনলেন।
রহিমার একটা কথায় তার চেহারা উজ্জ্বল হয়ে গেলো।
আমি তোমাদের বাবার মাথা কারো কাছে নীঁচু হতে দিবো না।
পরম তৃপ্তি লাগলো।
আবার অপরাধবোধও জাগলো।
যেই নারীর অবহেলা সবচেয়ে বেশি করেছেন,বছরের পর বছর যাকে সঙ্গ থেকে বঞ্চিত করেছেন,সবার দায়িত্ব পালনে যাকে সবার পরে লিস্টে রেখেছেন,সেই নারী আজ আজগর আলীর মাথা উঁচু করার পরিকল্পনা করছেন।
আজগর আলী কাচারি ঘরে না ঢুকেই দরজায় দাঁড়িয়ে হাত তুললেন আকাশের মালিকের কাছে।
হে পারওয়ারদিগার হে অসীম দয়াবান আল্লাহ, আপনি রহিমাকে দেখে রাখবেন।
রহিমা বেগম দরজা খুলে দেখলেন, আজগর আলী দাঁড়িয়ে মুনাজাতরত।
কান্নাভেজা কথামালা।
রহিমা বেগম বললেন, কখন এখানে উঠে এসেছেন?
আজগর আলী রহিমা বেগমের কাঁধে হাত দিয়ে বললেন, চলোনা রহিমা একটু বাড়ির সামনের রাস্তায় হেঁটে আসি।
আজ কি সুন্দর চাঁদের আলো। ধবধবে সাদা চারদিকে।
আজগর আলী হেঁটে হেঁটে রহিমার হাত ধরে পারিবারিক কবরস্থানে চলে গেলেন।
মা বাবার কবরের সামনে দাঁড়িয়ে দোয়া দুরুদ পড়লেন। তারপর বললেন, আব্বা আম্মা আমি আসতেছি আপনাদের কাছে।
রহিমাকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন,আমাকে এইখানে মায়ের পাশে শোয়াবা।
রহিমা বেগম চুপচাপ।
নিশ্চুপ।
কিছুক্ষণ পর রহিমা বেগম বললেন,আপনার কিছু হবেনা।
আপনি সুস্থ হবেন ইনশাআল্লাহ।
চিকিৎসার টাকা ম্যানেজ করে ফেলছি।
আজগর আলী কিছুই বললেন না।
শুধু রহিমার গাল টেনে আদর করে বললেন,চলো বাড়ি যাই।
ভোর রাতে সবাই ঘুমে।
আজগর আলীর ঘুম নেই।
তাঁর মনে হচ্ছে তিনি মারা যাবেন এই ফজরের আজানের সাথে সাথে।
হাতে সময় বেশি নেই।
ছেলে মেয়ে গুলো অন্য রুমে ঘুমাচ্ছে।
আজগর আলী রহিমার দিকে নিবিষ্ট মনে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ।
পরম সুখ অনুভব করলেন রহিমার ঘুমন্ত চেহারা দেখে।
এভাবে কখনও আগে রহিমাকে দেখেননি তিনি।
ভোর ৬ টায় ফজরের নামাজের পর মসজিদের মাইক থেকে এহলান ভেসে আসলো।
আজগর আলীর ইন্তেকাল হলো।
কাফনে মোড়ানো আজগর আলীর চেহারায় আলো চমকাচ্ছে।
রহিমা বেগমের বুকফাটা আর্তনাদ শুনা যায়।
"আমাকে একা করে কেন চলে গেলেন আপনি। আমি তো শুধু আপনাকেই চাইছি,আর তো কিছু কোনদিন চাইনি"
মৃত আজগর আলীকে দেখে মনে হচ্ছে, তিনি হাসি দিয়ে আছেন।